ইউক্রেন বনাম রাশিয়া যুদ্ধ: ভারতের নীরবতার আসল কারণটা কী

গত ২৪  ফেব্রুয়ারি  রাশিয়া তার প্রতিবেশি রাষ্ট্র ইউক্রেনের উপর সমস্ত আর্ন্তজাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে যুদ্ধ শুরু করে। এর তিনদিন আগে রাশিয়া ইউক্রেনের ডোনেক্স (Donetsk) এবং লুহান্স (Luhansk) অঞ্চলকে স্বাধীন ভূখণ্ড ঘোষাণা করে, ওই অঞ্চলে তার সেনাবাহিনী পাঠায়। উল্লেখ্য যে, এই দুই ভূখণ্ডে রুশবাসী মানুষের সংখ্যাই বেশি এবং সেখানে বিগত কয়েক বছর ধরে ইউক্রেন বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। যদিও প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, রাশিয়া বোধহয় ইউক্রেনের ওই দুই ভূখণ্ডে সেনা পাঠিয়ে, দুটি ভূখণ্ডকে স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করবে এবং এইভাবেই তার ইউক্রেন অভিযান সীমাবদ্ধ রাখবে। কিন্তু এই পূর্বানুমান মিথ্যা প্রমাণ করে রাশিয়া গত ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে, এমনকি রাজধানী শহর কিভেও বোমা বর্ষণ এবং মিশাইল হানা চালায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর ইউক্রেন আক্রমণ, সামরিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বললেও, পরবর্তী সময়ে তার বিপরীতটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

বর্তমানে সামরিক এবং অসামরিক সকল ক্ষেত্রের উপরেই রাশিয়ার আক্রমণ অব্যহত রয়েছে । একদিকে যেমন বহু ইউক্রেনবাসী নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে, ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্তবর্তী দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন, আবার অন্যদিকে ইউক্রেনের অনেক সাধারণ মানুষজনও দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে দেশ রক্ষার এই যুদ্ধে সামিল হয়েছেন। আমাদের দেশের অনেকেই, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা যারা ইউক্রেনে পড়তে গিয়েছিলেন, সেই সমস্ত নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী চিন্তিত। ইতিমধ্যে ‘অপারেশন গঙ্গা’ নাম নিয়ে ভারত সরকার যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতবাসীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজে নেমে পরেছেন।    

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, শনিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে নিন্দা করে; দ্রুত ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ এবং ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পনেরো জন সদস্যের মধ্যে ভারতবর্ষ, চিন এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী - তিনটি দেশ এই নিন্দা প্রস্তাব থেকে বিরত থাকে। খুব স্বাভাবিক হিসাবেই, রাশিয়া এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে। জাতিসংঘে  ভারতের প্রতিনিধি টি এস ত্রিরুমূর্তি বলেন, ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী খুবই উদ্বেগজনক এবং ইউক্রেনে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকদের নিরপত্তা নিয়ে ভারত খুবই চিন্তিত। তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার  নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া বিরোধী প্রস্তাবে ভোট না দিয়ে দুপক্ষের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে।

ভারতের, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া বিরোধী এই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি পশ্চিমি দেশগুলিকে বেশ হতাশ করেছে। সারা সপ্তাহ জুড়ে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এবং বিদেশ সচিবের সঙ্গে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানের জন্য তারা আলোচনা করলেও, তাঁদের এই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ভারতের এই নীরবতার কারণ হিসাবে ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতবাসীদের নিরপত্তার বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে আবার অন্যদিকে ভারতবর্ষ সামরিক ক্ষেত্রে এখনও বহুলাংশে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। ভারতবর্ষের যুদ্ধ বিমানগুলির মধ্যে ৭৪ ভাগই রাশিয়ার প্রযুক্তিতে তৈরী। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মোড় নিলেও এখনও সামরিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাহায্যে প্রত্যাশী। কিন্তু এই বিষয় দুটি ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ কোন কারণ চোখে না আসলেও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার যে বোঝাপড়ার সম্পর্ক তা যে কেবল মোদী জামানাতেই ঘটেছে এমনটা নয়।

 ভারতবর্ষের এই অবস্থান যত না নীতিগত তারচেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত ভারতের সমস্যার পাশে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার সহযোগিতার দ্বারা । নিরপত্তার পরিষদের যে পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য তাঁদের মধ্যে একমাত্র রাশিয়াই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের পাশে থেকেছে, সে কাশ্মীর সমস্যা হোক কিম্বা হোক বাংলাদেশের যুদ্ধ।

ভারতের বিপদে, ভারতের পাশে থাকার জন্য ১৯৫৬ সালে রাশিয়ার হাঙ্গেরির বিপ্লব দমন অথবা ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভোকিয়া প্রাগ বসন্ত আন্দোলন দমনকে ভারত নিন্দা করেনি। আমরা সম্প্রতি প্রকাশিত জয়রাম রমেশের বই ‘A Chequered Brilliance : The Many Lives of V.k.krishna Menon’  থেকে জানতে পারি, হাংগেরীর বিপ্লব দমনে ক্ষেত্রে রাশিয়ার পদক্ষেপকে সমর্থন না করার জন্য নেহেরুর পরামর্শ কৃষ্ণ মেনন মেনে চলেননি। বিনিময়ে রাশিয়াও কাশ্মীরের গণভোট সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে অনুপস্থিত থাকে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় ভারত যখন আমেরিকা থেকে কোন সাহায্য পায়নি তখন রাশিয়া ভারতের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এই বৈরিতা অবসানের পূর্ব শর্ত হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মীমাংসা দাবি করেছিল। ১৯৭৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কম্বোডিয়ার পলপট সরকারকে উৎখাতের সময়ও ভিয়েতনাম এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ ভারত সরকার করেনি। ১৯৭৯ সালের যখন সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার বিষয়টি্কে সমর্থন জানিয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারত বলেছিল, আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের আহ্বানে রাশিয়া আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছে।  

  ২০১৪ সালের যখন ইউক্রেনের পূর্ব এবং দক্ষিণ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রবল রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়, তখন রাশিয়ার সৈন্য ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করে। বির্তকিত রাজনৈতিক গণভোটে ক্রিমিয়ার জনগণ, ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভূক্তির পক্ষে রায় দেয়নি। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সৈন্য পাঠানো এবং ক্রিমিয়ার, রাশিয়ার অন্তর্ভূক্তির এই বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার বিরোধিতা তো করেইনি বরং পক্ষান্তরে সমর্থনসুচক মন্তব্যই করেছিল।  

 শুধুমাত্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেই নয়, সাধারণ পরিষদেও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরোধী প্রস্তাবেও ভারত ভোটদানে বিরত থাকে।

 রাশিয়ার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান বা ভারতের ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান অনেকাংশেই বৃহত্তর কোন আদর্শ দ্বারা চালিত না হয়ে, পারস্পরিক প্রয়োজন বোধ দ্বারা চালিত। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের এই অবস্থানে এটা আরও বিশেষভাবে স্পষ্ট হল।

More Articles