ঐন্দ্রিলা, এই চিঠি আপনাকে

Aindrila Sharma: ২৪ বছরের জীবন যখন সকলকে লড়াই শিখিয়ে যায়, তখন বেবাক হয়ে স্ট্যান্ডিং অভেশান দিতে হয়, খেলার এটাই নিয়ম।

ঐন্দ্রিলা,

যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের, তার সঙ্গে আমাদের যে কখনও দেখা হবে না, কবি তা আগেই অনুমান করেছিলেন। ফলে আমরা বাঁচছি। কিন্তু বাঁচছি না বহু বছর। কিন্তু বাঁচা আসলে যে কী অসীম, এই আলোক পরিব্যপ্ত গোলকধামে টিকে থাকতে নেওয়া প্রতিটা শ্বাস যে কত মহার্ঘ, আপনি বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ঐন্দ্রিলা। আপনার সঙ্গে আমার কোনও সংলাপ হয়নি কখনও। প্রথম আপনার ব্যাপারে জানলাম, আপনার অসুস্থতার সময়েই। প্রথম ধাপটায় আপনি লড়ে ফিরে এসেছিলেন, সহকর্মীরা খবর করেছেন, আমাদের মুখে আলো খেলে গেছে, হাসির আলো, জীবনের আলো। ক্রমে জানা বাড়ল যখন আপনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একটা সময় বিষয়টা উদ্বেগ হয়ে দাঁড়াল। পরিবারের নিকটজন অসুস্থ হলে যেমন হয়। ভেবেছিলাম আরও কিছুক্ষণ, কিছুদিন থাকবেনই। কেউ বলছে প্রার্থনার জোর, কেউ বলছে বিজ্ঞান। আমি কিছুই বলতে চাইনি। শুধু মন বলছিল, রহো, রহো। কিন্তু থাকো বললে কে আর কবে থেকেছে। এখন আপনার আয়ুপথের দিকে তাকিয়ে দেখছি, ভাবছি, একজন দূরের মানুষ, এত অল্প সময়ে কত কী শিখিয়ে গেল, আমাকে, আমাদের!

হ্যাঁ, ঐন্দ্রিলা আপনি আমাদের আরও একবার যাওয়ার আগে বলে দিয়ে গেলেন, জীবন, মরণের চেয়ে অনেক বড়। মৃত্যু একটা ঘটনা। অনিবার্যতা। কিন্তু তার চেয়ে অনেক মহৎ বাঁচতে চাওয়া। বাঁচাতে চাওয়া। ফুটবল মাঠে যেমন হয়, একটা হেরে যেতে থাকা দল হাফটাইমের পরে একটা গোল দিয়ে খেলায় ফিরল, শেষ পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যায় ১১ জন, যদি খেলা ঘোরে, এবারে তেমনটাই হচ্ছিল। কে যেন বলে যাচ্ছিল, দম রাখো খেলা ঘুরবে। আমরা যারা চিরকালের হেরো, রিফিউজি, বাঙালি, মফসসলি, পেশায় ব্যর্থ, আমরা সবাই যে যার মতো করে দম রাখছিলাম। ব্যক্তি আপনি, মৃত্যুতে তো নয়, জীবনে, মহাজীবনের স্রোতে আমদের এই হেরোদের জুড়ে দিয়েছিলেন। আপনি রইলেন না। আমরা যারা রইলাম, আপনার নামহীন শুভাকাঙ্ক্ষীরা, নিলাম জীবনের বীজমন্ত্র:

