বেশ কিছু দিন রাতের কলকাতার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল রহস্যময় পাথুরে আততায়ী

১৯৮৯ সালের জুন মাসটা এখনও ভুলতে পারেননি সেই সময়ের দুঁদে ক্রাইম রিপোর্টার অধুনা দৈনিক বর্তমানের প্রকাশক জীবানন্দ বসু। বত্রিশটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনও জীবানন্দবাবুর অনায়াসে মনে পড়ে যায় তার পরের বেশ কিছু দিনের হাড় হিম করা অভিজ্ঞতা। লালবাজারের বড় কর্তাদের সঙ্গে রাতভর ছুটে বেড়ানো শহরের নানা প্রান্তে, একটাই লক্ষ্যে, খুঁজে বের করতেই হবে আততায়ী কে !

গভীর রাতের মধ্য কলকাতা, সেন্ট্রাল এভিনিউ - এর বুক চিরে ইতস্তত ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। রাস্তার আলোর মাঝে শুধু গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছে এদিক-ওদিক। আবছায়া আলোয় দেখা যাচ্ছে লালদিঘির লাগোয়া ফুটপাথের কোনে শুয়ে এক মাঝবয়সী মহিলা। হঠাৎ পিন পড়া নিস্তব্ধতার ফাঁকে যেন রাস্তা ফুঁড়ে উঠে এল গায়ে চাদর মোড়া একজন, আর পাশের ময়লার জায়গার গায়ে লাগা একটা প্রকাণ্ড পাথর তুলে এনে সজোরে বসিয়ে দিল ওই মহিলার মাথায়। রাতের পর রাত এই নিশাচর আতঙ্কের হানা শহর কলকাতায় তৈরি করেছিল এক ভয়ার্ত আবহ। পাড়ার মোড়ের আড্ডাও আর বেশি রাত পর্যন্ত চলত না। জরুরি প্রয়োজনে কাজের জায়গায় বা অন্য কোথাও বাইরে থাকলেও সকলেই চেষ্টা করতেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। স্টোনম্যান, শব্দটা যেন মহাকরণ-লালবাজারের কর্তা থেকে হরিপদ কেরানি সকলের মধ্যেই এক অজানা উদ্বেগের ছাপ ফেলে দিয়েছিল। নিশির ডাকের সঙ্গে জ্যাক দ্য রিপার-এর মিশেলে যে ভয়ংকর এক চলমান অশরীরীর আবির্ভাব হয়, সেটাই ছিল যেন ‘স্টোনম্যান’। বাবা-কাকারা তো বটেই, পাড়ার দাদারা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপত, রক ছাড়ে জলদি, গলির মুখে ক্যারমের পাট উঠিয়ে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরে তাড়াতাড়ি।

সম্ভবত ১৯৮৯ সালের ৪ জুন তারিখে লালবাজারের পুলিশ হেডকোয়াটার্স-এর পাশেই লালদিঘি এলাকার এক রাস্তায় ভোরের আবছা আলোয় খুন হলেন এক ফুটপাথবাসী মহিলা। তাঁর দেহ পাওয়া যায় সকালে। পাশে একটা রক্তাক্ত বড় পাথর, যা দিয়ে তাঁর মাথাটা থ্যাঁতলানো হয়েছিল ভয়ঙ্কর ভাবে। পৃথিবী তখন তোলপাড় হচ্ছে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র বিক্ষোভ নিয়ে। এরকম হই-হট্টগোলের মাঝে কলকাতায় এই মহিলার ঘুমন্ত অবস্থায় খুনের খবর নিয়ে কেউই মাথা ঘামায়নি। মহিলা নাকি ওই লালদীঘি এলাকায় চোলাই মদ বিক্রি করতেন আর রাস্তাতেই থাকতেন-ঘুমোতেন। এরকম লোক খুন হলে কারও নজর পড়ে নাকি?

