আফতাব একা নয়, যোগীরাজ্যেও প্রেমিকার দেহ টুকরো টুকরো, রাজ্যে রাজ্যে কেন বাড়ছে এই ধরনের অপরাধ?
Shraddha walker murder case : দিল্লির শ্রদ্ধার পর উত্তরপ্রদেশের জ্যোতি, নৃশংস খুনের অন্তরালে এ কেমন অপরাধ প্রবণতা?
কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন,
“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয় / সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়...”
মানলাম সহজ নয়, তা বলে যে মানুষটার সঙ্গে জীবনের সবথেকে ভালো মুহূর্তগুলো কাটিয়েছিলেন কোনোদিন, তাঁকে সরিয়ে ফেলার পদ্ধতি কি এতোটা নৃশংস হওয়া সম্ভব? অথচ গানের ভাষ্য তো অন্য কথা বলে। বলে, “যদি এক মুহূর্তের জন্যেও আমায় চাও, সেটাই সত্যি”। সত্যিই যদি হবে তবে এতো নৃশংসতা কি সম্ভব? আমরা এ নিয়ে নানা যুক্তি তর্কের জাল সাজাই, আর মনোবিজ্ঞানীরা সাজান মনোব্যাধি সংক্রান্ত নানান কথোপকথন। আর এসব কিছুর মধ্যেই হারিয়ে যায় শ্রদ্ধা, জ্যোতি অথবা আরাধনারা।
প্রথমে শ্বাস রোধ করে খুন, তারপর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা। ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। সম্প্রতি এরকম ঘটনাই তো আমাদের রোজনামচা। দিল্লির শ্রদ্ধার হত্যাকে ঘিরে চলছে নিয়ত আলোচনা। এতো লেখালিখি, কেস নিয়ে পরের পর আপডেট, এতো এতো ভিডিও, মিম সবই রয়েছে অথচ সমাজের পরিবর্তন হচ্ছে কই? দিল্লির শ্রদ্ধা হত্যাকাণ্ডের পর সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছে একই আদলে ফের এক খুন।
জানা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের সীতাপুরে স্ত্রীকে হত্যা করে কুচি কুচি করে কেটে ফেলার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় পঙ্কজ মৌর্য নামে এক ব্যক্তিকে। শুধু পঙ্কজ একা নয়, স্ত্রী জ্যোতির এমন পরিণতি ঘটাতে তাকে সাহায্য করেছে তার দুই বন্ধুও। স্ত্রীর পরকীয়ার জেরেই নাকি এমন পরিণতি বলে জানা গিয়েছে। এই একটা খুনকে ঘিরে নিমেষের মধ্যে উঠে আসে আরও তিনটে মানুষের মনের ছবিটা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা অপরাধগুলোকে নিয়ে। আজকের এই ঘটনার দায় তো নিছক বর্তমান সময়ের নয়। অতীতেও থরে থরে সাজানো রয়েছে এমন হাজার অপরাধপ্রবণতা। সেগুলিকে এক মালায় গাঁথতে না পারলে হয়তো অধরাই থেকে যাবে সমাজের অন্ধকার জগৎটা। যার ভার বহন করতে হবে ভবিষ্যতকেই।
আরও পড়ুন : নৃশংস খুনের আসল কারণ কী, জানতে নার্কো টেস্ট আফতাবের! ঠিক কীভাবে হয় এই পরীক্ষা
গতমাসে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে DAHMER - Monster: The Jeffrey Dahmer Story লিমিটেড সিরিজ। সিরিজটির সব থেকে আকর্ষণীয় দিকটি হল, শতভাগ না হলেও বেশিরভাগটাই বাস্তব ঘটনার পরিপেক্ষিতে বানানো। ১৯৭৮ সাথে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জেফরি ডাহমার মোট ১৭ টা খুন করে। সেই কাহিনী নিয়েই গোটা সিরিজ। এখানে দেখানো হয়েছে ডাহমার কিভাবে ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে, কেমন ছিল তার জীবন, কীভাবে সে প্রথম খুন করেছে, সেই প্রথম খুনের দেহটির সঙ্গেই বা সে কী কী করেছে ইত্যাদি। সিরিজে রয়েছে পরের পর আরও সতেরোটা খুন। যেন এহেন খুনের নেশা হয়ে দাঁড়ায় ডাহমার। শুধু খুনই নয়, মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটেও ফেলতো সে। এখানেই পর্দার সঙ্গে দৃশ্যত মিলে যায় বাস্তবের আফতাব অথবা পঙ্কজরা।
সময়টা ১৯৮৯ সাল। তিলোত্তমার ইতিহাসে একটা ভিন্ন গল্প। ভিন্ন, কিন্তু বাস্তব। খোদ লালবাজার পুলিশের সদর দফতরের একেবারে গা ঘেঁষে লালদিঘি এলাকায় রাস্তার উপর অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়ে আছে একটি মৃতদেহ। মাথার ডানদিকটা বীভৎসরকমভাবে থেঁতলানো। পাশেই পড়ে প্রায় ১০ কেজি ওজনের রক্তমাখা বড় পাথর, এটাই মার্ডার উইপেন। অপরাধী নিজেই রেখে গিয়েছে সযত্নে। এর কিছুদিন পরে একই ভাবে খুন হয় আরও দুজন। সমগ্র পুলিশ বিভাগ নড়েচড়ে বসে ঠিকই, তবে ইতিমধ্যেই পুলিশি তদন্তকে প্রায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একই কায়দায় আরও চার-চারটে খুন হয় কলকাতার পথে। তার কোনোটা শিয়ালদায়, কোনোটা বা পার্কস্ট্রিটের মতো ব্যস্ত জায়গায়। দেখা যায় প্রত্যেকবারই পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিকটিমের। যাকে বলে নিখাদ সিরিয়াল কিলিং। প্রতিক্ষেত্রেই খুনির শিকার রাস্তায় একা ঘুমিয়ে থাকা হতদরিদ্র কুলি-মজুর অথবা কোনো ভিখিরি। শুধু কলকাতা নয়, এর আগে বোম্বে শহরেও টানা ২ বছর ধরে ঠিক একই কায়দায় রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা ১২ জন নিরীহ মানুষকে পর পর খুন করে কোনো অজ্ঞাত খুনি। অর্থাৎ যেন হুবহু পুনারাবৃত্তি।
আরও পড়ুন : শ্রদ্ধার কাটা মাথা ফেলার আগে অভাবনীয় কীর্তি আফতাবের! দেহের বাকি টুকরো কোথায় কোথায় ফেলেছিলেন?
খুনি মাত্রই নৃশংস। তবুও যেন খুনের ধরনেই প্রকট হয়ে যায় খুনির চরিত্র। অপরাধ জগতে ‘স্টোনম্যান’-এর গল্প অভিনব নয় ঠিকই তবে আজকের পঙ্কজ অথবা আফতাবের আলোচনায় সে প্রসঙ্গ না টেনে উপায় নেই। স্টোনম্যানের সঙ্গে মেলে না এদের খুনের ধরন। কিন্তু এদের মধ্যে সাদৃশ্য একটাই, এরা নৃশংস অপরাধী। সিরিয়াল কিলার এরা প্রমাণিত হয়নি ঠিকই, যদিও মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই দাবি করেন, এর আগেও কোনো খুন করে থাকতে পারেন এরা, পরেও যে সুযোগ পেলে করতেন না এমন কথাও জড়িয়ে দেওয়া যায় না!
শ্রদ্ধার ঘটনা নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে ঠিক তখন জ্যোতি হত্যার ঘটনা সামনে চলে আসায় আরও স্পষ্ট হয় সমাজের অপরাধ প্রবণাতার দিকটিই। স্পষ্ট হয়, অন্ধকার জগতের অকৃত্রিম নেশায় প্রতিনিয়ত একটু একটু করে বুঁদ হচ্ছে মানুষ। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ ঘটনা ঠান্ডা মাথায় খুন নাকি মানসিক বিকৃতি? এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়তো সত্যিই সহজ নয়। তবে এ ঘটনা যে আমাদের জীবনের সম্পর্ক, প্রেম, বিশ্বাস সবকিছুকে প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন করে, তা নিশ্চিত। কতটা কথা বললে তা সীমা পেরোবে? ঠিক কখন যত্ন নেওয়া অবসেশনে পরিণত হয়? কখনই বা আগলে রাখা পরিণত হয় দমিয়ে রাখায়? উঠে আসে অজস্র সব প্রশ্ন। অপরাধ বিজ্ঞানের সঙ্গে মনবিজ্ঞানের সম্পর্কটা খানিক জটিল। তবে এ সম্পর্ক যে ভীষণ জরুরি তা আজ উপলব্ধি করছে গোটা সমাজ। পুলিশের মতো উত্তর খুঁজছে সাধারণ মানুষও। আরও একবার ঝালিয়ে নিচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাগুলোকে। এইসব অন্ধকারময় খবরে শুধু যে ভয় পাচ্ছে তাই নয়, পাশাপাশি সাবধানীও হয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত।