মৃত‍্যুতেও জয়ী ভালবাসা! ঐন্দ্রিলা-সব‍্যসাচী মানুষের মনে থেকে যাবেন অমর সঙ্গী হয়ে

Aindrila Sharma: সব্যসাচী আর ঐন্দ্রিলার প্রেমের জয়গাথা রচিত হলো সমস্ত মানুষের মনে।

মৃত্যু কেবলই মিথ্যা হোক, ভালবাসা জিতুক রোজ! জিতলেন ওঁরা জিতলেন। কিন্তু মৃত্যুকে সত্যি করেই ভালবাসার জয়ধ্বনি গাইলেন ওঁরা। সব্যসাচী আর ঐন্দ্রিলার প্রেমের জয়গাথা রচিত হলো সমস্ত মানুষের মনে। জনতার সমস্ত উদ্বেগ আর বেদনার মধ্যেও ছড়িয়ে রইলেন সব্যসাচী। সমস্ত পুরুষ-বঞ্চনা, বেদনা আর আফতাবদের আধিক্যেও ফের জিতলেন সব্যসাচীরাই।

কিন্তু সব্যসাচী ছাড়া একা থাকতে যাঁর বিরক্ত লাগত, দূরে দূরে সরে থাকতে যাঁর ভয় করত, সেই মেয়েটিই যে আজ আর নেই! শেষ হয়েছে ভালবাসার পার্থিব স্পর্শও। কিন্তু শত শত যন্ত্রণা আর কথকতার মাঝেও রয়েছেন সব্যসাচী। যাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষের না থাকার মাঝেও আজ সোশ্যাল-দুনিয়াজুড়ে উচ্চারিত হচ্ছে এই প্রেমিকের নাম!

২০১৭ সাল। ততদিনে প্রথম যুদ্ধজয় করে ফেলেছেন বহরমপুরের ঐন্দ্রিলা শর্মা। চিকিৎসক পরিবারের মেয়ের ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল শিল্পী হওয়ার। নাচকে ধ্যানজ্ঞান করে এগোচ্ছিলেন তিনিও। বাধা আসেনি কোনও দিন। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় মাথাচাড়া দিল মারাত্মক বিপদ। মারণরোগ ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন ঐন্দ্রিলা। তারপর লড়াই। চিকিৎসা। প্রথম যুদ্ধ জিতেই কলকাতায় পা রাখলেন তিনি। দেখা হল সব্যসাচীর সঙ্গে। 'ঝুমুর' ধারাবাহিকে কাজ। একসঙ্গে কথা, সেই প্রথম দেখা অল্প দিনেই পরিণত হল গভীর বন্ধুত্বে। তারপর ভালবাসা।

আরও পড়ুন: ঐন্দ্রিলা, এই চিঠি আপনাকে

আর পিছন ফিরে তাকাননি ওঁরা। একদিকে সব্যসাচীময় হয়ে উঠলেন ঐন্দ্রিলা। অন্যদিকে ঐন্দ্রিলার জীবনমঞ্চে হাজির হলেন সব্যসাচী। একসঙ্গেই চলল কাজ। ভালো থাকা আর ভালবাসাবাসি সঙ্গী করেই এগোলেন ওঁরা।

২০১৯
সব্যসাচী চৌধুরী তখন বাংলা টেলিভিশন-দুনিয়ায় পরিচিত মুখ। ঐন্দ্রিলাও কম যান না! এই বছরেই সব্যসাচীর জীবন মোড় নিল নতুন করে। এক জনপ্রিয় বিনোদন চ্যানেলের একটি ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র হিসেবে কাজের সুযোগ পেলেন তিনি।

একদিকে 'লক্ষ্মী মেয়ে' ঐন্দ্রিলার সাহচর্য, অন্যদিকে অভিনয়ের সেরা উপহার। সবমিলিয়ে ভালো দিন দেখলেন সব্যসাচী। 'মহাপীঠ তারাপীঠ' ধারাবাহিকের বামাচরণ ততদিনে জনপ্রিয়তার শিখরে। বঙ্গের ঘরে ঘরে পর্দার বামা হয়ে উঠেছেন জীবন্ত।

২০২০
রমরমিয়ে চলছে সব্যসাচীর কাজ। সঙ্গে মঞ্চের টুকটাক অভিনয়। ঠিক সেই সময়েই ফের বিপদের সম্মুখীন হলেন ঐন্দ্রিলা। মুহূর্তেই স্তব্ধ হলো সব! আবারও ক্যানসার আক্রান্ত হলেন অভিনেত্রী। এবার মারণ-অস্ত্রে বিদ্ধ হলো তাঁর ফুসফুস। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উঠে এলেন এক অন্য সব্যসাচী। মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেল তাঁর নাম।

এক ক্যানসার-বিধ্বস্ত, অসহায় মানুষের জীবনের প্রধান সম্বল, অন্যতম অবলম্বন হলেন পর্দার বামাক্ষ্যাপা। শুটিং ফ্লোর থেকে হাসপাতাল। রাতজেগে গল্প শোনানো থেকে কেমোথেরাপির কষ্টের পরেও প্রেমিকাকে খুশি রাখার চেষ্টা। এক অন্য প্রেমের গল্প বুনল ফের। ভিন্ন প্রেমের নতুন সুতোয় সব্যসাচী আর ঐন্দ্রিলার অস্তিত্ব ধরা দিল অন্যভাবে। সোশ্যাল-দুনিয়ার তীব্র প্রচারেও এই জুটি হয়ে উঠলেন অভিনব। একাকীত্ব আর হানাহানির জগতেও সব্যসাচী আর ঐন্দ্রিলা হলেন মৌলিক।

কিন্তু সুখ আর সইল কই...

১ নভেম্বর। আচমকা জ্ঞান হারালেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা। সঙ্গে সেই সব্যসাচী। খানিকটা সামলে নেওয়ার পরেও আচমকা বিপদে অতিষ্ঠ হলেন ওঁরা। তড়িঘড়ি হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হল ঐন্দ্রিলাকে। কিন্তু রাতজাগা? ফের প্রেমিক-সত্তার নিঃস্বার্থ বিকাশ ঘটিয়ে হাসপাতালেই ঘাঁটি গাড়লেন সব্যসাচী। সব ছাড়লেন। লক্ষ্য শুধুই ঐন্দ্রিলা। প্রথমে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের বাইরের করিডোর। পরে তাঁর স্পর্শে সুস্থ হচ্ছেন প্রেমিকা, এই আশাতে শয্যার পাশেই। চলল প্রার্থনা আর লড়াই।

একের পর লড়াই আর ফিরে আসার কথা লিখতে থাকলেন সব্যসাচী। অবাক হল বিশ্ব। একদিকে ভালোবাসার মানুষের মরণবাঁচন লড়াই, অন্যদিকে নিজের মনকে উদ্বুদ্ধ করার অভিনব যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন সব্যসাচী।

সংবাদমাধ্যমের 'বিড়ম্বনা' এবং সোশ্যাল-দুনিয়ার গুজবে জর্জরিত হয়েও আশার কথা শোনালেন এই প্রেমিক! বারবার বলে চললেন, 'ও ফিরবেই, ও উঠবেই।' কিন্তু আর উঠলেন কই!

কতটা ভালবাসলে তবে এমন বলা যায়! কতটা সঙ্গে থাকলে তবে এমন করা যায়! এই প্রশ্নের দাবানলে পুড়লেন সব্যসাচী। আর রাখলেন ভালোবাসার মিলনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেকেই বলছেন, এটাই তো কর্তব্য। দায়বদ্ধতা। তিনি ভালোবাসেন, ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি এলেও তো সেটাই করতেন!

আবার কেউ কেউ বলছেন, ঐন্দ্রিলা আর সব্যসাচী নয়, এমন করে এই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে আসলে সব্যসাচী দেখিয়ে দিয়ে গেলেন ভালবাসায় মজে আসলে কী করতে হয়। কোটি কোটি বিচ্ছেদের মায়াজালেও তিনিই বিছিয়ে দিলেন এক ফুলের শয্যা। যা ঐন্দ্রিলার বিদায়ের বশেও রেখে গেল কথকথা। আর ফেলে গেল প্রেমজ ইতিহাসের এক ছেঁড়া পাতা। যা বলে চলল নিরন্তর,  'ভালোবাসা আপন করে নিও আমায় রোজ, তোমার সঙ্গে চলতে গিয়ে যদি হই ফের নিখোঁজ!'

