বিশ্বকে আরও একটা যুদ্ধের সামনে ঠেলে দেওয়া কেন? পুতিনের সাফাইয়েই লুকিয়ে উত্তর

রাশিয়ান আক্রমণের প্রথম দিনেই ইউক্রেনের ১৩৭ জন সেনা ও নাগরিক মারা গিয়েছেন, শয়ে শয়ে মানুষ আহত। ক্রমেই মৃতের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়েছে। স্থলপথে, জলপথে এবং আকাশপথে গত বৃহস্পতিবার রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। প্রসঙ্গত দীর্ঘদিন ধরেই এই আক্রমণের পরিকল্পনার দাবিকে নস্যাৎ করে আসছিলেন পুতিন। কিন্তু সম্প্রতি রাশিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে টেলিভিশনের একটি ভাষণে সাফ যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি।

ভাষণে নিজের অবস্থান নিয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার পুতিন। রাশিয়ার ‘সম্মৃদ্ধ জারশাসনে’র উল্লেখ করে ইউক্রেনকে রাশিয়ারই অংশ বলে উল্লেখ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মিক ক্ষেত্রটির অন্যতম অংশ বলেও দাবি করেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, “আধুনিক ইউক্রেনের জনক রাশিয়া। বিশেষত বলশেভিক কম্যুনিষ্ট দলের অবদান সবটাই। ১৯১৭-র বিপ্লবের পরপরই এর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেনিন এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ইউক্রেনকে রাশিয়া থেকে আলাদা করে দিয়ে ঘোরতর অবিচার করলেন। ঐতিহাসিক ভাবে এ রাশিয়ার মাটি। রাশিয়ার প্রতি, রাশিয়ার মানুষের প্রতি এই অবিচার লেনিনের শুধু বিরাট বড় ভুলই নয়, আরো নিকৃষ্টতর যদি কিছু থাকে, তবে তাই। ১৯৯১-এ সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে এটা সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। …কিন্তু তারপরেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমানে যে ইউক্রেনকে আমরা দেখছি, তা সম্পূর্ণ লেনিনের হাতে গড়া। …স্ট্যালিনের আমলে কম্যুনিষ্ট পার্টির মতাদর্শকে এক এবং অদ্বিতীয় করে তোলা, সম্পূর্ণ ক্ষমতা কম্যুনিষ্ট পার্টির আওতায় আনা, পরিকল্পিত অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয়করণ–এ সমস্তই ইতিপূর্বে সরকারের ঘোষীত নীতিগুলিকে শুধুমাত্র খাতায় কলমে ঠেলে দিয়েছিল। বাস্তবে ইউনিয়ন রিপাবলিকে কারো কোনও মৌলিক অধিকার ছিল না। শক্ত হাতে একীভূত একটি মাত্র রাষ্ট্র ছিল তখন। …কিন্তু স্ট্যালিনকে করুণা করি। আমাদের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ভিত ওঁর বিপ্লবী স্বপ্ন আর ইউটোপিয়ায় ভেসে গেল। যতটা সাফ-সুতরো করা যেত, তার কিছুই হল না। এসব দুর্বলতা সমস্ত রাষ্ট্রকে শেষ করে দেয়। আর আজ এই অকৃতজ্ঞ সন্তান লেনিনের মূর্তি উপড়ে ফেলছে? বলছে ‘ডিকম্যুনাইজেশন’? দেখতে চাও সত্যি সত্যি ‘ডিকম্যুনাইজেশন? আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। হচ্ছে যখন পুরোটাই হোক।”

পুতিনের মতে ইউক্রেনের পৃথক পরিচিতি সম্পূর্ন ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়াই হবে তাদের ‘ডিকম্যুনাইজেশনে’র দাবির প্রতি সুবিচার।

যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই আক্রমণের নেপথ্যে রয়েছে আরো গুরুতর কারণ। ইউক্রেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যার জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। রাশিয়ার পরে এটি ইউরোপের বৃহত্তম দেশ। হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে ইউক্রেনের। সোভিয়েতের পতনের পর মস্কৌর শাসনের অধীনে থাকতে তারা অস্বীকার করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও নেটোয় যোগ দেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে তার সময়ে সময়ে। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ পুতিন পশ্চিমের দেশগুলি এবং ইউক্রেনের কাছে দাবি করেন, কোনোমতেই ইউক্রেন যেন নেটোর সঙ্গে যুক্ত না হয়। সেই দাবি ইউক্রেনকে সেনাহীন এবং নিউট্রাল স্টেট করে ফেলা অবধি পরিবর্ধিত হয়।

কিন্তু গত বছর জানুয়ারিতে ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কাছে আবেদন করেন যেন ইউক্রেনকে নেটোতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন পুতিন। ইউক্রেনের মতো আয়তনে বিশাল প্রতিবেশী দেশ ইউরোপের কোনও জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। আসলে ইউক্রেনকে এমন একটা দেওয়াল বলে মনে করা হয় যার দু'প্রান্তে বিশ্বের দুই অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তির অবস্থান। এছাড়াও কয়েক শতক রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকায় একে এখনও নিজের ক্ষমতাধীন মনে করে থাকে রাশিয়া। এমনকি জন্মপরিচয়ে ইউক্রেনিয়ান–এমন বহু ব্যক্তির মাতৃভাষা রাশিয়ান। সোভিয়েত রিপাবলিকে থাকা বেশিরভাগ দেশই এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা নেটোয় যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪র বিদ্রোহে যখন ইউক্রেনের রাশিয়া-প্রেমী রাষ্ট্রপতির পতন হয়, তখন থেকেই প্রমাদ গুনছে রাশিয়া।

সে সময়েই ইউক্রেনের ক্রিমিন অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া। যদিও তা সরাসরি হামলা ছিল না। তবে পরের মাসেই এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নবাদীরা ইউক্রেনের সীমারেখা থেকে মুক্ত হয়ে রাশিয়ায় যুক্ত হতে চাইলে, মস্কৌ তাতে সায় দেয়নি। রাজনৈতিক ভাবে এই অঞ্চলটিকে বেনামী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল তাদের, যা দিয়ে ভয় দেখিয়ে রাশিয়াকে আটকে রাখা যাবে নেটোর প্রলোভন থেকে। যদিও ইউক্রেনের তরফ থেকে বারবার অভিযোগ উঠেছে যে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নানাভাবে সাহায্য করছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সে সবই উড়িয়ে দিয়ে আসছিল রাশিয়া।

সেবারও ট্যাঙ্ক নিয়ে, ভারী অস্ত্রাদি সমেত যুদ্ধবিমানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালিয়ে ছিল। যুদ্ধচলাকালীন ১৭ জুলাই, মালয়েসিয়া এয়ারলাইন ১৭ নামক বিমানটিকে উড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। ২৯৮ জন যাত্রীর প্রত্যেকে মারা গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক তদন্তে উঠে আসে ব্যবহৃত মিসাইলটি রাশিয়াই সরবারহ করেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। কিন্তু সেবারও সমস্ত যোগাযোগ অস্বীকার করে মস্কো। কিন্তু এবার আর রাখঢাক নেই। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে একটি লম্বা ভাষণে যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি সাজিয়ে তারপরই আক্রমণ করেছেন পুতিন।

More Articles