পলিগ্রাফেই কি সব সত্যি উগরে দেবে শ্রদ্ধার খুনি আফতাব? কীভাবে করা হয় এ পরীক্ষা

Shraddha Murder Case : শ্রদ্ধা হত্যাকান্ডেও জরুরি হল পলিগ্রাফ পরীক্ষা, কী এই পরীক্ষা?

একটা নৃশংস খুন, একজন খুনী আর অজস্র আইনি মারপ্যাঁচ, প্রতিদিনই নয়া নয়া মোড় নিচ্ছে তদন্ত।চলছে টানা জিজ্ঞাসাবাদ, খুনের ধরন নিয়ে হাজার পর্যালোচনাও। বিশ্বকাপের উত্তেজনার মাঝেই বারবার শিরোনাম দখল করছে দিল্লীর আফতাব-শ্রদ্ধার ঘটনা।

শ্রদ্ধা হত্যাকাণ্ডের পরতে পরতে রহস্য। ঠান্ডা মাথায় খুন নাকি কোনো মানসিক বিকৃতি, এসব উত্তর মেলেনি এখনও। উপরন্তু প্রতিমুহূর্তে ঘটনার জট আরও প্রকট হচ্ছে। তাই কেবল জেরা নয়, আরও একধাপ এগলো তদন্ত প্রক্রিয়া। রহস্যের জাল ছিঁড়তে নয়া পদক্ষেপ, পলিগ্রাফ পরীক্ষা। জ্বরে ভোগার কারণে বুধবার পরীক্ষা করানো না গেলেও গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হয়েছে শ্রদ্ধা হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত আফতাব আমিন পুনাওয়ালার পলিগ্রাফ পরীক্ষা। পুলিশ সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার প্রায় আট ঘণ্টা ধরে চলে আফতাবের পলিগ্রাফ পরীক্ষা। জানা গিয়েছে, দিল্লির রোহিণীর ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় প্রক্রিয়া। একের পর এক প্রায় ৪০টির মতো প্রশ্নবাণ তাক করা হয় তার দিকে। পরীক্ষার সময় আফতাব সহযোগিতা করলেও অতিরিক্ত হাঁচির কারণে কিছু রেকর্ডিং অস্বচ্ছ থেকে যায়। তাই আজ আবারও তাকে পরীক্ষার জন্য ডাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন এফএসএল-এর ডিরেক্টর দীপা বর্মা। তদন্তকারীদের অনুমান, এই পলিগ্রাফ টেস্টের ফলে অনেক গোপন তথ্য কবুল করতে পারে আফতাব। পাশাপাশি এ পরীক্ষার ফলে যে শ্রদ্ধা খুনের কিনারার আরও কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে এমনটাও মনে করছে দিল্লি পুলিশ।

এফএসএল সূত্রে খবর, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় প্রশ্নোত্তর পর্ব চলাকালীন, আফতাবকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশদে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি শ্রদ্ধাকে কেন খুন করেন এবং খুন করার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত কি না ইত্যাদি। এমনকী শ্রদ্ধার দেহ তিনি কী ভাবে টুকরো টুকরো করেছিলেন, সেই বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ জানাচ্ছেন, পলিগ্রাফ টেস্টের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই এমনটাও জোর দিয়ে বলেছেন না কেউই। তবুও কোনও অভিযুক্তের উপর থার্ড ডিগ্রি টর্চারের মতো নৃশংসতা না দেখিয়ে এই পলিগ্রাফ টেস্টকেই অনেক বেশি উপযুক্ত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন :আফতাব একা নয়, যোগীরাজ্যেও প্রেমিকার দেহ টুকরো টুকরো, রাজ্যে রাজ্যে কেন বাড়ছে এই ধরনের অপরাধ?

কী এই পলিগ্রাফ পরীক্ষা?
এককথায় যাকে বলে সত্য যাচাই পরীক্ষা। অর্থাৎ মিথ্যে ধরার যন্ত্র। কবির ভাষায় দোষের মধ্যে একটু যারা মিথ্যে কথা কয়, তাদের জন্য না হোক বড়ো বড়ো মিথ্যাবাদীদের ধরতে এ একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র। অপরাধ বিজ্ঞান আর মেডিকেল সায়েন্সের মিশেল।

ন'য়ের দশকে ইতালিতে প্রথম পলিগ্রাফ পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরীক্ষা করেছিলেন একজন অপরাধ দমন শাখারই বিশেষজ্ঞ। অভিযুক্তের শারীরিক অবস্থার পরিমাপগুলি ব্যাখ্যা করে সহজেই সত্যি মিথ্যার ফারাক খুঁজেছিলেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদ এবং অপরাধ দমন বিভাগেও এই পরীক্ষা শুরু হয়। ব্যাক্তির শরীরের নানারকম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যেমন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস পরিবর্তন, হাতের তালু ঘামা, নাড়ির গতি ইত্যাদি পরীক্ষা করে বোঝা হয় ব্যাক্তি সত্যি কথা বলছেন কিনা।

মনোবিজ্ঞানীরা জানান, মিথ্যা বলার সময় আমাদের মানসিক চাপ বাড়ে এবং মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এরকম অবস্থায় ডাক্তারি যন্ত্রপাতির দ্বারা সহজেই ধরা যায় পরিবর্তন। ফলে, অপরাধী প্রশ্নকর্তাকে ঠকাচ্ছেন কিনা তাও সহজবোধ্য হয় এ প্রক্রিয়ায়।

কীভাবে করা হয় পলিগ্রফি পরীক্ষা?

