আক্রান্ত জগন্নাথ মন্দির || বাংলার সেনা দেখে পিছু হঠেছিলেন দিল্লির সুলতান

ইলিয়াসশাহী বাংলার ইতিহাসে এক সুবর্ণযুগ একথা ঐতিহাসিকমাত্রেই স্বীকার করে থাকেন। ইলিয়াসের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ফিরোজ শাহ পর্যন্ত ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লি। কী রাজ্যশাসনে, কী সংস্কৃতির দিক দিয়ে স্বাধীন বাংলা সলতনাত্ অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়েছিল। ইলিয়াসশাহীর প্রসঙ্গ এলেই যে নাম আপনা থেকে এসে পড়ে, তা হল হুসেন শাহি আমল। এই বংশের চার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, নসরৎ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ। এই চার রাজার মধ্যে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সবথেকে আলোচিত চরিত্র। মজার ব্যাপার, আজকে যে দুইজন রাজার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলব, তাঁদের রাজত্বকাল প্রায় সমসাময়িক। হুসেন শাহ বাংলার সুলতান হলেন ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রতাপরুদ্রদেব উড়িষ্যার সিংহাসনে বসলেন ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র তিনটি বছরের অন্তরায় কয়েক দশকব্যপী যুদ্ধবিগ্রহের পথ প্রশস্ত করে।

রিয়াজুস সালাতিন অনুসারে তিনি তিরমিজের বাসিন্দা সৈয়দ আশরফের পুত্র। কী করে তিনি বাংলায় এসে পোঁছলেন, জানা যায় না। তবে তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। মুর্শিদাবাদের চাঁদপারা গ্রামে ছিল তাঁর বাস। তখন বাংলার অবস্থা খুব একটা ভাল না। নানা অরাজকতায় রাজ্যজোড়া অশান্তি চলছে। বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। হাবসি শাসন চলছে। সুলতান শামসুদ্দিন মোজাফফর শাহ তখন তখতে। রাজসভায় নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন হুসেন শাহ। শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী অবধি করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু চূড়ান্ত অরাজকতায় মানুষ ক্ষেপে গিয়েছিল। তারা বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের হাতেই সুলতান নিহত হন। অনেকে মনে করেন, হুসেন শাহ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিদ্রোহে পাইকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের হাতেই সুলতান খুন হয়ে যান। এরপরেই সিংহাসনে বসেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। ক্ষমতায় এসেই সবার আগে তিনি পাইকদল ভেঙে দিলেন। তৈরি করলেন নতুন রক্ষাবাহিনী। কাকে বিশ্বাস করা যায় আর কাকে যায় না– এই ব্যাপারে ভাল অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। হাবসি সৈন্যদের রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দূর করলেন। ফলে রাজ্যের শৃঙ্খলার অনেকটাই তাঁর আয়ত্তে এল। এইসব কার্যকলাপ তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। প্রশাসনের মধ্যে সৈয়দ, হিন্দু, মোঙ্গল, আফগান— যারা যোগ্য, সবাই স্থান পায়। সেই সময় দিল্লির সুলতান সিকন্দর লোদি। সিকন্দরের সঙ্গে যুদ্ধে গোহারা হেরে জৌনপুরের সুলতান হুসেন শর্কি ফিরলেন বিহারে। কিন্তু সিকন্দর পিছু ছাড়লেন। ১৪৯৪ সালে আবার আক্রমণ করলেন বিহার, এবারও হেরে গিয়ে শর্কি পালিয়ে এলেন বাংলায়। তখতে বসা তখনও এক বছর হয়নি, দিল্লির সুলতানের শত্রু শর্কিকে নির্দ্বিধায় আশ্রয় দিলেন হুসেন শাহ। এতে সিকন্দর লোদির সমস্ত কোপ পড়ল গিয়ে বাংলার ওপর। সিকন্দরের সেনাবাহিনী বাংলার দিকে অগ্রসর হলে ছেলে দানিয়েলের নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্যদল পাঠান হুসেন শাহ। অধুনা পাটনার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বারহ-তে দুই বাহিনীর মোলাকাত হয়। কিন্তু বাংলার সেনা দেখে ধূর্ত সিকন্দর আন্দাজ করেন, এই বিরাট বাহিনী জয় করা শর্কির মতো সহজ হবে না। সেনাপতি মুহম্মদ লোদি ও মুবারক খান লোহানি ভয় পেয়ে যান। কাজেই সন্ধি করে দিল্লি ফেরেন সিকন্দর। সিকন্দর বাংলা আক্রমণ করবেন না, বদলে সিকন্দরের শত্রুকে বাংলায় আশ্রয় দেওয়া হবে না– এই সিদ্ধান্ত হয়। এতে করে হুসেন শাহের একূল-ওকূল দু'কূলই বজায় থাকে। ঠিক এর পরপরই সাম্রাজ্য বাড়ানোতে মন দেন হুসেন শাহ, এই সময় থেকেই উড়িষ্যার সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শুরু।

প্রতাপরুদ্রদেব উড়িষ‍্যার সূর্যবংশী রাজাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একা চারজন হুসেন শাহি রাজার রাজত্বকালের প্রায় সমান সময় রাজত্ব করেছেন। উড়িষ্যার সূর্যবংশ গজপতি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রতাপরুদ্রের পিতামহ কপিলেন্দ্র দেব রৌতরায়। প্রতাপরুদ্র ছিলেন পরম বৈষ্ণব এবং চৈতন্যভক্ত। হুসেন শাহের রাজত্বকালেই চৈতন্যের উত্থান। কাজেই অনেকে হুসেন শাহের রাজত্বকে বাংলার নবজাগরণের যুগ বলে চিহ্নিত করতে চান। ঠিক সেই রকম প্রতাপরুদ্রের খ্যাতিও উড়িষ্যায় সর্বজনবিদিত। কিন্তু একদিকে বিজয়নগর, একদিকে গোলকোণ্ডা কুতুব শাহি আর উত্তর-পূর্বে হুসেন শাহি আক্রমণের চোট সামলাতে সামলাতে বিপুল পরিমাণ রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। সেনাবাহিনী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে, যার চোট আগামী ছ'শো বছরেও আর সামলে উঠতে পারেনি উড়িষ্যা। ১৪৯৭ সালে যখন প্রথমবার উড়িষ্যা আক্রমণ করেন হুসেন শাহ, তখন প্রতাপরুদ্র সবে সিংহাসনে বসেছেন। সতেরো বছর বয়সি সম্রাট সেই আক্রমণ রুখে দিতে পেরেছিলেন। রাজ্যের উত্তর সীমা থেকে হুসেন শাহি সেনাদের বিতাড়িত করার পর উত্তরদিকের প্রতিরোধ আরও মজবুত করেন। বেশ কিছু সেনা মোতায়েন করা হয়। এই সময় থেকেই বাংলা-বিহার খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। একবার হুসেন এগিয়ে আসেন, একবার প্রতাপ।  

আরও পড়ুন: বাংলা-উড়িষ্যার দ্বন্দ্বে বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে এই মন্দির

এরই মধ্যে দক্ষিণ দিকে বিজয়নগরের সঙ্গে গোলযোগে জড়িয়ে পড়েন প্রতাপরুদ্রদেব। খানিকটা দখলও করে ফেলেন। কিন্তু এই সময়েই হুসেন শাহ আরেকবার উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। অরক্ষিত রাজ্যের বেশ খানিকটা জয় করে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ধনসম্পদ লুঠ করেন বঙ্গসুলতান। তবে ইসমাইল গাজিকে নিয়ে যে প্রচার রয়েছে, মূলত উড়িষ্যার মাদলপঞ্জির কারণেই, তা সর্ব্বৈব মিথ্যা। কারণ এর ঢের আগে ইসমাইল গাজি খুন হয়ে গিয়েছিলেন। ১৪৭৪ সালে যাঁকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়, তাঁর কবন্ধ ভূত হুসেন শাহর সেনাপতি হয়ে উড়িষ্যা দখল করতে এসেছিল– একথা বোধহয় বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। তবে ইসমাইল গাজির জীবদ্দশায় তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করেন, এমন তথ্যও পাওয়া যায়। কিন্তু তার সময়কাল সম্পূর্ণ আলাদা। মাদলপঞ্জি লেখকেরা সম্ভবত সেবারের পরাজয়ের রাগ ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। এছাড়াও আর. ডি. বন্দ্যোপাধ্যায় ইসমাইল গাজির সমাধিস্থলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নামে একটি শিলালিপির উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে যদিও শিলালিপিটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। হতে পারে ইসমাইল গাজিকে শ্রদ্ধার্পণের জন্য হুসেন শাহ কোনও সৌধ নির্মাণ করে থাকবেন– এই কারণেই ভ্রান্তির জট আরও পোক্ত হয়েছে। যাই হোক, হুসেনের দ্বিতীয় উড়িষ্যা আক্রমণে পুরীর ধনসম্পদ তো লুঠ হয়ই, কয়েকটি মূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এই মূর্তিগুলি খুব সম্ভবত দেববিগ্রহ নয়। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা করা কিছু ভাস্কর্য হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ আবদুল করিম বলছেন, “হােসেন শাহের আসার সংবাদে প্রতাপরুদ্র দেবের সময়ে কটকের রক্ষী সামন্ত রায় বিদ্যাধর দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবার সময় জগন্নাথ প্রতিমাসমূহ নৌকায় চাপিয়ে চিলকা হ্রদ হয়ে পর্বতে আশ্রয় নেন।” মাদলপঞ্জিতে যে মূর্তি বা বিগ্রহ ধ্বংসের কথা রয়েছে, তা সম্ভবত মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যই। এছাড়াও মাদলপঞ্জির তথ্যের সার্বিক সত্যতা সম্বন্ধে সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রভাত মুখোপাধ্যায়– উভয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বারবার।

এই আক্রমণের খবরে দক্ষিণাঞ্চল থেকে গজপতি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের দিকে ফেরেন প্রতাপরুদ্র। অনন্ত সামন্তরায় বরাবাটি দুর্গে দুর্ধর্ষ যুদ্ধ করেও প্রাথমিকভাবে হুসেনের সেনাবাহিনীর সামনে পিছু হটতে বাধ্য হন। কথাজোড়ি নদীর দক্ষিণে সরণগড় দুর্গে আশ্রয় নেন অনন্ত। এ সময়েই পুরী মন্দির আক্রান্ত হয়। একা ভয় বিদ্যাধর তাঁর যাবতীয় সেনাবল নিয়ে সুলতানের আক্রমণ ঠেকাতে থাকেন। ইতিমধ্যে বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতাপরুদ্রদেব রাজ্যে ফেরেন। প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে পিছু হটতে থাকে হুসেনের বাহিনী। পলায়নরত বাহিনীকে তাড়া করে কুতুব শাহি সেনার মন্দারণ দুর্গ অবধি পাল্টা দখল করে ফেলেন প্রতাপরুদ্রদেব। তবে এই জয় খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিপুল লোকবল হারিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে হয় প্রতাপরুদ্রকে। উড়িষ্যার সামরিক ধাঁচা অতি দুর্বল হয়ে পড়ার এই শুরু।

More Articles