বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নতুন বিল আসলে কি হাতির মৃত্যুর ফরমান?

গত বছর সাতাশে ডিসেম্বর সংসদে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক একটি সংশোধনী বিল পেশ করা হয়েছে। সেই বিলের সাতাশ নম্বর ধারা অনুযায়ী বানিজ্যিক ভাবে হাতির কেনা-বেচা আইনি ভাবে অনুমোদন পাবে।

১৯৭২ সালে প্রথমবার হাতির বানিজ্যিক কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হয়। তার ঠিক ৫০ বছর পর, হাতি সংরক্ষণের পথে কয়েক শো পা পিছিয়ে, হাতির বানিজ্যিক কেনাবেচা পুনরায় আইনসিদ্ধ করার প্রয়াস, অদূর ভবিষ্যতে তার ফলাফল কী হতে পারে?

সেই প্রসঙ্গে আসার আগে বর্তমানে ভারতে হাতির অবস্থা বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া যাক। ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে শিকারীরা ৪৯ টি হাতিকে হত্যা করেছে। সব থেকে বেশি হাতিকে হত্যার ঘটনা দেখা গিয়েছে আসামে - যেখানে এই সংখ্যাটা ৯; তারপরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ আর তামিলনাড়ু - দুই রাজ্যেই এই সংখ্যা ৮। এর পরেই রয়েছে কর্ণাটক, উত্তরাখন্ড, কেরালা, অরুণাচল প্রদেশের মত রাজ্য। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ২০০৯ সাল থেকে ৪২৯ টি হাতি কেবল পোচিংয়ের কারণেই মারা গিয়েছে।

 রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্টিভিস্ট আর. পন্ডিরাজার মতে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে  ভারতবর্ষে ১৮৬ টি হাতি মারা গিয়েছে কেবল চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায়। উল্লেখিত দশ বছরের মধ্যেই মোট ৭৪১ টি হাতি কেবল ইলেট্রিক শকে মারা গেছে। জনবসতি এবং ক্ষেত খামারকে রক্ষার স্বার্থে বানানো হয় দীর্ঘ প্রাচীর এবং ইলেকট্রিক  তারের বেড়া। ২০২১ সালে দেখা গেছে ইলেকট্রিক শকও হাতির মৃত্যুর পিছনে একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আবারও এগিয়ে আসাম, যেখানে ৯০ হাতির মৃত্যু ঘটেছে বৈদ্যুতিক-বেড়ার প্রভাবে। এর পরেই  ক্রমান্বয়ে রয়েছে ওড়িশা, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক, যেখানে যথাক্রমে ৭৩, ৬৮, এবং ৬৫ টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।

নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাসোসিয়েশনের ও ওয়াইল্ডলাইফ ইন্স্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন জীববিজ্ঞানী উপমন্যু চক্রবর্তীর মতে, ভারতে হাতি বিষয়ে সব থেকে বড় সমস্যা হল, হাতি আর মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ। অধিকাংশ সময়েই হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করে ক্ষেত-খামার নষ্ট করে, বাড়ি ঘর ভেঙে দেয়। হাতির লোকালয়ে প্রবেশের মূল কারণ কিন্তু অরণ্য ধ্বংস হওয়া। যা কি-না হাতির স্বাভাবিক বাসস্থান ও খাদের উৎস। উপমন্যু চক্রবর্তীর কথায়, "হাতি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকে এবং এদের খাদ্যের চাহিদা বেশী হওয়ায় এদের জঙ্গলের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলাচল করতেই হয়।"

বিস্তীর্ণ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সড়ক বা রেলপথ তৈরি হয়, জঙ্গল ধ্বংস করে খনিজ খননের কাজ চালু হয়, আর তার আশেপাশে জনবসতি গড়ে ওঠে, ধীরে ধীরে ক্ষেত-খামার তৈরি হয় - ফলে বিস্তীর্ণ জঙ্গল মাঝখান থেকে বিছিন্ন হতে থাকে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ফরেস্ট ফ্র্যাগমেন্টেশন।