কিন্তু যাঁকে নিয়ে আজ এত আলোচনা। যে মানুষটির ভালবাসার নিদর্শনে আজ বিভোর সোশ্যাল-দুনিয়া। কে তিনি? কে এই সব্যসাচী চৌধুরী?

হাওড়ার বেলুড় এলাকার বনেদি পরিবারের সন্তান সব্যসাচী। বরাবর প্রতিপত্তিশালী চৌধুরীদের পুত্র পড়াশুনায় ছিলেন মেধাবী। বিদেশে উচ্চশিক্ষা। ইংল্যান্ডের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ব্রুক্স থেকে ডার্ক ট্যুরিজমে স্নাতকোত্তর। পড়া শেষ করে ইংল্যান্ডেই প্রশিক্ষণ। কাজ শুরু। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জীবনকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে নতুন করে দেখার তাগিদে, কিছুদিন ইংল্যান্ডে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফিরলেন দেশে। বারণ করলেন পরিবারের অনেকেই। কিন্তু সব্যসাচী চলে এলেন নিজের দেশে।

অভিনয়ে হাতেখড়ি
থিয়েটারের সংক্ষিপ্ত-পর্ব কাটিয়ে বরাবর মৌলিক প্রতিভার বশে, সব্যসাচী পা দিলেন অভিনয় জগতে। 'এসো মা লক্ষ্মী' ধারাবাহিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু হল পুরোদমে কাজ। সেইভাবে আর কেরিয়ারের জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কেরিয়ারগ্রাফে তখন তীব্র লড়াই চললেও স্বপ্নের মায়াজালে সব্যসাচী ছিলেন বিভোর। এলো একের পর এই সুযোগ। 'অগ্নিজল' ধারাবাহিকে অভিনয়। বড় সুযোগ পেলেন 'ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ' ধারাবাহিকে। সেখানে যুধিষ্ঠির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় হলেন আর এক কৃষ্ণ সব্যসাচী। এরপর ২০১৭ সাল নাগাদ 'ঝুমুর' (Jhumur) ধারাবাহিক। যা সব্যসাচীর পরিচয়ে আগমন ঘটালো প্রেমিক সত্তার। বরাবর ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারাবাহিকের অভিনয়-খোলস ছাড়িয়ে সব্যসাচী হয়ে উঠলেন অনন্য। অনবদ্য। সঙ্গে তখন নবীন অভিনেত্রী, বন্ধু ঐন্দ্রিলা। এরপর 'ওম নমঃ শিবায়' ধারাবাহিকে বিষ্ণুর চরিত্র। 'জড়োয়ার ঝুমকো'য় অর্ণবের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতেই এল বড় সুযোগ। 'সাত ভাই চম্পা'য় পেলেন রাজা নক্ষত্রজ্যোতির চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব। তারপর সব্যসাচীর অভিনয়-জীবনে ঝড় আনল' মহাপীঠ তারাপীঠ' (Mahapeeth Tarapeeth) ধারাবাহিক। দীর্ঘদিন চলা এই পর্বে বামাক্ষ্যাপার (Bamakshyapa) চরিত্রে দাগ কাটলেন সব্যসাচী। হাওড়ার মেধাবী ছেলেটির অভিনয় মেধা দেখল রাজ্য। ঘরে ঘরে আলোচিত হল বামার নাম। ঈশ্বর, ভক্তি আর বামাচরণ চক্রবর্তীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় তাক লাগাল বারবার। অতি জনপ্রিয় হলেন সব্যসাচী চৌধুরী। তারপর একাধিক ওয়েবসিরিজ, বিজ্ঞাপন, শর্ট ফিল্ম-এ অভিনয় ইন্ডাস্ট্রিতে কদর বাড়িয়েছে তাঁরও। সম্প্রতি বন্ধু ঐন্দ্রিলার সঙ্গেই 'ভাগাড়' ওয়েব সিরিজে তাঁর অভিনয় নজর কেড়েছে ফের।

