বিদেশের চাকরি ছেড়ে রোগীর সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন 'এক টাকার ডাক্তার'

গত এপ্রিল মাসে তিনি একবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময় বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল তাঁর চেম্বার। পরে সুস্থ হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে তাঁর বেশি সময় লাগেনি।

 

চিকিৎসকদের আন্দোলনের পাশে থেকেছেন, কিন্তু পরিষেবা চালিয়ে গিয়ে আদর্শ কাকে বলে, বুঝিয়ে দিয়েছেন `এক টাকার ডাক্তার’। তাঁর গোটা জীবন যেন একটা আদর্শে গড়া উপন্যাস। যার পরতে পরতে রয়েছে কান মুলে দিয়ে ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের রোগ নিরাময়ের পাঠ। করোনা থেকে সেরে উঠেই নেমেছিলেন সেবা-র মহান যজ্ঞে (যাতে বেশিদিন বন্ধ না থাকে পরিষেবা)। তাই জীবন দিয়ে যে আদর্শের পাঠশালা তৈরি করে গেছেন, আজ তা হারিয়ে সর্বহারা বীরভূম, গোটা বাংলাও বটে। কারণ তিনি শুধু চিকিৎসক নন, ছিলেন গরিব মানুষের মসিহা।

'এক টাকার ডাক্তার’ নামেই চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনে বীরভূম তো বটেই, সারা দেশ। বহু বিশিষ্ট জনের চিকিৎসা করেছেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন তিনি। পেয়েছেন পদ্মশ্রী। মানুষের ভরসার নাম 'এক টাকার ডাক্তার’। তাই হয়তো পুরস্কার তাঁর জীবনে শুধুই নিয়মরক্ষা। এক ব্যাগ কিংবা তার বেশিই পুরস্কার পেয়েছেন কাজের খাতিরে, কিন্তু তার বিপুল কর্মকাণ্ড এবং উদারতার দৃষ্টান্তের পাশে তা কখনই দৈর্ঘ্যে ও উচ্চতায় বড় হয়ে যায়নি কোনওদিনই।

গোটা চিকিৎসা পরিষেবাকে অসহায় করে দিয়ে চলে গেলেন চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের সেবা যাঁর আশ্রয়, সেই মানুষটি এক সময় বোলপুরের বিধায়কও ছিলেন। শুধু বোলপুর নয়, সারা দেশ তাঁকে চেনে 'এক টাকার ডাক্তার’ বলে। জিনিসপত্রর দাম আকাশছোঁয়া। ডাক্তার দেখাতে শহরে ও গ্রামে নাভিঃশ্বাস ওঠে মানুষের। এই দেশে বিনা চিকিৎসায় মারা যান বহু মানুষ। তখন দিনের পর দিন এক টাকায় গরিব মানুষের চিকিৎসা করে গেছেন ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়।

২০২০ সালে দেশের যে ১০২ জন পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন, তাঁরা কোনও না কোনওভাবে নজির সৃষ্টি করার জন্যই এমন রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত হন। এমনই ১০২ জন পদ্মশ্রী প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন বীরভূমের চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সম্মান দিয়ে রাষ্ট্র তাঁর বন্দনা নয়, তাঁর সামনে মাথা নত করেছে। কারণ তিনি গরিবের ত্রাতা। জীবনভর গরিবের সুশ্রুষা করে যাওয়া এই ডাক্তারের ব্যাগে রয়ে যাওয়া অনন্য সম্মানের নাম মানুষের ভক্তি ও ভালবাসা।

৮৪ বছরের বার্ধক্যও তাঁকে কাবু করতে পারেনি, কারণ তিনি ডাক্তারি পরিষেবা থেকে সরে আসেননি কোনওদিনই। অসুস্থতা নিয়েও কাজ চালিয়ে গেছেন। কোনওদিনই ফিরে তাকাননি লোভনীয় কেরিয়ারের হাতছানির দিকে। ঝকঝকে কেরিয়ার আর চকচকে বেঁচে থাকাকে একপাশে রেখে আজীবন এক টাকায় রোগী দেখে গেছেন বোলপুরের 'রাজপুত্র’। তিনি গ্র্যাজুয়েট হন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যাথোলজিতে পিজি। এরপর লন্ডন থেকে হেমাটোলজিতে ডিপ্লোমা করেন। ফলে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, যে তাঁর সামনে ছিল ঝকঝকে কেরিয়ারের প্রলোভন। কিন্তু তিনি সেই ডাকে সাড়া দেননি। বোলপুরের হরগৌরী তলায় তাঁর বাড়ি। গরিব মানুষের সেবার আদর্শ নিয়ে লন্ডন থেকে ফিরে আসেন সেখানে। হঠাৎই একদিন বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ফিরতে হল গ্রামে। চোখের সামনে তখন গ্রামের মানুষের দুর্দশা। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন ইংল্যান্ডের হাসপাতালে ১৬,০০০ পাউন্ডের চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে ফিরে আসবেন। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। ফিরে এলেন বাংলার মাটিতে। কেন তাঁকে এক টাকার ডাক্তার বলে লোকে? একবার হেসে বলেছিলেন, "প্রথম প্রথম সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে রোগী দেখতাম। একদিন পথে দেখি হতদরিদ্র কতগুলি মানুষ তপ্ত রোদে গামছা পেতে বসে মুড়ি খাচ্ছেন। তখনই ঠিক করি, এঁদের কাছ থেকে এক টাকার বেশি অর্থ নেওয়া যাবে না।"

