প্রায় এক কোটি দেবদেবীর মূর্তি! ত্রিপুরার এই পাহাড় আজও রহস্যে ঘেরা

Unakoti: মনে করা হয় এই অঞ্চলে রয়েছে নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো নিরানব্বইটি দেবদেবীর মূর্তি।

মানব ইতিহাসের অন্যতম দলিল হলো গুহার ভেতর বা পাহাড়ের গায়ে পাথরের ওপর খোদাই করা শিলা-শিল্প। চুনাপাথর, বেলেপাথর, ব্যাসাল্ট স্টিয়েটাইট, ক্যালসাইট, জিপসাম, আলাবাস্টার, গ্র্যানাইট, মার্বেল বা জেড পাথরের ওপর, আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের জীবনযাপনের ছবি এঁকেছেন। অনেক জায়গায় তাঁরা রঙের ব্যবহার করে রেখেছেন আর যেখানে রং ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি সেখানে পাথর খোদাই করে তৈরি করে গেছেন অবিশ্বাস্য সব শিল্পকর্ম। এইসব কালজয়ী শিল্পকর্ম তৈরি করতে সময় লেগে যেত কয়েক যুগ থেকে কয়েকশো বছর। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এক প্রজন্মের শিল্পী কাজ শুরু করেছেন এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী সেই কাজ শেষ করেছেন। অজন্তা, ইলোরা, খাজুরাহো, এলিফ্যান্টা, বিদিশার উদয়গিরি গুহা, বাদামি গুহা, বরাহ গুহা, মহিষমর্দিনী মণ্ডপ, পুরী মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির, ধর্মশালার কাংড়া দুর্গ আমাদের দেখা হলেও এই শিলা শিল্পের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের উদাহরণ বোধ হয় অনেকের নজরের অগোচরেই রয়ে গেছে।

শিলা শিল্পের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রঘুনন্দন পাহাড়ে। এই রঘুনন্দন পাহাড়েই সকলের নজরের আড়ালে অবস্থিত রয়েছে ঊনকোটি। এই পাহাড়ের নাম অনুসারে পরবর্তী সময় যখন রাজ্যে জেলার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় তখন একটি জেলার নাম রাখা হয় ঊনকোটি। এই পাহাড়ের উপর পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে প্রচুর সংখ্যক হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি। ঊনকোটি শব্দের অর্থ হল এক কোটির থেকে এক কম, অর্থাৎ নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো নিরানব্বই। মনে করা হয় এই অঞ্চলে রয়েছে নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো নিরানব্বইটি দেবদেবীর মূর্তি। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য যে দেশের নব্বই শতাংশ মানুষই জানেন না যে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রক আর্ট গ্যালারি হল ঊনকোটি। কোনও এক অলিখিত কারণে, ত্রিপুরার এই অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম ইতিহাসে উপেক্ষিত। ফলত আজও লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে রয়েছে এই অসাধারন শিল্পকর্ম। বর্তমানে অবশ্য ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI)-এর দৌলতে এখন এই স্থান হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। চার পাশ দিয়ে সিঁড়ি করা হয়েছে, যাতে পর্যটকরা অনায়াসেই ঘুরে দেখতে পারেন। পাহাড়ের সিঁড়ি ধরে কিছুটা উপরে উঠেই চোখে পড়বে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই পাথুরে ভাস্কর্যের পাহাড়। পাথুরে পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা শত শত বছরের পুরোনো এসব ভাস্কর্যের দিকে কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কী অসাধারণ মানুষের হাতের কাজ। মানুষ চাইলে আসলে কতই না অসাধ্য সাধন করতে পারে।

অপূর্ব সুন্দর ঊনকোটি

পাহাড়ের গায়ে এইসব বিশালাকার অবয়বগুলির মায়াবী ভাস্কর্য দেখে আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে কোনো মানুষ এত সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। ঊনকোটির আরেকটু ভেতরে এগোলেই আপনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাবেন পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরি করা প্রায় তিরিশ ফুট উচ্চতার ঊনকোটিশ্বর কালভৈরবের মুখাবয়বটি দেখে। মহাদেবের মাথার দু'-দিকে ফোয়ারা আকৃতির জটা, কপালে সাতটি পুর্ণচন্দ্র, দুই কানে বিশালকায় দু'টি কর্ণকুণ্ডল। এছাড়াও ঘন সবুজে ঘেরা শান্ত, নির্জন পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা আছে অজস্র দেবদেবীর মূর্তি। এছাড়াও অনেক পাহাড়ের গায়ে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর সব মুখাবয়ব। অধিকাংশই যদিও দেবাদিদেব মহাদেবের। এছাড়াও গণেশকুণ্ড সংলগ্ন পাথরে খোদাই করা আছে তিনটি অপূর্ব সুন্দর গণেশমূর্তি। গণেশমূর্তিগুলির পাশেই রয়েছে বিষ্ণুদেবের মূর্তি। এছাড়াও সেখানে গেলে আপনি দেখতে পাবেন মা দুর্গা, রাম, রাবণ, হনুমানের মূর্তি। কালের বিবর্তনে বেশ কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও বেশির ভাগই এখনও অক্ষত রয়েছে।

