টাকা দেখতে কেমন হবে, ঠিক করতে পারে না কেন্দ্রীয় সরকার! কেন জানেন
Note Controversy: দেশে নোটের চেহারা কেমন হবে তা কারা নির্ধারণ করে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
এদেশে হিন্দুত্ব ব্র্যান্ড অফ পলিটিক্সের সংজ্ঞা পাল্টেছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। একটা সময় শিবসেনা এবং বিজেপি-র অন্যতম পরিচয় ছিল তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিবসেনা রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে, সেই কারণে শিবসেনা থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছে শিন্ডেসেনা (একনাথ শিন্ডে-র নেতৃত্বাধীন শিবসেনার বিদ্রোহী অংশ)। এইসব ঘটনা গত কয়েক মাসে আমরা দেখেছি। তবে এই সবের মধ্যেই খুব সুচারুভাবে আরও একটি রাজনৈতিক দল হিন্দুত্বের পলিটিক্সকে দেশবাসীর সামনে নতুন করে নিয়ে আসছে। তারা দিল্লির শাসক দল, আম আদমি পার্টি বা আপ।
একদিকে ওয়েলফেয়ার স্কিম, আরেকদিকে দিওয়ালির পুজোকে টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট করে বা বয়স্কদের বিনামূল্যে চারধাম যাত্রার ব্যবস্থা করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে নিজেদের পা জমাচ্ছে কেজরিওয়ালের দল। বিজেপির হিন্দু ভোট নিজেদের দিকে টেনে নেওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রণকৌশলের অন্যতম অংশ। একদিকে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরার আশঙ্কায় বিজেপি আম আদমি পার্টিকে হিন্দুবিরোধী বলছে, অপরদিকে কংগ্রেস আম আদমি পার্টিকে আরএসএস-এর ‘বি টিম’ বলে কটাক্ষ করছে। তবে এসবের মাঝখানেই আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ দাবি করেছে আপ। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা আবেদন জানিয়েছে, ভারতের নোটে লক্ষ্মী এবং গণেশের ছবি নিয়ে আসতে। হিন্দুশাস্ত্র মতে লক্ষ্মী-গণেশ সুখ এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। সেহেতু দেশের মুদ্রায় লক্ষ্মী এবং গণেশের ছবি নিয়ে দেশে সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে, এমনটাই দাবি আম আদমি পার্টির। অনেক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আম আদমি পার্টির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। ফলত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই দাবি উঠছে এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করার। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, দেশে নোটের চেহারা কেমন হবে তা কারা নির্ধারণ করে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
দেশের নোট এবং কয়েন প্রচলন করার ক্ষমতা কার হাতে রয়েছে?
আসলে দেশের নোট বা টাকা কেমন দেখতে হবে, তা কেন্দ্রীয় সরকার নয়, নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। তবে দেশের কয়েন বা মুদ্রা কেমন দেখতে হবে, তা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় সরকার। আরবিআই-এর নিজস্ব ইন্টারনাল কমিটি আছে, যারা নির্ধারণ করে নোটের ডিজাইন কেমন হবে। আসলে ভারতীয় সংবিধানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৪-এর সেকশন ২২ অনুযায়ী ভারতে কোনও নোটের প্রচলন করার একমাত্র অধিকার থাকবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার।
নোট প্রিন্টিং প্রেস, নাসিক
ওই একই অ্যাক্ট-এর সেকশন ২৫ অনুযায়ী, নোটের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সুপারিশ করা ডিজাইন, আকৃতি এবং মেটেরিয়ালকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। অপরপক্ষে মুদ্রা আইন ২০১১ (Coinage Act, 2011) অনুযায়ী, দেশে মুদ্রা বা কয়েন প্রচলনের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানাধীন মিন্টে তৈরি করা হয় যাবতীয় কয়েন বা খুচরো পয়সাগুলি। সারা দেশে এর বন্টনের ক্ষেত্রে আরবিআই-এর তেমন ভূমিকা থাকে না। তবে আরবিআই-এর সঙ্গে আলোচনা করেই প্রতি বছর বাজারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়েন ছাড়ে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই কয়েনগুলি মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা এবং নয়ডায় অবস্থিত চারটি মিন্টে তৈরি হয়।
মিন্ট, কলকাতা
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ডিপার্টমেন্ট অফ কারেন্সির ভূমিকা