প্রথমেই যাকে প্রশ্ন করা হবে তার আশেপাশে যথা সম্ভব স্বাভাবিক পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। এরপর সেই ব্যাক্তির শরীরের সঙ্গে রক্তচাপ দেখার জন্য একটি মনিটর, আঙ্গুল ও হাতের তালুতে এবং পাকস্থলীর আশেপাশে তড়িৎ প্রবাহের পরিবর্তন লক্ষ্য করার জন্যে দুটি নল লাগানো হয়। এরপর বেশ লম্বা একটা সময় সেই ঘরে রাখা হয় অপরাধীকে। অবশেষে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। ঘণ্টা দুয়েক ব্যাক্তিকে সেই ঘরে রাখা হয়। প্রশ্নকর্তা ব্যাক্তিকে প্রশ্ন করেন এবং তার প্রতিক্রিয়া দেখেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আরেকটি সাক্ষাৎকার হয় যেখানে ব্যাক্তি কোনো প্রশ্নের উত্তরে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বোঝানোর সুযোগ পান। এই পর্বের পাশাপাশিই নজরদারি চলতে থাকে ব্যক্তির কার্ডিও কাফ, ব্লাড প্রেসার, পালস রেট, রক্তচাপ ইত্যাদির ওঠা নামার ওপর। একটি নির্দিষ্ট মেশিন থাকে যাতে তার সত্য বলার সম্ভাবনা কতটা হতে পারে তা ফুটে ওঠে, যা দেখে প্রাথমিকভাবে পরিমাপ করা যায় ভুল ও ঠিকের মাত্রা।

এই বিষয় নিয়ে অধ্যাপক অ্যালডার্ট ভ্রিজের লেখালেখি থেকে জানা যায়, কোনও ব্যাক্তি এই পরীক্ষাকে ফাঁকি দিতে চাইলে তাকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত হতে হবে। পাশাপাশি তিনি এ পরীক্ষার কিছু মৌলিক ত্রুটির কথাও বলেন। বলেন, খুব ঠান্ডা মাথার খুনিরা সহজেই পলিগ্রাফ টেস্টের সময় হওয়া মানসিক স্থিতাবস্তার পরীক্ষায় পাশ করে যেতে পারে।

প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার, উক্ত ব্যক্তির সম্মতি, আইনজীবীর সম্মতি এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মতি ছাড়া এই টেস্ট করা যায়না। এবং এই টেস্টের রিপোর্টকেই চূড়ান্ত প্রমাণ হিসাবে ব্যবহারও করা যায় না। তবুও রহস্য যখন উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে তখন সাময়িক জট ছাড়াতে পলিগ্রাফকেই বিকল্প হিসেবে দেখছেন আইনের রক্ষকরা।

আরও পড়ুন : নৃশংস খুনের আসল কারণ কী, জানতে নার্কো টেস্ট আফতাবের! ঠিক কীভাবে হয় এই পরীক্ষা

সম্প্রতি আফতাব শ্রদ্ধার ঘটনা নতুন করে অপরাধ বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের সংযোগের দিকটিকে আরও স্পষ্ট করেছে। একে অপরের ঠিক কতটা পরিপূরক সেটাও সামনে এসেছে। যদিও পলিগ্রাফ পরীক্ষার নজির এই প্রথম নয়, এর আগেও বহু তদন্তে উঠে এসেছে পলিগ্রাফের প্রয়োজনীয়তা।

এই তো মার্চ মাসের ঘটনা, বগটুই কান্ড। সেখানেও সিবিআই বারবার আবেদন জানায় ধৃতদের পলিগ্রাফ পরীক্ষার জন্য। যদিও অভিযুক্তরা সহযোগিতা করেনি। কিন্তু সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ঘটনায় সহযোগিতা করেছিলেন প্রধান অভিযুক্ত রিয়া চক্রবর্তী। সেখানেও চলেছিল টানা প্রশ্নোত্তর পর্ব। যেমন চলছে আফতাবের ক্ষেত্রে।

একটা নারকীয় ঘটনার সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আরও অনেকটা পথ চলতে হবে আইনকে। পথ চলতে হবে গোটা সমাজকে। এই পলিগ্রাফ টেস্ট কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এমনকি এর নথিও গ্রাহ্য হয় না আইনের চোখে। এ কেবল একটা পদ্ধতি মাত্র। তাই আফতাবের ঘটনার ক্ষেত্রেও পলিগ্রাফ টেস্টের সময় উঠে আসা বয়ান, মার্ডার ওয়েপন কোথায় ফেলেছিল তা কোনো প্রমাণ নয়, সেই মতো খুঁজে পাওয়া অস্ত্রই আসল তথ্যপ্রমাণ। কিন্তু পলিগ্রাফ পরীক্ষা যে অনুঘটক তা মানতেই হয়। তাই নতুন তথ্য উদ্ধারে ভরসা পলিগ্রাফেই।

More Articles