কৌতুকশিল্পী থেকে রাষ্ট্রনায়ক, দেশ না ছেড়ে মর্যাদারক্ষায় লড়ছেন জেলেনস্কি

"আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি, কিন্তু আমাদের এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে!", ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় থেকেই নিজের লক্ষ্য কার্যত স্থির করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞানগম্যি নিয়ে, একজন কৌতুকাভিনেতা থেকে সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্ট! সিদ্ধান্তে ভুরু কুঁচকেছিল খোদ তাঁর দেশেরই মানুষজন। আজ রাশিয়ার আক্রমণে যখন একেবারে ছিন্নভিন্ন অবস্থা ইউক্রেনের, ঠিক সেই সময় নতুন করে যেন আবির্ভাব হলো তাঁর। শুধু ইউক্রেনবাসীর কাছে নয়, গোটা বিশ্বের কাছে তিনি এখন শৌর্যের অপর নাম। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করে নয়, বরং সত্যিকারের একজন দেশ নায়কের ন্যায় মাতৃভূমিকে রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। দেশবাসীর মনোবল জোগাতে নিজেই নেমে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। এই অসম লড়াইয়ে ইউক্রেন জিতুক আর না জিতুক, এই দেশনায়কের হার-না-মানা মনোবল, অন্যান্য দেশনায়কদের কাছে হয়ে থাকবে একটি উদাহরণ। ইনি ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলদোমির জেলেনোস্কি।

২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলেনস্কি। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তাঁর কাছে না ছিল তেমন কোনো রাজনৈতিক দল, আর না ছিল কোন সঠিক উপদেশ দেওয়ার মতো মানুষ। কোন নির্বাচনী প্রচার বা কোন জনসভা, কোন জায়গাতেই তাঁকে এর আগে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেই তিনি চালিয়েছিলেন নিজের নির্বাচনী প্রচার। আর তাতেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পুরো ইউক্রেনকে। সেই দেশের দুর্নীতি এবং তথাকথিত রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন জেলেনস্কি। আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। এই জনপ্রিয়তাই তাঁকে রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরশেঙ্কোর বিরুদ্ধে ২০১৯ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে ইউক্রেনের সিংহাসনে আসীন হন জেলেনস্কি। কিন্তু, এই অভিনেতা থেকে নেতা হওয়ার জার্নিটায় রয়েছে একাধিক ধাপ।

আইনজীবী থেকে  কৌতুকশিল্পী

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের নিজস্ব ওয়েবসাইট অনুসারে, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে জন্ম হয় ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির। ইহুদি পিতা-মাতাঁর কাছে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর শিক্ষা গ্রহণ কিয়েভের ন্যাশনাল ইকোনোমিক ইউনিভার্সিটি থেকে। সেখানে তিনি আইনের উপরে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন। আইনজীবী হওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ থাকলেও, তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন থেকেই তাঁর থিয়েটারের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিল। ২০০০ সালে যখন তিনি স্নাতক হন, সেই সময় পুরোপুরিভাবে তিনি থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত একজন অভিনেতা, কৌতুক শিল্পী এবং স্ক্রিপ্ট লেখক হিসেবে কাজ করেন। তবে তাঁর মধ্যেই তিনি নিজেই স্ট্যান্ড আপ কমেডি প্রতিযোগিতাঁর একটি দল তৈরি করেন, যার নাম দেন Kvartal 95 (কোয়ার্টার ৯৫)। এই দলে তিনি প্রযোজকের ভূমিকা নির্বাহ করেছিলেন।