বর্তমানে আরবিআই-এর ডিপার্টমেন্ট অফ কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের শীর্ষে রয়েছেন দেশের ডেপুটি গভর্নর টি রবিশঙ্কর। দেশের কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছে এই ডিপার্টমেন্টের ওপরেই। আরবিআই-এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী- নোটের ডিজাইন, চাহিদা অনুযায়ী নোটের প্রিন্টিং, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে নোটের বন্টন ইত্যাদির দায়িত্ব রয়েছে কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ওপর। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার এবং নিজেদের অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দিষ্ট সংখ্যক নোট ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতো পর্যাপ্ত পরিমাণে কাগজ এবং অন্যান্য কাঁচামাল রফতানি করা হয়। আরবিআই-এর পলিসি অনুযায়ী একমাত্র ভালো মানের নোটগুলিকেই সাধারণ মানুষের ব্যবহার করার জন্য বাজারে ছাড়া হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই নোটগুলিকে বাজারে ছাড়া হয়, সামান্য ত্রুটি থাকলেও সেই নোটগুলিকে বাতিল করে নষ্ট করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ভারতে মোট চারটি নোট প্রিন্টিং প্রেস রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়াস এবং নাসিকে অবস্থিত প্রেস দু'টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। অপরপক্ষে মাইসোর এবং শালবনিতে অবস্থিত প্রেস দু'টি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক নোট মুদ্রণ লিমিটেডের অধীনস্থ। বর্তমানে ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ টাকার নোট প্রিন্ট করেছে এই নোট প্রিন্টিং প্রেসগুলি। ২০০০ টাকার নোট বাজারে থাকলেও আজ থেকে বছরদুয়েক আগে তা প্রিন্ট করা বন্ধ করে দিয়েছে আরবিআই। অপরপক্ষে বর্তমানে ৫ টাকার নোট প্রিন্ট করা বন্ধ করে দিলেও তা ব্যবহারে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। পুরাতন ১ টাকা বা ২ টাকার নোট নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর আগে গত ৫-৬ বছরে বিভিন্ন জায়গায় আমি পুরনো ২ টাকার নোট দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ-ই তা নেয়নি। বদলে আমায় ২ টাকা খুচরো দিতে হয়েছিল। সুতরাং বর্তমান বাজারে ১ টাকা বা ২ টাকার নোট না ব্যবহার করাই শ্রেয়।
বিভিন্ন ধরনের ব্যাঙ্ক নোট, যা আজ পর্যন্ত ইস্যু করা হয়েছে:
অশোক স্তম্ভ সিরিজ (Ashoka Pillar Series, 1949)
অশোক স্তম্ভ সিরিজের ৫ টাকার নোট
স্বাধীন ভারতের প্রথম যে ব্যাঙ্ক নোটটি ইস্যু করা হয়েছিল সেটি ছিল ১ টাকার। ১৯৪৯ সালে মুদ্রিত এই নোটগুলিতে রাজা জর্জের বদলে সারনাথের অশোকস্তম্ভের সিংহ অঙ্কিত ছিল। এমনই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম নোটের চেহারা।
মহাত্মা গান্ধী সিরিজ ’৯৬ (Mahatma Gandhi Series, 1996)
মহাত্মা গান্ধী সিরিজ ’৯৬-এর ৫০০ টাকার নোট
ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশের মোট মহাত্মা গান্ধীর ছবি আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই নোটগুলির ওপরের দিকে মহাত্মা গান্ধীর ছবি ছিল। আগের সিরিজের নোটগুলিতে অশোকস্তম্ভ ছিল, সেটিকে খানিকটা বাঁদিকে সরিয়ে নোটের ওপরে মহাত্মা গান্ধীর ছবি নিয়ে আসা হয়।
মহাত্মা গান্ধী সিরিজ ’০৫ (Mahatma Gandhi Series, 2005)
এই সিরিজে নতুন ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নিয়ে আসা হয়। এগুলি মানে পূর্ববর্তী মহাত্মা গান্ধী সিরিজের নোটগুলি থেকে অনেক উন্নত ছিল। এছাড়াও যাতে সহজে জালিয়াতি না করা যায় সেই জন্য সুরক্ষা সম্পর্কিত বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয় এই নতুন মহাত্মা গান্ধী সিরিজে (MG Series, 2005)। এই সিরিজ বাজারে এখনও চলমান থাকলেও এর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের সমাধি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর।
মহাত্মা গান্ধী সিরিজ '১৬ (Mahatma Gandhi Series, 2016)
কয়েকদিন পরেই ভারতে নোটবন্দির ছয় বছর পূর্ণ হবে। সর্মথকরা বলেন প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর সিদ্ধান্ত ছিল ‘মাস্টারস্ট্রোক’, বিরোধীরা বলেন ‘জুমলা’। এই নোটবন্দির পর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তরফের নতুন ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট বাজারে আনা হয়। এই নোটগুলি পূর্ববর্তী সিরিজের নোটগুলোর তুলনায় আকারে সামান্য ছোট। বর্তমান সিরিজের এই নতুন নোটগুলির মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর ছবির পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন স্থাপত্যের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য নোটগুলিতে স্থাপত্যের ছবি থাকলেও ২০০০ টাকার নোটে ভারতের মঙ্গলযানের ছবি রয়েছে। নিঃসন্দেহে এই নোটগুলি ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে।