যুদ্ধ থেকে বর্ণবিদ্বেষী হিংসা—৭৬ টাকায় অন্তর্জলী যাত্রায় জলদানব

বছর ষাটেক আগের কথা। তখনও যুদ্ধ চলছে। আমেরিকার সঙ্গে ভিয়েতনাম। ওইটুকু একটা দেশ গিলে খেতে গিয়ে আমেরিকার তখন বিষম লেগে গিয়েছে জোর। আজ যেমন রাশিয়ায় মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে, তেমনই সেদিন দলে দলে আমেরিকান যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। ডিলান, বায়েজ গান বেঁধেছিলেন আমেরিকার আগ্রাসী সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। প্রচুর আমেরিকার সৈন্য যুদ্ধাহুতি দিয়েও আমেরিকা ক্ষান্ত হচ্ছে না তখন। সেই সৈন্যদের দেশে ফেরানোর জন্য বিক্ষুব্ধ পরিবার পরিজন রাস্তায় নামছেন। সেসময় আমেরিকার থেকে বহুদূরে ভিয়েতনামের তীরে ভাসছিল এক বিরাট যুদ্ধজাহাজ। নাম তার কিটি হক। এই জাহাজ থেকে দিনে প্রায় শতখানেক ছোট ছোট বিমান উড়ে যেত ভিয়েতনামের উপর চক্কর কাটতে। তখন ইয়্যাঙ্কি স্টেশন আমেরিকানদের শক্ত ঘাঁটি। দক্ষিণ চিন সাগরের এই অংশ দিয়ে আমেরিকার নৌবাহিনী উত্তরের ভিয়েতনামি ও ভিয়েত কং সেনাকে আক্রমণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আমেরিকা।

জাহাজটিকে এবং তার বিমানবাহিনীকে পরে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ইউনিট সাইটেশন’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৭র ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৮র জুন পর্যন্ত আমেরিকান এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামি সেনাদের মদত জোগানোর জন্যই সম্মানিত করা হয় তাকে। কিন্তু এই ‘সম্মানীয়’ জাহাজের ইতিহাসের সবটা বলা হয় না। জনমানস থেকে নিজেদের যাবতীয় কুকীর্তির স্মৃতি মুছে ফেলতে নব্যসাম্রাজ্যবাদের জুড়ি নেই। কাজেই আমেরিকার পরমাণু বোমা নিক্ষেপও ‘পার্ল হার্বারে’র জবাব হিসেব যথার্থ হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনই কিছু কিছু ঘটনা চেপে দেওয়া হয়। ১৯৭২-এ কিটি হকের শেষ অভিযান। সেই অভিযানের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু ঘটনা যাকে আমেরিকান কংগ্রেসের তৎকালীন তদন্তকারীরা ‘নৌসেনার ইতিহাসে দুঃখজনক ঘটনা” বলেই দায় ঝেড়ে ফেলছেন। এই ‘দুঃখজনক’ মোড়কটা একটু খুললে আমেরিকার বহুদিনের বর্ণবিদ্বেষী চেহারাটি বেরিয়ে আসে। সে ভয় তদন্তকারীদের ছিল যথেষ্ট। একটু পরেই সে বিষয়ে প্রমাণ দেওয়া যাবে। আপাতত প্রশ্ন, কী এমন হয়েছিল সেই দিন?

দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত সেনাদের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল দাঙ্গা একচোট। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার আনন্দে ফুরফুরে সবাই। ইতিমধ্যে ফিলিপিন্সের বন্দরে একটি ফোনকল। খবর এল বাড়ি ফেরা হচ্ছে না। নিয়োগকাল বাড়িয়ে দেওয়ার হুকুম এসেছে। অন্তত ইতিহাসের নথি ঘেঁটে তেমনটাই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে শ্রান্ত, হতাশ সেনাদের মধ্যে ফেটে পড়ার সম্ভাবনা একটা তৈরি হচ্ছিল। বর্ণবিদ্বেষজাতীয় বারুদ তো মজুদ ছিলই। ক্লান্ত হতাশ মানুষের থেকে সৎ আর কেউ নয়। যাবতীয় ঢেকে রাখা ভদ্রতার মুখোশ তখন খসে পড়তে থাকে। নানান দ্বন্দ্ব আরো জোরদার হয়। সেই দ্বন্দ্বেই ধুয়ো দিল একটা ছোট্ট মনোমালিন্য। ঠিক কী হয়েছিল তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। কেউ বলেন নতুন অভিযানে পাড়ি দেওয়ার ঠিক আগের রাতে ফিলিপিন্সের বারে ঘটে যাওয়া একটা ঝামেলার তদন্তে কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকদের তলব করা হয়েছিল। তার থেকেই নাকি দাঙ্গার শুরু। আবার অনেকে বলেন কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে এক নাবিককে তার প্রাপ্য স্যন্ডুইচ দেওয়া হয়নি। ঠিক তার পরেই একজন শ্বেতাঙ্গ স্যান্ডুইচ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে খাবার দেওয়া হয়। এই বৈষম্যের ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যরা। এ কথা ও কথায় হাতাহাতি থেকে মুহূর্তে দাঙ্গা লেগে যায়। নোটর ডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ডেভিড কোর্টরাইট লিখছেন, "হাতাহাতি জাহাজ জুড়ে ছড়িয়ে পরে দ্রুত। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গরা পরস্পরকে রেঞ্চ, চেইন, পাইপ বা কিছু কিছু না পেলে খালি হাতেই আক্রমণ করছে।" 

