গোরস্থানে অজানা এক 'মা'-এর কবর ঘিরে আজও দানা বেঁধে রয়েছে রহস্য

কবরখানার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন না। পুরনো নথি ঘেঁটেও এই মহিলার ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। তবে লোকমুখে শোনা যায় যে, এটাই এখানকার একমাত্র বেনামী কবর নয়।

 

'গোরস্থানে সাবধান'-এ সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় ঢুকতে গিয়ে লালমোহনবাবু বলেছিলেন, "ছোটবেলায় মেজজ্যাঠা বুঝিয়েছিলেন ওটাকে বলে গোরস্থান কারণ ওখানে গোরাদের সমাধি আছে। এখন মনে হচ্ছে নামটা হওয়া উচিৎ গেরোস্থান। এমন গেরোয় পড়েছি কখনও আগে?" লালমোহনবাবুর মেজজ্যাঠার গোরস্থানের নামের ব্যাখ্যার বিচার না করলেও অনেকেই জানেন যে, সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানার একটি কবরের ফলকে সত্যি গেরো রয়েছে।

Gorosthane Sabdhan

'গোরস্থানে সাবধান' গল্পের একটি অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়



প্রায় তিনশো বছরের পুরনো আর্কিওলজিক‍্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া দ্বারা সংরক্ষিত এই সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানা। সেখানে প্রায় দুই হাজারের বেশি কবর রয়েছে। যদিও সেই দু'হাজারের মধ্যে ধাঁধার মতো লুকিয়ে একটি কবর। কবরখানায় ঢুকে সোজা গিয়ে বাঁদিকে একটু এগোলেই একটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেই ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ৩৬৩ নম্বর কবর। উইলিয়াম জোনস, হিন্দু স্টুয়ার্ট অথবা ডিরোজিওর কবরের মতো সাজানো না। খুবই সাদামাটা এবং যত্নের অভাব লক্ষ করা যায়। এই কবরের বিশেষত্ব রয়েছে তার ফলকে। নামের বদলে লেখা রয়েছে 'এ ভারচুয়াস মাদার।' এই ফলকে শুধু নাম নয়, মানুষটার জন্মসাল সম্পর্কেও কিছু লেখা নেই। শুধু রয়েছে একটা মৃত্যুসাল, ১৮২৫। কালের প্রকোপে এবং যত্নের অভাবে সেই ফলক প্রায় ভেঙে গিয়েছে, কিন্তু এখনও আবছাভাবে লেখাটা পড়া যায়।

সাধারণত প্রথমবার দেখে এই ফলকের গুরুত্ব বোঝা যায় না। মানুষের মনে হতেই পারে যে, ফলকে নাম না থাকাটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। একটু তলিয়ে ভাবলে এখানেই ফেলুদার মতো যে কারও মাথায় তিনটে খটকা লাগবে। প্রথমত, এই একটা কবর বাদে বাকি সব কবরেই নাম লেখা রয়েছে। কিছু কবরের ফলক ভেঙে গেলেও তাতে নাম ছিল। তাহলে এই কবরে নেই কেন? দ্বিতীয়ত, 'ভার্চুয়াস মাদার' থেকে প্রমাণিত হয় যে, কবরটি কোনও মহিলার। এই কবরখানায় বাকি যত মহিলার কবর রয়েছে, সব জায়গায় তাদের কারও স্ত্রী অথবা মেয়ে হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের স্বামী অথবা বাবার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র এই একটিমাত্র কবরে স্ত্রী অথবা মেয়ে না, মহিলাকে মা বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি এই মহিলা সেই সময়ের সমাজের বিশেষ কেউ ছিলেন? তৃতীয়ত, এই কবরখানায় যখন কবর দেওয়া হতো, তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে এবং কলকাতা তাদের রাজধানী। এই কবরখানায় কেবলমাত্র ব্রিটিশদের কবর দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের কবরে তাঁদের পরিচয় ফলাও করে বলা থাকলেও এই মহিলা অথবা তাঁর পরিবার এই মহিলার পরিচয় কেন গোপন করেছিলেন? এই মহিলা কি এমন কিছু করেছিলেন, যার ফলে পরবর্তীকালে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

আরও পড়ুন: এশিয়ার একমাত্র গ্রিক কবরস্থান আছে কলকাতাতেই! অনাদরের ইতিহাস চোখে জল আনবে

প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তর কারও কাছেই নেই। জ্ঞানী গুগল এখানে খুব সহজেই হার মেনে নিয়েছে। কবরখানার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন না। পুরনো নথি ঘেঁটেও এই মহিলার ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। তবে লোকমুখে শোনা যায় যে, এটাই এখানকার একমাত্র বেনামী কবর নয়।

প্রাচীন কলকাতার এই এলাকায় জঙ্গল ছিল এবং সেই জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে যে, এই এলাকায় অনেক মানুষ বাঘের পেটে গিয়েছিল। সেই সময় এই এলাকায় বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়া অনেক মানুষেরই আধখাওয়া দেহ উদ্ধার হয়েছিল। সেই দেহের মধ্যে যেগুলো শনাক্ত করা যেত না, সেগুলো ওই জঙ্গলের মধ্যে বেনামী কবর দিয়ে দেওয়া হতো। এই এলাকায় যে জঙ্গল এবং বাঘ ছিল সেই তথ্যের সমর্থন পুরনো নথি থেকে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, শিয়ালদহ এলাকায় মাটি খুঁড়তে গিয়ে মাটির নিচে অনেকগুলো সুন্দরী গাছের অংশ পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন কলকাতার বাঘের নামের সঙ্গে শুধু এই এলাকা নয়, চৌরঙ্গী এলাকার নাম জুড়ে গিয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় যে, সন্ধের পর চৌরঙ্গী এলাকার জঙ্গলে বাঘের ডাক শোনা যেত। বাঘ ছাড়াও বুনো মোষ, হায়না, নেকড়ে, বাঘরোল এক সময় কলকাতার বুকের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াত। বাঘ, হায়না, বাঘরোল অথবা বুনো মোষের জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসার বহু ঘটনা শোনা যায়, যার মধ্যে বাগবাজারে রবার্ট ক্লাইভের সেনার ওপর বুনো মোষের দলের আক্রমণ খুবই পরিচিত একটা ঘটনা।

কলকাতা আজ আধুনিক হয়েছে। প্রাকৃতিক জঙ্গল ছেড়ে সে কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে। মাটির ওপর এবং নিচের খোলনলচে পাল্টে ফেলে সে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবুও কলকাতার আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে এইরকম না-জানা অনেককিছুই, যা পুরনো কলকাতার অজানা গল্প নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে।

More Articles