১৯৯৫ সালে তাঁর এই দল KVN এর ফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল। এই অনুষ্ঠানটি ছিল একটি গঠনমূলক কমেডি শো, যা কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটসের সমস্ত জায়গায় দেখানো হতো। ব্রিটানিকার মতে, এটি বিশ্বের সবথেকে ভালো কিছু কমেডি শো এর মধ্যে একটি ছিল। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন জেলেনস্কি এবং তাঁর দল কোয়ার্টার ৯৫। এই একই বছরেই জেলেনস্কি স্থাপন করেন তাঁর প্রযোজনা সংস্থা স্টুডিও কোয়ার্টার ৯৫। বছর কয়েকের মধ্যেই জেলেনস্কির সংস্থা হয়ে উঠেছিল গোটা ইউক্রেনের সবথেকে আলোচিত এবং সব থেকে সফল বিনোদন স্টুডিও। ২০১১ পর্যন্ত ওই স্টুডিওতে আর্টিস্টিক ডিরেক্টর হিসেবে নিজের পদ সামলেছিলেন জেলেনস্কি। এছাড়াও, ইউক্রেনের একটি টিভি চ্যানেলের প্রযোজক ছিলেন তিনি, যেটির নাম ছিল ইন্টার টিভি। ২০১২ সালে চ্যানেলের কাজ ছাড়ার পর ইউক্রেনের ১+১ নেটওয়ার্কের সঙ্গে একটি যুগ্ম প্রযোজনার কাজ শুরু করেন জেলেনস্কি। ওই একই বছর তাঁকে দেখা যায় ব্যাক-টু-ব্যাক দুটি সিনেমায়। প্রথমটি হলো জেভস্কি ভার্সেস নেপোলিয়ন এবং ৮ ফার্স্ট ডেটস। ২০১৫ সালে ৮ ফার্স্ট ডেটস ছবির সিক্যুয়েল নিয়ে আসেন তিনি, নাম দেন ৮ নিউ ডেটস।

রাজনীতিতে পদার্পণ

২০১২ সালে টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর ২০১৩ সালে আবারও আর্টিস্টিক ডিরেক্টর হিসেবে কোয়ার্টার ৯৫-তে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন জেলেনস্কি। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ইউক্রেনের রাজনীতিতে শুরু বিস্তর জলঘোলা। দেশের অসামরিক বিক্ষোভ যখন একেবারে তুঙ্গে, তখন সেই আন্দোলনে সকলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিলেন জেলেনস্কিও। সেখান থেকেই তাঁর ইউক্রেন রাজনীতিতে পদার্পণ। ২০১৪ সালে তৎকালীন রাশিয়া ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকারের পতন ঘটলে বিলিয়নিয়ার পেট্রো পরশেনকো নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। কিন্তু, নতুন গঠনের মাস কয়েকের মধ্যেই দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে ইউক্রেন। পূর্ব ইউক্রেনে একটি রাশিয়ান সমর্থিত বিদ্রোহ ঘোষণা হয় এবং সেই বিদ্রোহের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউক্রেনে। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে দেশটিতে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে থাকে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কোনমতে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই চালিয়ে যান, কিন্তু কোন লাভ হয় না।

তাঁরই মধ্যে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ১+১ চ্যানেলে টেলিকাস্ট করা হয় জেলেনস্কির 'সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল' টিভি-শোটি। ইতিহাসের শিক্ষক ভার্সিলি গলবোরডকো চরিত্রে জেলেনস্কির অভিনয় নজর কাড়ে দর্শকদের। মুহূর্তেই একজন ইন্টারনেট সেনসেশন হয়ে ওঠেন তিনি। ইউক্রেনের তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় কড়া মন্তব্য করে সোশ্যাল মিডিয়াতে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন জেলেনস্কি। এই শো-টি ছিল ইউক্রেনের তৎকালীন সময়ের সবথেকে বড় হিট শো এবং এই একটি শো জেলেনস্কিকে ইউক্রেন রাজনীতির অন্যতম মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেয়। ২০১৮ সালে কোয়ার্টার ৯৫ এবং জেলেনস্কি একসাথে গঠন করে একটি রাজনৈতিক দল, যার নাম রাখা হয় 'সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল'