সে সময় কিটি হকের ৪৫০০জন জাহাজীর মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। কংগ্রেসের রিপোর্ট বলছে অক্টোবর বারো কি তেরো, ১৯৭২এর সেই ঘটনায় আহত হয়েছিল জনা সাতচল্লিশেক মানুষ। তাদের মধ্যে মাত্র ৬-৭ জন শ্বেতাঙ্গ।  বর্ণবিদ্বেষের শিকড় যে কতদূর তা এই ঘটনার বিচারের সময় আরো পরিষ্কার হয়। আমেরিকান কংগ্রেসের তদন্তের ভিত্তিতে সেনাদলের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের চূড়ান্ত অবস্থাটি খতিয়ে দেখতে গিয়ে সাবকমিটি যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে বলা হয়, “সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে সাবকমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সে রাতে হাতে গোনা কয়েকজন মাথামোটা ব্যক্তি এই বিনা প্ররোচনায় আচমকা এই আক্রমণ শুরু করে। এদের বেশিরভাগই বৎসরাধিক সময় ধরে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। বলাবাহুল্য, সবকটিই কৃষাঙ্গ। এই দলটির গুণ্ডাগিরি আমাদের একটা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা কি আদৌ আমেরিকার সেনাদলে সুযোগ পাওয়ার যোগ্য?” একটা সরকারি তদন্ত সংস্থার রিপোর্ট, তার এই ভাষা। অনুমান করা যায় সে সময় ‘অতি সুসভ্য সুশিক্ষিত আধুনিক’ আমেরিকার সমাজের অবস্থাটা কী ছিল! ডিসেম্বর ৩১, ২০২০-র নথি অনুযায়ী এখনও আমেরিকার সেনাদলে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা ১৭.৬%।

সময় বয়ে চলে। ক্ষমতার ঔদ্ধত্যকে ইতিহাস ক্ষমা করে না। মানুষ ক্ষমা করে না। তাই তাকে ভুলিয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়। ‘জনতা’র স্মৃতি বড় দুর্বল। কিন্তু গত পনেরো তারিখ এই পুরনো খ্যাতি-কুখ্যাতির গল্প আরেকবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। জনমানসের স্মৃতি থেকে কিটি হক মুছে গিয়েছে সত্য। মুছে গিয়েছে তার বর্বরোচিত আক্রমণ, বর্ণবিদ্বেষ। একদা ইন্দো-পেসিফিকে আমেরিকার সেনাবলের বৃহত্তম প্রতিভূ সেই যন্ত্রদানব আজ থুরথুরে বুড়ো। কালের বিচারে গত ১৫ মার্চ নীরবে নিজের মৃত্যুদণ্ডের পথে পাড়ি জমিয়েছে কিটি হক। ১৬০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে ওয়াশিংটন থেকে টেক্সাস। সেখানে তাকে টুকরো টুকরো করে স্ক্র্যাপ করা হবে। বাতিল তালগোল পাকানো যন্ত্রাংশের ভিড়ে ইতস্তত পড়ে থাকবে তার ছিন্নভিন্ন দেহ। সর্বোপরি আমেরিকার নৌসেনা এক ডলারেরও কম মূল্যে দানবটিকে বেচে দিয়েছে টেক্সাসের ‘ইন্টারন্যাশনাল শিপব্রেকিং লিমিটেড অফ ব্রাউনসভিলে’র কাছে। ১০৪৭ ফুট লম্বা, ২৫২ ফুট চওড়া ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ইউনিট সাইটেশন’-এ সম্মানিত বাহনের ভবিতব্য এই! আয়রনি ছাড়া আর কীই বা। ক্ষমতার অভিশাপ বড়ই বিষময়।

More Articles