এই বিছিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচল করার জন্যে নির্বিঘ্নে হাতির চলাচলের জন্যে প্রয়োজন এলিফ্যান্ট করিডর। উড়িষ্যা সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এলিফ্যান্ট করিডর নিয়ে সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। এর আগেও সিমলিপাল, নীলগিরির মত জঙ্গলে এলিফ্যান্ট করিডর নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘ টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।

পাশাপাশি হাতির ব্যবহারের জন্যে যথোপযুক্ত এবং কার্যকরী করিডর প্রয়োজন। সেটা কৃত্রিম ভাবে তৈরি করতে গেলেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ জমির অভাব। "অরণ্যের পুনরুদ্ধার ছাড়া, কেবলমাত্র গাছ লাগিয়ে এলিফ্যান্ট করিডর বানানোর মত অবস্থা ভারতে নেই। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জনসংখ্যা বাড়ায়, জমির চাহিদা বাড়ছে।" জানাচ্ছেন উপমন্যু চক্রবর্তী। তিনি আরও বলছেন, "ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে সেই জমি হাতির জন্য না রেখে মানুষের জন্য ব্যবহার করলেই সরকারের সুবিধে।"

আর ঠিক এই সময়ে যখন হাতির অস্তিত্ব বিপন্ন, ঠিক এই সময়ে সংসদে নতুন বিলটি পেশ করা হয়েছে, যা পাশ করলে হাতির কেনা-বেচা অবাধে শুরু হবে।  উপমন্যু চক্রবর্তীর মতে, "যখনই হাতির বানিজ্যিকরণ ঘটবে, তখন হাতির চাহিদাও বাড়বে।" বলার অপেক্ষা রাখে না, তা বাস্তুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অনেকের মতে এই বিল পাশ হলে অবশেষে হাতির বেআইনি হত্যা এবং হাতির দাঁত সংগ্রহ বন্ধ হবে। কিন্তু আদতে তা হতে পারে না। একবার বানিজ্যিকরণ শুরু হলে হাতির চাহিদা তো বাড়বেই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাতির দাঁতের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়বে; চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সরবরাহে ঘাটতি হলে নতুন এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে। ফলে হাতি হত্যা বাড়বে বই কমবে না।"  

এশিয়াতে একমাত্র পুরুষ হাতিদেরই লম্বা দাঁত থাকে। ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে পোচিং করে হাতির দাঁত সংগ্রহ করার ফলে হাতির দাঁতের দৈর্ঘ্য  কমে যাচ্ছে। কারণ হাতির দাঁত সংগ্রহ করতে গেলে লম্বা দাঁত ওয়ালা হাতিকেই হত্যা করা হচ্ছে। ফলে হাতিদের পপুলেশন থেকে লম্বা দাঁত ওয়ালা হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। রয়ে যাচ্ছে এমন হাতিরাই যাদের দাঁতের দৈর্ঘ্য  স্বল্প। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব হাতিদের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হলে, পরবর্তী প্রজন্মের পুরুষ হাতিদের দাঁতের দৈর্ঘ্য জিনগত কারণেই কম হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপমন্যু চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, "ভারতে এই কারণেই এখন খুব লম্বা দৈর্ঘ্যের দাঁত ওয়ালা হাতি, যাদের দাঁত প্রায় মাটি ছুঁত, তারা আজ প্রায় বিরল।"

হাতি সংরক্ষণের নতুন বিলটি পাশ হলে ভারত হল একমাত্র দেশ যেখানে বন্যপ্রাণীদের মধ্যে হাতিকে আইনত পোষা যায়। অকথ্য অত্যাচার হয় হাতির উপর, হাতির মালিকের হাতেই। দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন মন্দিরে ঈশ্বররূপে পুজোর উদ্দ্যেশ্যে  বন্দি রেখে হাতিকে অত্যাচার করাও নতুন ঘটনা নয়। তাছাড়া ভক্তিরসের অতিশয্যের মাঝে  আনারসে বোম ভরে গর্ভবতী হাতিকে চিরঘুমে পাঠানোর ঘটনা আজও আমাদের স্মৃতিতে টাটকা। সংরক্ষণের নতুন এই বিলটি পাশ হলে, হাতিকে এবার বন্ধুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে সরকারি ভাবে হত্যার রাস্তাটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

More Articles