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং থেকে শুরু করে প্রতিভা পাতিল, প্রণব মুখোপাধ্যায়, রামনাথ কোবিন্দ হয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যভার সামলেছেন তিনি। নাম রয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও। ২০২০ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী। পেয়েছেন স্বর্ণপদকও। পদ্মশ্রী পাওয়ার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, "পুরস্কার পেয়ে আমি খুশি ঠিকই, তবে মানুষের পাশে থাকা প্রতিটি সুনাগরিকের দায়িত্ব। এই জগতে মানুষ কষ্ট পায়, কারণ ভালো লোকরা এগিয়ে আসেন না, নীরব থাকেন। তাই মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো একজন সত্যিকারের মানুষের পরিচয়।" গরিব রোগীদের উৎসর্গ করেন এই সম্মান।

ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় কেবলমাত্র এক টাকায় চিকিৎসা পরিষেবা দিয়েছেন বছরের পর বছর, তাই নয়। এর পাশাপাশি তাঁর জায়গা বীরভূমবাসীর মনে চিরস্থায়ী হওয়ার পিছনেও কারণ আছে। খুব অসুবিধেয় না পড়লে কোনওভাবে চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ রাখেননি সুশোভন ডাক্তার। গত এপ্রিল মাসে তিনি একবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময় বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল তাঁর চেম্বার। পরে সুস্থ হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। অসুস্থতা সঙ্গে নিয়েই কাজ চালিয়ে গেছেন। তাকাননি নিজের ভগ্ন স্বাস্থ্যের দিকে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ২০১৯ সালের জুন মাসে যখন এনআরএস হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎকদের ওপর হামলা হয়, সেই সময় রাজ্যজুড়ে চিকিৎসকরা ধর্মঘটে শামিল হন। কিন্তু এক টাকার ডাক্তার সেইসময় ধর্মঘটী চিকিৎসকদের পাশে থেকেও চিকিৎসা পরিষেবা একদিনের জন্য বন্ধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, "ডাক্তারদের ওপর হামলা কোনওভাবে সমর্থন করি না, তবে ডাক্তারদের কর্মবিরতিকেও সমর্থন করি না। প্রতিবাদের পথ অন্যরকম হওয়া উচিত। কারণ রোগীরা তো প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তারের কাছে আসেন।" এখানেই তাঁর পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা, রোগীর প্রতি দায়বদ্ধতা।

আজকে কলকাতা, এমনকী, অন্য শহর ও শহরতলিতেও কর্পোরেট হাসপাতালগুলির রমরমা। কর্পোরেটে কর্পোরেটে লড়াই। রোগী সেবার নামে এই হাসপাতালগুলি হয়ে উঠেছে টাকার শোষণযন্ত্র। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের অবস্থা বেহাল। বলা ভালো, ছেঁড়া কাপড়ের মতো এই হাসপাতালগুলির দৈন্য চাপা থাকে না। অভিযোগ, এই অবস্থায় কখনও কখনও ডাক্তাররাও দেখিয়ে দেন বেসরকারি হাসপাতালের পথ। বাধ্য হয়ে রোগীকে সেখানে চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবার নিঃস্ব হয়। এইরকম ব্যাধিগ্রস্ত অর্থপিপাসু সিস্টেমের মুখে ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যেপাধ্যায়দের দেখানো পথ একটা সজোর থাপ্পড়। অগ্নীশ্বরদের ঠাঁই সেলুলয়েডে, কিন্তু সুশোভনরা তো জীবন্ত, জীবন্ত তাঁর কাজ। তাই তো তাঁর জীবন একটা আদর্শের আখ্যান।

 

More Articles