প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে জেলেনস্কি

সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল ইউক্রেনের রাজনীতিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই পোরশেঙ্কোর রাজনৈতিক অবস্থান আরো খারাপ হতে শুরু করে। সারাদেশে তাঁর অনুমোদনের রেটিং চলে আসে ১-এ। ২০১৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ইউক্রেনের অর্থনীতি চলে আসে একেবারে তলানিতে। নির্বাচনে তিন ডজনেরও বেশি প্রার্থী নাম লেখান প্রেসিডেন্ট পদের জন্য। এর মধ্যেই একজন ছিলেন জেলেনস্কি। তিনি প্রথম থেকেই প্রেসিডেন্টের দৌড়ে ছিলেন অন্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। পোরশেঙ্কোর দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর আগেই ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে ১+১-এ নিজের সিদ্ধান্তের কথা এবং তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানিয়ে দেন জেলেনস্কি। তৎকালীন সময়ে ১+১ নেটওয়ার্কটির মালিক ছিলেন ইহর কলময়সকি। তিনি হলেন ইউক্রেনের অন্যতম একজন ধনী ব্যক্তি। কলময়সকির সাথে প্রথম থেকেই জেলেনস্কির সম্পর্ক ছিল ভাল। তাই তাঁকে নির্বাচনের প্রচারের জন্য সামান্য বিপাকে পড়তে হয়েছিল, কারণ এর আগে ওই বিলিয়নিয়ারের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ছিল।

তবে যাই হোক, ২০১৯ নির্বাচনে কলময়েস্কির সাথে সম্পর্কের জন্য খুব একটা সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি জেলেনস্কিকে। তাঁর বক্তৃতাগুলি ছিল বেশ স্বল্পদৈর্ঘ্যের এবং তিনি ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও, সরকারের পর্দাফাঁস করে দেওয়া বিভিন্ন বার্তা, তাঁকে জনমানসের মধ্যে জনপ্রিয়তা দেয়। তাঁরপরেই আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত ২১ এপ্রিল, ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ইউক্রেনের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেলেনস্কি।

ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেলেনস্কি

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগে কিয়েভের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পোরশেঙ্কো জেলেনস্কিকে রাজনৈতিক নবাগত হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। তিনি বোঝাতে চান, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা এবং দৃঢ়তা জেলেনস্কির নেই। ইউক্রেনের পূর্বপ্রান্তে ওই সময় থেকে একটি যুদ্ধ চলছিলই। তাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতির দাবি ছিল জেলেনস্কি কোনভাবেই ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। জনসাধারণ অবশ্য জেলেনস্কির সাথেই গিয়েছিলেন শেষমেষ।

তবে একজন কৌতুক অভিনেতা থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার যাত্রাটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। এমনকি তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করার আগেই, পুতিন পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মুক্তিকামী জনগণকে রাশিয়ান পাসপোর্ট দেওয়ার ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন। এটা ছিল জেলেনস্কির জন্য একটা বিশাল চাপ। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় জেলেনস্কি ফেসবুকে গিয়ে ইউক্রেনের নাগরিকত্ব প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেও, তাঁর সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল দলটি কোন আইন পাস করার ক্ষমতা রাখত না, কারণ ইউক্রেনের পার্লামেন্টে ওই দল কোন আসন দখল করতে পারেনি। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরেই তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ভার্গোভনা রাদা ওরফে সুপ্রিম কাউন্সিল ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইউক্রেনের সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন জেলেনস্কি এবং সার্ভেন্ট অফ দ্যা পিপল। ইউএসএসআর এর বিলুপ্তির পর ইউক্রেনে এই প্রথমবার কোন একক দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

