প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির দিকে আঙুল, সত্যিই কি চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন অভিষেক?

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি খ্যাতির পীঠস্থান। লাইমলাইটের ধাঁধা এমনই, তা সেই বৃত্তের বাইরের অংশটুকুকে আরো অন্ধকার করে তোলে। বিশেষত একই বৃত্তে যখন একাধিক জন ঢুকে পড়েন তখন খুব কম ক্ষেত্রেই তারা আলো ভাগ করে নিতে চান। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। আন্তর্জাতিক সিনেমার ক্ষেত্রটি যেহেতু পরিধিতে বিরাট, সেখানে এই ধাক্কার অভিঘাত খুব একটা বেশি থাকে না। অজস্র লাইমলাইট জুড়ে অজস্র ব্যক্তিকে দেখতে সেখানকার দর্শক ও খোদ অভিনেতারাও অভ্যস্ত। তাই আল প্যাচিনো–রবার্ট ডেনিরো নিজস্ব ক্ষেত্র তৈরি করে নেন, রেসারেসি থাকলেও আর্নল্ড ও স্ট্যালন নিজস্ব ফ্যানবেস তৈরি করেন, ব্রেকিং ব্যাড এবং ডেক্সটার প্রায় সমসাময়িক হলেও হই হই করে হিট করে, ক্র্যানস্টোন ও মাইকেল সি হল–কাউকেই ধাক্কাধাক্কি করতে হয় না। কিন্তু এই লাইমলাইটের পরিসর যত কমে ধাক্কাধাক্কির অভিঘাত তত বাড়ে। গত কয়েক বছর ধরেই নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের অভিযোগ ঝড় তুলছে ইন্ডাস্ট্রিতে। বহু বড় বড় তারকার চাপে গুঁড়িয়ে গিয়েছে বহু সম্ভাবনা–এমনটাই ছিল অভিযোগ। অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের এ সংক্রান্ত অভিযোগ কিন্তু আজকের নয়।

নানান সাক্ষাৎকারে বারবার বহু জায়গায় বহুভাবে অভিযোগ জানিয়েছিলেন অভিষেক। কিন্তু আঙুল যখন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে, সাধারণ ভাবেই মানুষ গা করেনি। কিছু বিচ্ছিন্ন বিতর্ক হয়েছিল। তুলনামূলক ভাবে ঋতুপর্ণা বেশি বিদ্ধ হয়েছিলেন সমালোচনায়। তাই হয়। পুরুষ তারকার বিচ্যুতি ততটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, যতটা ওই অবস্থানে থাকা একজন নারীর। তাঁকে বিদ্ধ করার অপেক্ষায় থাকে মানুষ। অভিষেক মারা যাওয়ার পর আবার সেই বিতর্কে ঘি পড়েছে। আবারও, সেই একই সমালোচনার সুর দেখা যাচ্ছে সমাজ মাধ্যমে। 

প্রসঙ্গত শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের নেওয়া একটি ইন্টারভিউতে হিরো হিসেবে অভিষেককে আর দেখা গেল না কেন—প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক সরাসরিই বলেন,  “তোদের খুব প্রিয় ‘দাদা’ আর ‘দিদি’, টপ হিরো আর টপ হিরোইন, তারা দু’জন জোট বেঁধে আমাকে যে কত ছবি থেকে বাদ দিয়েছে… আমার সাইন করা বারো থেকে চোদ্দ খানা ছবি থেকে বাদ দিয়েছে… নতুন ভাবা ছবি মিলিয়ে কুড়ি বাইশ খানা ছবি থেকে বাদ দিয়েছে। টানা বাদ দিয়েছে। আমি অভিষেক চ্যাটার্জি, তখন অলমোস্ট নম্বর ওয়ান স্টার, হঠাৎ দেখল, তার হাতে একটাও কাজ নেই। আমি টানা এক বছর বাড়ির বাইরে বেরোইনি। লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে তার থেকে পয়সা বার করে আমায় খেতে হয়েছিল।’

আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম ধরেই বলেন, “প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ‘৯৭-’৯৮ সালে এরা জোট বেঁধে প্রায় ৩০-৩২টা ছবি থেকে আমাকে বাদ দিয়েছিল। সে সময়ে আমিই টলিউডে এক নম্বর। প্রায় এক বছর আমার কোনও কাজ ছিল না। বসে থেকে থেকে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। বছর দুয়েক পরে যাত্রায় যোগ দিলাম। তার পরই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন শুনেছি, লোকে বলছে, ‘অভিষেক তো ফুরিয়ে গিয়েছে’। এ সব শুনে কষ্ট হত। কিন্তু আমি প্রত্যয়ী ছিলাম’।”