আমি ভয় করব না ভয় করব না।

দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না

তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে--

তাই ব'লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না ॥

ম্যাচটা খেলতে হয়, হারি জিতি, দাপিয়ে খেলতে হয়। আঘাত সয়েই খেলতে হয়। খেলাটাই আসল। হারা-জেতা নয়। শিখিয়েছেন আপনি। স্কোরবোর্ড গাধা, প্রমাণ আপনি। ঐন্দ্রিলা আপনার জীবন, অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকা জীবন এই পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বড়। সর্বব্যাপী। যতদিন জীবন আছে, ততদিন আপনার লড়াইটা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। মহাকাব্য কবে সুখের হয়েছে, বিয়োগান্তক পরিণতি জেনেই তো সিসিফাস পাথর বয়ে চলে, মেঘনাদ অস্ত্র তুলে নেয়। আমাদের, অতি সাধারণের, হাটবাজারের সাধারণ মানুষের জীবন মহাকাব্যের অভিমন্যু আপনিই‌। আমরা সকলে যেমন, আপনিও তেমন জানতেন না ফেরার পথ, কিন্তু শেষ আঘাতটা পর্যন্ত বুক দিয়ে সয়েছেন। ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রত্যাঘ্যাত। মৃত্যুর সাধ্য কি আপনাকে হারায়! এসব কথা লিখে রাখতে হয় বইকি। ২৪ বছরের জীবন যখন সকলকে লড়াই শিখিয়ে যায়, তখন বেবাক হয়ে স্ট্যান্ডিং অভেশান দিতে হয়, খেলার এটাই নিয়ম।

আমাদের দিনকাল বেরঙিন বহুদিন। আমাদের আর কিছুতেই আস্থা নেই। ভেঙে পড়া, নুইয়ে আসা বিশ্বাস নিয়ে আমরা স্রেফ টিকে থাকি কোনও ক্রমে। এই আমরা আপনার লড়াইয়ের দিনগুলিতে দেখছিলাম আপনার প্রেমিকের লড়াই। এমন নাছোড়বান্দা মানুষ আজ আর খুঁজে পাওয়াই যায় না। অঘটনের সম্ভাবনা তিনি কি জানতেন না? সবার চেয়ে ভালো জানতেন। ডাক্তারদের সঙ্গে প্রাত্যহিক যোগাযোগে তিনিও তো ছিলেন। তবু, আমাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জোয়াল অনেকটা টানলেন তিনি। আজ আপনি যখন চলে যাচ্ছেন, ততক্ষণে আমরা ফের জেনে গেছি, ভালবাসায় অকালশ্রাবণ ঘনায়, প্রেমের স্পর্শে থাকে আকাশভাঙা চিৎকার: যেতে নাহি দিব। তারপরেও কেউ চলে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে কত পাথরে যে সে ফুল ফুটিয়ে যায়, সে কি জানে?

আপনার থাকা না থাকার চেয়ে অনেক বড় হয়ে রইল এই শেখাগুলি, আপনার লড়াইটা। স্রেফ একজন ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই শিখল, বাঁচতে হবে, ভালবাসতে হবে পদ্মপাতায় জল এই জীবনকে, হাত ধরতে হবে সহযাত্রীর, লড়তে হবে, লড়াইটাই মহাকাব্য। ফেসবুক প্রমাণ, আপনার প্রেমিকের সঙ্গে রাত জেগেছে লাখো মানুষ। যে জীবন ছকের, পিছনে টানার, কাঠির, সে জীবন পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আজও আছে, অন্যের জন্য আজও এতটা পথ যায় কেউ, আপনি এভাবে না লড়লে এই বিশ্বাসে দাঁড়াতে পারতাম না কিছুতেই। কাজেই, সব বৃথা তোমায় ছাড়া, এই ক্লিশে কথাটা আপনার জন্য বলব না। আপনি তো রইলেনই, পল-অনুপল শ্বাসে-প্রশ্বাসে, মৃত্যুর মতো টু-পাইসের থেকে অনেক বড় হয়ে, একটা মধুরতুমুল আইডিয়া হয়ে। চোখের জলের সেতু হয়ে। টুপি খুলে এ রবাহুত জীবন স্যালুট করছে আপনাকে। স্রেফ আপনাকেই।

ইতি,

আমরা যারা ভালবাসতে শুরু করেছি

More Articles