দ্বিতীয় খুন অবিকল ওই ভাবে ঘটে ঠিক এক মাস পরে। ৪ জুলাই অন্য একটা রাস্তায় পুলিশ আর একটা দেহ পায়। এ বার নিহত এক ভিক্ষাজীবি। সেই মাথা-থ্যাঁতলানো অবস্থা, আর পাশে একটা রক্তমাখা পাথর। এর পরের তিন মাসে আরও চার-চারটে খুন হয় কলকাতার রাস্তাঘাটে। প্রত্যেক বার পাথর দিয়ে নৃশংস হত্যা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিকার রাস্তার ঘুমন্ত দরিদ্র মজদুর অথবা ভিখিরি। চোদ্দো বছরের এক কিশোরও রেহাই পেল না এই অদৃশ্য খুনির করাল গ্রাস থেকে। ওই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসের ৮ তারিখে পুলিশ খুঁজে পেল সাত নম্বর দেহটি । এ বার ৩৫ বছরের এক উন্মাদ ভিখারির মৃতদেহ পাওয়া গেল। তখন নিউজ চ্যানেলের সময় নয়, খবরের কাগজগুলি তোলপাড় ফেলে দিয়েছে স্টোনম্যান কাণ্ড নিয়ে। ত্রস্ত কলকাতার নাগরিক সমাজ। পুলিশের দৃঢ় ধারণা, এই খুনগুলো এক জন লোকেরই কাজ। ভারী পাথর দিয়ে খুনের পদ্ধতি দেখে অনুমান করা গেল, খুনি এক জন লম্বা, শক্তিশালী পুরুষ। একটি ইংরিজি কাগজ প্রথম খুনির নাম দেয় ‘স্টোনম্যান’। হিন্দুস্থান টাইমস-এর ব্যুরো চিফ আর সেই সময়ের তরুণ ক্রাইম রিপোর্টার তন্ময় চ্যাটার্জি অবশ্য জানাচ্ছেন, ওই ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে কোনও একটা সময় একই রাতে দুই জায়গায় পাথর দিয়ে আক্রমণের খবর আসার খুনি একজন না একাধিক সে বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়।
১৯৮৯-এর পুজোর সময়ে স্টোনম্যানের ভয়ে গোটা শহর তটস্থ। টালা থেকে টালিগঞ্জ, কোনও এলাকাই স্টোনম্যানের ভয় থেকে রেহাই পেল না। পুজোর আগেই মোট সাতটা খুন হওয়ার পর কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার প্রয়াত রচপাল সিং একটি বিদেশী সংবাদমাধ্যম -এর সাংবাদিককে জানান, ‘প্রথম তিন-চারটে খুনের পরেও ভাবা যায়নি যে এটা একজন লোকের কাজ হতে পারে। আপাতত বিষয়টি যথেষ্ট চিন্তার। শহরের নাগরিকরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তাঁরা খবরের কাগজ মন দিয়ে পড়ে। সকলেই এখন এই রহস্যের সমাধান চায়।

এর পর মার্চ ১৯৯০ পর্যন্ত আরও ছ’টা ‘স্টোনম্যান হত্যা’ হয় কলকাতায়, সব মিলিয়ে তেরোটা। কোনও খুনের কোনও সাক্ষী নেই। উপায় না পেয়ে পুলিশের লোকদের সন্ধেবেলা থেকে দেখা যেত পাড়ায় পাড়ায় পাথর-ইট সরাতে। পুলিশের তদন্তে জানা গিয়েছিল, প্রত্যেকটা খুনই হয় রাত তিনটে আর ভোর পাঁচটার মধ্যে। অনেকে নিশ্চিত, খুনি এক পলাতক আসামী বা দানব জাতীয় কিছু। কেউ কেউ ভাবল, স্টোনম্যান এক জন তান্ত্রিক আর হত্যাগুলি সব মা চণ্ডীর চরণে নরবলি। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর থেকে পুলিশ কলকাতার রাস্তা থেকে অনেক ‘উন্মাদ’ আর ভবঘুরেকে ধরতে শুরু করেছিল। অনেক পুলিশ কর্মী আবার নকশাল আমলের মতন চাদর মুড়ি দিয়ে রিভলভার হাতে নিয়ে ঘাপটি মেরে রাস্তাঘাটে অপেক্ষায় থাকতে শুরু করলেন রাতভর স্টোনম্যানের অপেক্ষায়। চলত রাতভর টহলদারি।

