পুরনো মদ নতুন বোতলে: যে কারণে এত আগ্রহ এই ওয়েব সিরিজগুলি নিয়ে

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যখন প্রথম ভারতে খাতা খুলতে শুরু করেছিল, কেউই তেমন নিশ্চিত ছিল না এই মাধ্যম নিয়ে। কিন্তু এখন ভারতের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির এক অন্যতম অংশ হয়ে গিয়েছে এটি। আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, হটস্টার, ভুট, জি ফাইভ, অল্ট বালাজি ইত্যাদি নানাবিধ প্ল‍্যাটফর্ম নিজস্ব সিরিজ ও সিনেমার একটা বড় বাজার গড়ে তুলেছে। প্রাথমিকভাবে নেটফ্লিক্স যখন এল, তখন তার আন্তর্জাতিক সম্ভারই ছিল বেশি। অনুরাগ কাশ্যপের বিখ্যাত ছবি 'গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর' ১ ও ২-কে এপিসোডে ভেঙে সিরিজ হিসেবে দেখানো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেটফ্লিক্সে। কিন্তু ভারতে তখনও ওয়েব সিরিজের পরিসর তৈরি হয়নি। প্রায় চুপিসারেই তৈরি হয়েছিল রামগোপাল ভার্মার 'গানস অ্যান্ড থাইস', কিন্তু ওটিটি-র মুক্ত বাজারেও প্রদর্শন সম্ভব হয়নি সেই সিরিজের। যৌনতা ও ভায়োলেন্সের কড়া ডোজ হজমই করতে পারেনি ভারতের তৎকালীন ওটিটি মালিকরা, ফলত, দর্শকের কাছে একেবারেই পৌঁছয়নি সেই সিরিজ। এরপর বলা যেতে পারে ভারতের প্রথম উল্লেখযোগ্য ওয়েব সিরিজটি নির্মিত হয় অল্ট বালাজি-র জন্য। একতা কাপুরের প্রযোজনায় নির্মিত হয় সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে সিরিজ, 'বোস: ডেড অর অ্যালাইভ'। নামভূমিকায় রাজকুমার রাও। কিন্তু ভারতে ওয়েব সিরিজের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ তখনও স্পষ্ট হয়নি। 

কিন্তু ছবিটা আমূল বদলে গেল ২০১৮ সালে। অনুরাগ কাশ্যপ আর বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে-র পরিচালনায় ‘স্যাক্রেড গেমস'-এর প্রথম সিজন নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুঙ্গে উঠল আলোড়ন। এবং ক্লিফহ্যাঙ্গার নিয়ম মেনে এই সিরিজ দর্শককে অপেক্ষায় রাখল পরবর্তী সিজনের জন্য। 

ফলে, এলিট দর্শকের পরিধি থেকে ভারতীয় ক্রাইম থ্রিলার জঁর সাধারণ মধ্যবিত্ত অবধি একটা বিরাট অংশের মানুষের মনে ছাপ ফেলতে সক্ষম হল। দেখা গেল, সিক্যুয়েলের যে অর্থ দীর্ঘদিন ধরে বলিউড তৈরি করে আসছিল তাকে এক লহমায় ভেঙে আদতে সিক্যুয়েল ব্যাপারটা কী, তা নিয়ে একটা ধারণা গড়তে সক্ষম হল এই ভারতীয় সিরিজ, অন্তত ভারতীয় দর্শকদের কাছে তো বটেই। সইফ আলি খান, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, রাধিকা আপ্তে, কল্কি কোয়েচলিন অভিনীত 'স্যাক্রেড গেমস'-এর পাশাপাশি হইচই ফেলল আমাজন প্রাইমের ওয়েব সিরিজ 'মির্জাপুর'। 

আরও পড়ুন: হিন্দিই জাতীয় ভাষা, অজয়ের মন্তব্যের আসল কারণ কী, কতটা বেকায়দায় বলিউড

এর পরপরই কোভিড। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। মানুষ ঘরে বসে মনিটারে, টিভিতে বা স্মার্টফোনে বিনোদন উপভোগ করার দিকে ঝুঁকলেন। এই সুযোগ কাজে লাগাল ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় একের পর এক সিরিজ মানুষের মন জয় করে ফেলল। সম্প্রতি আমাজন প্রাইম নতুন একঝাঁক তারকাখচিত ওয়েব সিরিজের পাশাপাশি কয়েকটি জনপ্রিয় সিরিজের সিক্যুয়েল ঘোষণা করেছে। দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা কোনও নতুন সিরিজ ঘোষণার তুলনায় অনেকটাই বেশি।

 

পাতাললোক (১৫ মে, ২০২০)

অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত এই ক্রাইম থ্রিলার সিরিজটি ভারতের প্রকৃত চেহারা মুখোশহীনভাবে তুলে ধরতে সক্ষম। সাধারণত এই ধরনের কাজে অন্ধকার জগতের ওপর আলোকপাত এমনভাবে করা হয়, যাতে অন্ধকার জগৎকে বাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগহীন, একটি বিচ্ছিন্ন জগৎ বলে মনে হয়। আদতে কি তাই? আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সঙ্গে অপরাধ জগতের কোনও সম্পর্ক নেই? শুধুমাত্র প্রশাসনের সঙ্গেই তার বোঝাপড়া? রামগোপাল ভার্মার হাতে গোনা কয়েকটি ছবি বাদ দিলে অনুরাগ কাশ্যপই প্রথম, যিনি অপরাধীদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের দিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন নির্মোহভাবে। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-র সেই দর্শনই ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এ আমরা দেখি অনেক পরিণত রূপে। ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সাদাকালো অপরাধী— সৎ পুলিশ অফিসারের ডাইকোটমি থেকে বেরিয়ে এসে ধূসর অঞ্চলগুলিকে নিয়ে বোঝাপড়া করে ‘পাতাললোক’। মানুষকে ‘মহৎ’ ইত্যাদি অবাস্তব গুণে মহিমান্বিত না করে মানুষ হিসেবে দেখে। কিংবদন্তি নয়। তাই প্রধান চরিত্র হাথিরাম চৌধুরী রক্তমাংসের মানুষ। তাঁর অনুসন্ধানের কেন্দ্রে প্রধান চরিত্রেরাও তাই। রহস্যময়তার প্রেক্ষাপট এই সিরিজে গভীরভাবে তৈরি হয়। 

সিরিজটি নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক তৈরি হয়। কারণ, দলিতদের ওপর ঘটে চলা ক্রমাগত হিংসার ঘটনা, মুসলমানদের ওপর নিগ্রহ সবই অপরাধের পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে উঠে আসে। একই সঙ্গে টানটান বুনোট, জয়দীপ আহলাওয়াত বা অভিষেক ব্যানার্জির অসামান্য অভিনয়, নীরজ কবি এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় দক্ষতা সিরিজটিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। শিগগিরই সিরিজের দ্বিতীয় সিজন আসছে, ঘোষণা করেছে আমাজন প্রাইম ভিডিও। সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন আদৌ হবে কি না, এই নিয়ে দর্শকদের সংশয় ছিল, সেই জল্পনার অবসান ঘটল।

 

দ্য ফ্যামিলি ম্যান (২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)

প্রাইম ভিডিওর জনপ্রিয় সিরিজের তালিকায় ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর স্থান ওপরের দিকেই। ২০১৯ সালে প্রথম যখন সিরিজটি রিলিজ করে, তখনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিরিজটি। কিন্তু শেষ অংশটি নিয়ে খুশি ছিলেন না অনেকেই। গত বছর দ্বিতীয় সিজন মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সিরিজের জনপ্রিয়তা যেরকম হু হু করে বাড়তে থাকে, তাতে সিরিজটি খুব কম সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ গঠনের দিক থেকে ‘পাতাললোক’-এর মতো অতখানি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন সিরিজ নয়, যা সবরকমের দর্শকের কাছেই নিজের নিজের মতো আবেদন রাখে, সিরিজটি আদ্যন্ত এসপিয়োন্যাজ থ্রিলার। সঙ্গে রয়েছে কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম জাতীয়তাবাদের মশলা। ফলে ভারতের মতো দেশে এই সিরিজ যে ব্যাপক জনপ্রিয় হবে, বলাই বাহুল্য। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের সমালোচনার সুযোগও ছাড়েননি চিত্রনাট্যকাররা।মনোজ বাজপেয়ী এবং সামান্থা রুথের অসাধারণ অভিনয়ের তারিফ করতেই হয়। সামান্থা রুথের রাজি চরিত্রটি দ্বিতীয় সিজনের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ। এই সিরিজেরও তৃতীয় সিজনের ঘোষণা করেছে আমাজন। দ্বিতীয় সিজনের শেষে ইঙ্গিত ছিল, কলকাতা থেকে শুরু হতে পারে তৃতীয় সিজন। তাছাড়া এই সিজনে অভিনয় করতে পারেন বিজয় সেতুপতি, এমনও শোনা যাচ্ছে। 

 

পঞ্চায়েত (৩ এপ্রিল, ২০২০)