বর্তমানে আবার বেশ কয়েক ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে এই বিতর্ক ঘিরে। টলিউডের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব অভিষেকের বক্তব্য সমর্থন করেছেন। ‘নোংরামি’ সামনে আসার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু আবার বিপরীত মতও রয়েছে। এতদিন এ সব ঘটনা নিয়ে এতখানি তোলপাড় হয়নি কেন? কেন মারা যাওয়ার পরেই এইসব বিতর্ক ভাঙিয়ে লাইমলাইটে থাকতে চান কিছু মানুষ সেই নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রসেনজিৎ ভক্তরা। এককালের সেরা দুই বন্ধুর মধ্যে আদতে কী ঘটেছিল? অভিষেকের বিয়েতে বরকর্তা হয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। তাঁর নির্দেশিত প্রথম ছবি ‘আমি সেই মেয়ে’-তে ঋতুপর্ণার সঙ্গে অভিনয়ও করেন অভিষেক। এ বাংলা ও বাংলা মিলিয়ে তুমুল হিট হয়েছিল ছবি। তবে হঠাৎ কী এমন হল?

যেটুকু জানা যায়, ঋতুপর্ণা সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন অভিষেক। যা ঋতুপর্ণার একেবারেই পছন্দ হয়নি। ঋতুপর্ণা সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলিকে মিথ্যে বলে দাবি করেছিলেন। ঠিক তার পরপরই একের পর এক ছবি থেকে বাদ পড়তে থাকেন অভিষেক। অনেকেই মনে করেন, সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রসেনজিৎ তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো অভিষেকের অকপট সোজাসাপটা কথাবার্তাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল চোখ ধাঁধানো ভাবমূর্তিতে বিশ্বাসী স্টারেদের কাছে।

অভিষেকের মৃত্যুতে তেমনভাবে উল্লেখযোগ্য কোনও মন্তব্যই করেননি প্রসেনজিৎ। বলেছেন একের পর এক অনেক মৃত্যু দেখছেন, অভিষেকের ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন না তিনি। ওঁর সঙ্গে যা কিছু ভালো স্মৃতি, তাই মনে রাখতে চাইছেন। বরকর্তা হওয়ার ব্যাপারটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। ঋতুপর্ণা কিন্তু বিস্তৃত মন্তব্য করেছেন। জানিয়েছেন তাঁর প্রথম সুপারস্টার হওয়া ‘সুজন সখী’ ছবিতে অভিষেকের সঙ্গেই। অকপটে স্বীকার করেছেন যে ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, ‘দহন’, সেখানেও অভিষেক ছিলেন। এমনকি অভিষেক ঋতুপর্ণর কাছে অনেক সুখ্যাতি করেছিলেন ঋতুপর্ণার। সেইসব নিয়ে অভিষেকের সঙ্গে নিজের সুখস্মৃতিগুলি বারবার মনে করেছেন। অভিষেক কী মাপের অভিনেতা ছিলেন, বাংলা সিনেমার জগতে তাঁর স্থান কোথায়–এ নিয়েও নিজের মতামত দিয়েছেন অভিনেত্রী। অভিষেকের বন্ধুত্ব তাঁর কাছে পরম প্রাপ্তি ছিল বলেই জানিয়েছেন বারবার। আবার পাশাপাশি এও জানিয়েছেন, না পাওয়ার, বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ অভিষেকের মধ্যে ছিল। ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিল তাঁদের মধ্যে। কিন্তু তা আর মিটিয়ে নেওয়া হয়নি। অভিমানে দূরে সরে গিয়েছিলেন অভিষেক। অভিষেকের সেই ব্যাথা নিয়ে ঋতুপর্ণা নিজেও আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু অভিষেকের মৃত্যুর পর। এইমাত্র। বেঁচে থাকতে এসব শোনার সুযোগ পাননি অভিষেক। তবু বন্ধুর জন্যে এতগুলি কথা অকপটে বলেছেন অভিনেত্রী। তাঁর সেই বক্তব্যের নিচে যথারীতি তাঁকে বিদ্রুপ করা শুরু হয়েছে।

অথচ প্রসেনজিৎ, যিনি এককালীন প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে তেমন কোনও মন্তব্যই করতে চাইলেন না মানুষটা মারা যাওয়ার পরেও, তাঁর সমালোচনা কোনও মতেই মেনে নিচ্ছেন না ভক্তেরা। আদতে এও এক প্রহসন। লক্ষণীয়, অভিযুক্ত কেউই কিন্তু সরাসরি অভিষেকের অভিযোগকে নস্যাৎ করেননি। উপরন্তু মনোমালিন্যের ঘটনাকে পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে স্বীকার করে নিয়েছেন। মানুষের আদালতে কে কী বিচার পাবেন, তা মানুষই ঠিক করবে। তবে বিচার করার ঝোঁকে আমরা যেন রক্তের স্বাদে অভ্যস্ত না হয়ে পড়ি, সে দায়িত্বও আমাদের উপরই বর্তায়।

More Articles