ঊনকোটিশ্বর কালভৈরব

ঊনকোটির নামকরণ নিয়ে স্থানীয় অঞ্চলে দু'টি লোককথা প্রচলিত আছে। প্রথমত মনে করা হয়, একবার মহাদেব-সহ এক কোটি দেবদেবী কাশীর উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেই যাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। যাত্রা করতে করতে ত্রিপুরার রঘুনন্দন পাহাড়ে যখন তাঁরা পৌঁছন তখন রাত নেমে গেছে চারিদিকে। রঘুনন্দন পাহাড়ে পৌঁছনোর পর, এখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মহাদেব। কারণ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন দেবদেবীরা। সন্ধ্যাবেলায় দেবদেবীদের ডেকে পরদিন ভোরে যাত্রা শুরুর নির্দিষ্ট সময়ও বলে দিয়েছিলেন মহাদেব। কিন্তু দেব-দেবীদের কেউই নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারেননি। পথশ্রমের প্রবল ক্লান্তিতে সবাই ছিলেন গভীর নিদ্রায় আছন্ন। ফলত রুষ্ট হয়েছিলেন মহাদেব। বাধ্য হয়ে একাই কাশীর পথে রওনা দেন দেবাদিদেব মহাদেব। তবে যাওয়ার আগে তিনি অভিশাপ দিয়ে যান যে, নিদ্রারত সকল দেব-দেবী ওখানেই পাথরের মূর্তি রূপে আজীবন বিরাজ করবেন। মহাকালের অভিশাপে সেই ভোরে রঘুনন্দন পাহাড়ে আসা এক কোটি দেবতার মধ্যে, ৯৯ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৯৯ দেবদেবীই পরিণত হয়েছিলেন পাথরের মূর্তিতে। একমাত্র মহাদেব এগিয়ে গিয়েছিলেন কাশীর দিকে। সেইদিন থেকে জায়গাটির নাম হয়ে গিয়েছিল ঊনকোটি।

গণেশকুণ্ড সংলগ্ন পাথরে খোদাই করা গণেশমূর্তি

দ্বিতীয়ত যে কাহিনি প্রচলিত, সেটি কালু কামার-কে নিয়ে। তিনি ছিলেন শিব ও পার্বতীর বড় ভক্ত। জোয়ান বয়সেই সংসার ছেড়ে রঘুনন্দন পাহাড়ে বসে শিব-পার্বতীর তপস্যা করতে শুরু করেন কালু। শিব-পার্বতীর এই ভক্তের খুব ইচ্ছে ছিল যে, সে তার আরাধ্য ভগবানের সঙ্গে কৈলাসেই থাকে। কালু কুমোরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দেন ভগবান শিব ও মাতা পার্বতী। সঙ্গে সঙ্গে কালু কৈলাসে থাকার আবদার ধরে। মাতা পার্বতীও সে ব্যাপারে সম্মতি দেন। কিন্তু, বেঁকে বসেন মহাদেব। যত বড় ভক্তই হোক না কেন মর্ত্যলোকের বাসিন্দাকে তো আর কৈলাসে থাকার অনুমতি দেওয়া যায় না! ভোলেনাথ কালুকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে কৈলাস মানুষের জন্য নয়, সে স্থান একান্তই দেবদেবীদের। কালুর প্রবল জেদ দেখে মাতা পার্বতী-ও মহাদেবকে অনুরোধ করেন কালুকে কৈলাসে থাকতে দেওয়ার জন্য। এরপর কালু কামারকে একটি কঠিন শর্ত দেন মহাদেব। তিনি কালুকে বলেন, তার ইচ্ছে তখনই পূরণ হবে যদি সে এক রাতের মধ্যে এক কোটি দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করতে পারে। মন-প্রাণ দিয়ে সেই সন্ধ্যাতেই রঘুনন্দন পাহাড়ের পাথর কাটতে শুরু করেছিলেন কালু। কেটে যাচ্ছিল প্রহরের পর প্রহর। নিদ্রাহীন কালুর ছেনি হাতুড়ির আঘাতে রঘুনন্দন পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠছিল ভগবান শিব, মাতা পার্বতী-সহ একের পর এক দেবদেবীর অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্য। তবে মহাদেবের মায়াই হোক বা ক্লান্তির কারণেই হোক অসম্ভব চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে কালু কামারের। বহু চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে না পেরে ঘুমিয়ে পরে সে। পরদিন সকালবেলা মহাদেব গুণে দেখেন যে, আর একটি মূর্তি তৈরি করতে পারলেই কালুর কৈলাস যাওয়া নিশ্চিত ছিল। অর্থাৎ, এক কোটির চাইতে একটি কম মূর্তি তৈরি করেছিল কালু। সেই থেকে এই স্থানের নাম ‘ঊনকোটি’।

অবাক করার মতো বিষয় হলো এই অপূর্ব সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করা কালু কামারের সম্বন্ধে ইতিহাসে কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায় না। কালু কামার বাস্তবেই ছিলেন না কোন কাল্পনিক চরিত্র সেই নিয়েও ধন্দ রয়েছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। ঐতিহাসিকদের মতে, ঊনকোটির এই ভাস্কর্যগুলোর সৃষ্টি অষ্টম অথবা নবম শতকে। সেই সময়ে ত্রিপুরার শাসক ছিলেন হিন্দু ফা রাজারা। তারা শৈব ছিলেন, সুতরাং হতেই পারে যে তারা এই শিল্পকর্মটি নির্মাণ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে কোনো উল্লেখ নেই কোন ঐতিহাসিক দস্তাবেজে। ইতিহাস কেন যে এই অনবদ্য রক আর্টের প্রতি এতটা নিষ্ঠুর সেই কারণ জানা নেই। এই উপেক্ষার কারণেই আজও অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ হয়ে নিজের বুকে অসাধারণ সুন্দর শিল্পকলা নিয়ে বেঁচে আছে ঊনকোটি।

More Articles