ভারতের যে ক'টি ওয়েব সিরিজ অপরাধ জগত বা খুনোখুনি ছাড়াই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ‘পঞ্চায়েত’ তার মধ্যে অন্যতম। শুধুমাত্র কমিক উপাদান ও নিতান্ত বাস্তব কিছু ঘটনা দিয়েও যে সুন্দর ওয়েব সিরিজ তৈরি সম্ভব, তার উদাহরণ এই সিরিজটি। এক ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে সুযোগ না পেয়ে একটি সরকারি চাকরি নেয়। দু'টি রাজ্যের সীমায় অবস্থিত উত্তরপ্রদেশের একটি কাল্পনিক গ্রাম ফুলেরা। সেখানে পঞ্চায়েতের মুখ্য সচিবের পদে বহাল করা হয় তাকে। শহরের ছেলে গ্রামে এসে যাবতীয় রোমান্টিসিজম ভেঙে যেসব অতি বাস্তব সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়, তাই নিয়েই এই সিরিজ। অন্যতম আকর্ষণ রঘুবীর যাদব এবং নীনা গুপ্তার অভিনয়। জিতেন্দ্র কুমার যে অসাধারণ চরিত্রাভিনেতা, তাই নিয়ে কারওরই কোনওরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। সব মিলিয়ে গ্রামের সাধারণ বোধের সঙ্গে শহরের এক ব্যর্থ জীবনের যে দ্বন্দ্ব, যেখান থেকেই একরকম ভালবাসাও তৈরি হচ্ছে এই মানুষগুলির মধ্যে, এই নিয়েই এগিয়ে চলে সিরিজটি। সম্প্রতি দ্বিতীয় সিজনের ঘোষণা হয়েছে ‘পঞ্চায়েত’-এর।

 

মির্জাপুর (১৬ নভেম্বর, ২০১৮)

প্রাইম ভিডিওর এই সিরিজটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়। যদিও চিত্রনাট্য থেকে রাজনীতি– সবদিক দিয়েই সিরিজটি তুলনামূলকভাবে বাকিদের তুলনায় দুর্বল। কিন্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে সেকথা বলা চলে না। পঙ্কজ ত্রিপাঠি, আলি ফজল, বিক্রান্ত মাসে, শ্বেতা ত্রিপাঠি, দিব্যেন্দু শর্মা বা রসিকা দুগলের অভিনয় এই গোটা সিরিজের প্রাণশক্তি। সঙ্গে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া জগতের গল্প। একরকম হিংসা, যৌনতা ও গালাগালির মশলাতেই সিরিজটি মানুষকে টেনে রাখে। অখণ্ডানন্দ ত্রিপাঠি তথা কালীন ভাইয়ার সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের পণ্ডিত ভাতৃদ্বয়ের দ্বন্দ্ব- একে কেন্দ্র করেই গল্প আবর্তিত হয়। ‘পেয়ার কা পঞ্চনামা’-খ্যাত দিব্যেন্দুর অভিনয়ও এই সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ। এক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল, প্রথম সিজনের তুলনায় দ্বিতীয় সিজনের উন্মাদনা ছিল অনেকটাই বেশি। প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল দ্বিতীয় সিজন। সম্প্রতি তৃতীয় সিজনের ঘোষণা হয়েছে মির্জাপুরের। দ্বিতীয় সিজনে একটি নির্দিষ্ট মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল গল্প। কী হতে পারে তৃতীয় সিজনে, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে।

তা বাদেও ‘মেড ইন হেভেন’ বা ‘মুম্বই ডায়েরিজ’- দ্বিতীয় বা পরবর্তী সিজনের ক্ষেত্রে বরাবরই বেশি উত্তেজিত মানুষ। একরকম বিনা স্টারকাস্টে এই ধরনের জনপ্রিয়তা সম্ভবত ওটিটি-রই অবদান বিনোদন জগতে। আলি ফজলের ‘ফুকরে’ যথেষ্ট সমাদৃত, কিন্তু এই ধরনের জনপ্রিয়তা ছিল না, যখন সে 'মির্জাপুর' করছে। পঙ্কজ ত্রিপাঠি অবশ্য ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ থেকেই একের পর এক কাজ করে আসছেন, কিন্তু প্রধান চরিত্রে এত জনপ্রিয় হননি ‘মির্জাপুর'-এর আগে, 'স্যাক্রেড গেমস' সিজন ২ পরে এসেছে। অভিনয়-ক্ষমতা থাকলে যে খ্যাতির তেমন প্রয়োজন হয় না, এই বিষয়টি নতুনভাবে তুলে আনছে ওটিটি। নানা স্থানের, নানা বয়সের, নানা সংস্কৃতির মানুষের কাছে এক এক রকম আবেদন রাখছে সিরিজগুলো। এবং নতুনের থেকেও আগের গল্পের পরে এবার নতুন কী?— এই জিজ্ঞাসা যেন অনেক বেশি কাজ করছে করছে মানুষের মনে। অন্তত, নতুন সিরিজের থেকে দ্বিতীয় সিজন বা সিক্যুয়েলের এত বেশি জনপ্রিয়তা সেই ধারণাকেই যেন সমর্থন করছে।

More Articles