প্রেমিক সব্যসাচী
২০১৭ সালে বহরমপুর থেকে আসা ২০ বছরের নবীন অভিনেত্রী যে মেয়েটির হাত ধরেছিলেন তিনি। যে 'ঝুমুর' ধারাবাহিকে হওয়া পরিচয়ে প্রেমের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন সব্যসাচী, তার বিচ্ছেদ ঘটেনি আজও। প্রেমিকা ঐন্দ্রিলার জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর হিসেবে বারবার উঠে এসেছে তাঁর নাম। আজ যে সব্যসাচী রাতের পর রাত জাগছেন হাসপাতালের করিডরে। এই সব্যসাচীকেই দেখা গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা দ্বিতীয়বার ক্যান্সার আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে থাকতে। যে কর্তব্য তিনি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে করেছেন! সাধারণভাবে এই প্রশ্ন উঠলেও আসলে প্রেমিক সব্যসাচীর এই ভূমিকা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিচ্ছেদ-মিলনের দোলাচলে দুলতে থাকা বিশ্বকে।

ঠিক কী করেছিলেন তিনি?
অনেকেই বলেন, প্রেমিক হিসেবে, প্রেমের জন্য, সম্পর্কের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য যা যা প্রয়োজন, বিনা স্বার্থে যেটুকু করা প্রয়োজন সকলের, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন তিনি! কেন? ঐন্দ্রিলার ভেঙে পড়ার মুহূর্তে ভরসা জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সব্যসাচী। যা প্রিয়ের জন্য সর্বাধিক দরকার শুধু নয়, কাছের মানুষের বিপদের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনও। আর সেই মৌলিক চিত্রই দেখেছে এই দেশ। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন তাঁরা। যা তাঁদের কাছে ব্যক্তিগত, অতি সাধারণ, তাই-ই যেন দূরত্বের পৃথিবীতে হয়ে উঠেছে বিরল। সব্যসাচীময় হয়েছেন ঐন্দ্রিলা। আর জীবনের 'বিগবস' ঐন্দ্রিলা জড়িয়েছেন সব্যসাচীকে।

'অন্য' সব্যসাচী
'দৃষ্টি একই থাকে, দৃষ্টিকোণ বদলায় বারবার।' মৌলিক অভিনেতা সব্যসাচীর লেখক-সত্তার প্রথম নিদর্শনের ভূমিকায় উঠে এসেছিল এই বাক্যই। ২০২২ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় তাঁর হাত ধরে বার্তা প্রকাশনের তরফে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা প্রথম বই 'দলছুটের কলম'। সব্যসাচী বলেছিলেন, ''বরাবর ফেসবুকে লিখতাম। নিজের কথা বলতাম। অনেকেই বলতেন বই হিসেবে প্রকাশের। অবশেষে ইচ্ছাপূরণ। বই বেরোলো।'' যে বই লেখার রসদ ছিলেন প্রেমিকা ঐন্দ্রিলাও। যিনি বই পড়তে খুব একটা ভালো না বাসলেও সব্যসাচীর বই লেখার তাগিদ, উপকরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। এই বই মূলত, বিভিন্ন সময়ের অনুভূতির কথার সমষ্টি। 'বামাক্ষ্যাপা'র টেলিভিশনপর্ব শেষ হতেই বই লেখার কাজ শেষ করেন সব্যসাচী। বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই। যা সমাদৃত হয় পাঠক মহলে।

'ব্যবসায়ী' সব্যসাচী
চলতি বছরেই বন্ধু, জনপ্রিয় অভিনেতা 'মন্টু পাইলটে'র সঙ্গে হাত মেলান 'বামা'। সৌরভ দাসের সঙ্গে মিলে সল্টলেকের সেক্টর একে খোলেন একটি রেস্তোরাঁ। 'হোদোলস্' নামের ওই রেস্তোরাঁর মাধ্যমে সব্যসাচী শুরু করেন নতুন কাজ।

More Articles