মার্কিন বিতর্ক এবং জেলেনস্কি

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জীবনের সেকেন্ড ইনিংস শুরু করার পরেই বিশ্ব রাজনীতির সাথে হাত মেলাতে শুরু করেন জেলেনস্কি। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাপী একটি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জেলেনস্কি। সেসময়কার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া অভিযোগের তদন্ত করার জন্য জেলেনস্কি উপর চাপ তৈরি করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার জেরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য দেওয়া সহায়তাও আটকে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউক্রেনের এনার্জি কংগ্লোমারেট বুরিস্মা হোল্ডিংসে সেই সময় কাজ করতেন জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, জো বাইডেন তাঁর ছেলেকে সুবিধা পাইয়ে দেবার জন্য তাঁর অফিসকে ব্যবহার করছেন। যদিও এই অভিযোগের কোন ভিত্তি ছিল না।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা করেন জো বাইডেন। শোনা যায়, ২৫ জুলাই ২০১৯ ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির মধ্যে একটি ফোন কল হয় যেখানে, ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বাইডেন পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। এই ফোনকলটি বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি বিতর্কিত ফোন কল হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে এখনো। এই একটি ফোনকলের জন্যই মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের তরফ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর মাসে একটি তদন্ত কমিটি বসানো হয়। এই পুরো বিতর্কের মাঝেই বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ইউক্রেন। প্রথম থেকেই জো বাইডেনের কিছুটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তাই, এর পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে। এই মুহূর্তে আমেরিকার মসনদে জো বাইডেন। আর ঠিক এই সময়েই আক্রান্ত হয়েছে ইউক্রেন। জো বাইডেনের সঙ্গে, পুরনো হিসাব-কিতাবের কারণে হোক আর না হোক, ইউক্রেন হামলার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে 'জিনিয়াস' আখ্যা দিয়েছিলেন, যা বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিলেন জেলেনস্কি। এমনকি, পুতিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে সীমান্ত সংকট নিরশনের চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা স্পষ্টতই কাজ করেনি। স্থানীয় ইউক্রেনীয়রা নতুন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কিছু একটা 'অলৌকিক' আশা করেছিল। তবে, জেলেনস্কি শাসনের প্রায় তিন বছরের মধ্যে এরকমটা কিছু ঘটেনি। ইউক্রেনের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করা আনাতোলি রুদেনকো সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, "জেলেনস্কি যুদ্ধের অবসান এবং দুর্নীতিকে পরাস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেরকমটা কিছুই ঘটেনি। দাম বাড়ছে, দুর্নীতি এখনো কমেনি এবং আমরা আরও দরিদ্র জীবন যাপন করতে শুরু করেছি।" ইউক্রেনীয় অর্থনীতিবীদ তাতিয়ানা স্মিলেবা বলছেন, "অলৌকিক কিছু হয়নি বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করেছে।" মঙ্গলবার একটি টেলিভিশন ভাষণে জেলেনস্কি ঘোষণা করেছেন, ইউক্রেনকে রাশিয়ার এই আক্রমণের সামনে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছেড়ে দিয়ে সবাই সরে যাচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন জেলেনস্কি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা উদ্বিগ্ন যে, জেলেনস্কি যেহেতু একজন অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, তাই তাঁর পক্ষে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব একটা সহজ কাজ হবে না।

তবে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি এখনো দুর্গ ধরে রেখেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি ঘোষণা করেন, দেশের সমস্ত গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বাস করে তিনি রাশিয়ার এক নম্বর টার্গেট, এবং তাঁর পরিবার দ্বিতীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একাধিকবার তাঁকে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনভাবেই দেশের মানুষকে একা ফেলে যেতে চান না। তিনি যোগ করছেন, "আমরা কিয়েভে আছি। আমরা ইউক্রেনকে রক্ষা করার সমস্ত চেষ্টা করব। আমরা কোন অস্ত্র রাখবো না। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।"

রাজনীতিবিদ হিসেবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট অনেকটাই নবিশ হলেও, তাঁর মেধা এবং জনপ্রিয়তা তাঁকে রাষ্ট্রনায়কের সম্মান দিয়েছে। ইউক্রেন হামলার পর জেলেনস্কি বিনয়ের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, "আমাকে নিরাপদে সরানোর দরকার নেই, আমাদের দরকার অস্ত্র, গোলাবারুদ।" ইউক্রেনের সকলকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি নিজে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছেন। জেলেনস্কির এই সমস্ত কাজগুলি সাধারণ মানুষ দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে যেভাবে মানুষের মন জয় করেছিলেন তিনি, সেভাবেই প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তাঁর ভূমিকা দেশের মানুষের মন জিতে নেওয়ার মতো। কিন্তু মন জিতে নেওয়া আর যুদ্ধ জিতে নেওয়া এক না। বর্তমানে যেভাবে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আক্রমণ বাড়ছে, তাতে প্রেসিডেন্টের গদি বেশ টলোমলো অবস্থায়। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টই নাকি যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছেন। জেলেনস্কির পক্ষে তাঁর মসনদ সামলানো এখন যেন একটা চ্যালেঞ্জ। কী ভাবে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেন এই প্রাক্তন কৌতুকশিল্পী, সেটাই এখন দেখার।

More Articles