কেমন ছিল সে সব অভিযান? তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় হাত পাকানো জীবানন্দ বসুর কথায়, বেশ রাত পর্যন্ত চলত টহলদারি। একবার এক ভবঘুরেকে পাকড়াও করার পর যতবার তার নাম জানতে চাওয়া হয় সে বলে, মেরা নাম দুনিয়া কা মালিক। তার কথার ধরণে সকলে হতবাক। লোকটা বলে কি ! দুনিয়া কা মালিক? খানিকটা ধমকধামক দিয়ে শেষে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর একদিন বন্ধ হল ওই হত্যাপর্ব। যে রকম শুরু হয়েছিল আচমকা সে রকম শেষও হল চুপিসাড়ে। মার্চ ১৯৯০-এর পর বন্ধ হল স্টোনম্যানের হত্যার পালা। কয়েক মাস কলকাতার লোকজন বসে থাকল চুপটি করে। এর আগের পাঁচ মাস ধরে রাত্রের চুরিচামারি একদম কমে গেছিল। আস্তে আস্তে আর কোনও পাথুরে-হত্যার খবর না পেয়ে চোরেরা আবার বেরোতে শুরু করল। আমজনতাও কলকাতার রাত আর ভোরবেলাগুলো ফেরত পেতে শুরু করল। কে যে ‘স্টোনম্যান’ আদৌ এক জনই হত্যাকারী ছিল কি না তার উত্তর আর পাওয়া গেল না।

শুরুটা অবশ্য মুম্বাইয়ে। একজন সিরিয়াল কিলার, যে ভিক্ষুক এবং গরীব কাপড় বিক্রেতাদের খুন করে চলেছে, এমন সন্দেহের প্রথম শুরু হয় মহারাষ্ট্রের রাজধানীতে। দুঃখের বিষয়, প্রথম ৬টি খুন একইভাবে হলেও ষষ্ঠ খুনটির আগে পর্যন্ত মুম্বাই পুলিশ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এটি একটি সিরিয়াল কিলারের কাণ্ড হতে পারে। ৬ নম্বর খুনের পর পুলিশ অপরাধের মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন খুঁজে পায়, যা তাদের সিরিয়াল কিলিং সম্বন্ধে ভাবতে বাধ্য করে। এই হত্যাকাণ্ড চলে টানা ২ বছর ধরে। তারপর ১৯৮৭ সালে বন্ধ হয়। মুম্বাইয়ের সিয়ন এবং কিং’স সার্কেল এলাকায় ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটেছিল।

মুম্বাইয়ের ওই হত্যাকারী খুব দ্রুতই ‘পাত্থারমার’ নামে পরিচিত হয়ে যায়। পাত্থারমারের খুনের ধরন ছিল খুবই সাধারণ। প্রথমেই সে একজন সাধারণ মানুষকে খুঁজে বের করত যে রাতে রাস্তায় ঘুমায়। আর সেই মানুষটি যদি একটু নিরিবিলি জায়গায় একা ঘুমিয়ে থাকে, তবেই সে খুনীর টার্গেটে পরিণত হত। একটি ভারী পাথর দিয়ে তখন খুনী রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষটির মাথা একদম থেঁতলে দিত। যে পাথর দিয়ে খুনী হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাত, তার প্রত্যেকটির ওজন প্রায় ৩০ কেজির কাছাকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা নিহত হত, তাদের পরিচয় কখনোই জানা যেত না। এর কারণ তারা একা ঘুমাত। এছাড়াও তারা তাদের পরিবার থেকেও দূরে থাকত। আর মুখগুলোও এমনভাবে থেঁতলে যেত যে, চেনার উপায় থাকত না। অথচ এই হত্যাকাণ্ডগুলিতে প্রথমদিকে পুলিশ একদমই গুরুত্ব দেয়নি।

পৃথিবীর ইতিহাসে নানা ধরণের সিরিয়াল কিলারের কুখ্যাত সব অপরাধের তথ্যই উঠে এসেছে নানা সময়ে। তবে আশির দশকের আগে-পরে বেশ কিছু দিন দেশের দুই বড় শহরের এই স্টোনম্যান পর্ব একসময় হাড়ে কাঁপন ধরিয়েছিল মুম্বাই আর কলকাতার।

তথ্যসূত্র - গোয়েন্দ্যা পীঠস্থান লালবাজার - সুপ্রতিম সরকার, আইপিএস রবিবাসরীয় প্রবন্ধ - ইন্দ্রজিৎ হাজরা, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

More Articles