হিন্দিই জাতীয় ভাষা, অজয়ের মন্তব্যের আসল কারণ কী, কতটা বেকায়দায় বলিউড

দিন কতক আগে সৌরভ শুক্লা সামাজিক মাধ্যমে একটি মন্তব্য করেন। “আরআরআর, কেজিএফের মতো সিনেমা বানালে আমাদের ছেলেদের ওই গুটখাই বেচতে হবে”, কটাক্ষ ছিল একটি তামাক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন নিয়ে। অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগণ এবং শাহরুখ খানকে দেখা গিয়েছিল বিজ্ঞাপনে। অক্ষয়ের ছবি অবশ্য মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রচার হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর ক্যানাডার নাগরিকত্ব নেওয়ার পর থেকেই। শেষ ছবি ‘বচ্চন পাণ্ডে’ ‘পুষ্পা’র হাওয়ায় কিছুটা চলেছে, বলা চলে। কিন্তু ‘পুষ্পা’র সাফল্যের কাছে তা কিছুই না। অজয় দেবগণও একই পথে হেঁটে বর্তমানে দক্ষিণী সিনেমায় টাকা লগ্নি করতে করতে শুরু করেছেন।

গোটা কৃষক আন্দোলনে তাঁকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি, অথচ দেবগণের দেশের বাড়ি পাঞ্জাব। তাঁর বাবা ভীরু দেবগণ ছিলেন অমৃতসরের বিখ্যাত অ্যাকশন ডিরেক্টর ও স্টান্ট মাস্টার। বোম্বে গিয়েও চিরকাল মাতৃভাষা পাঞ্জাবিতেই কথা বলে এসেছেন। এ হেন পিতার সুপুত্র অজয় কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে যখন ট্যুইট করেন, গ্রেটা বা রিহানাকে নিজেরটা বুঝে নিতে বলেন, এতদিনের আন্দোলনকে বলেন ‘মিথ্যা প্রচার’, স্বাভাবিক ভাবেই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল পাঞ্জাব। ‘সন অব সর্দার’ ছবির ক্ষেত্রেও এ ধরনের গোল দেখা গিয়েছিল। সেটা অবশ্য বলিউডের সমস্যা। 

 ‘পুষ্পা’, ‘আরআরআর’, ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার-২’ যে ধরনের ব্যবসা করছে, হাইপ তৈরি করছে, তাতে দক্ষিণী সিনেমার জনপ্রিয়তা যে তুঙ্গে উঠেছে অস্বীকার করার উপায় নেই। সঙ্গে থাকছে বলিউডের সেই পুরনো ব্রাহ্মণ্যবাদ, পিতৃতন্ত্রের প্যাকেজ। সঙ্গে নব্য হিন্দুত্ববাদ। এবং তার পরিবেশনা উপস্থাপনা এতটাই অভিনব সমগ্র ভারতে রমরম করে চলছে সেই সব সিনেমা। কাজেই অক্ষয়, অজয় দেবগণের কেরিয়ার একরকম সঙ্কটেই বলা চলে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সৌরভ শুক্লার কটাক্ষ জায়েজ। সুদীপের ট্যুইট গায়ে লাগতে বাধ্য অজয় দেবগণের।  গত দু' সপ্তাহে ৯০০ কোটি আয় করেছে কেজিএফ চ্যাপ্টার ২।

নন্দনতত্ত্বে যাচ্ছি না, ব্যবসায়িক দিক থেকেই কিচ্চা সুদীপের  আস্ফালন যথাযথ। এ পরিমাণের আয় শেষ কোন হিন্দি ছবি করেছে তা খুঁজে দেখতে হবে। নিজের আঞ্চলিক আবেদনকে ধরে রেখে বিশ্বের কাছে ‘ভারতীয় সিনেমা’র অন্যতম মুখ হিসাবে উঠে এসেছে দক্ষিণী সিনেমা গুলির নাম। কন্নড় ভাষায়, মালয়াওলম, তেলেগু, তামিল ভাষায় একের পর এক নিজেদের অস্তিস্ত্ব জনপ্রিয় ধারার সিনেমার ইতিহাসে প্রোথিত করতে সক্ষম তারা। সেখানে বলিউডের জনপ্রিয় ধারাটি দক্ষিণের নকল করতে করতে টিমটিমে প্রায়। প্রশ্ন যদিও থাকে, দীর্ঘদিন দক্ষিণের নকল করে শর্টকাটে বাজি জিততে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারেনি তো বলিউড? এই সব সিনেমার এত হাততালি পাওয়ার পিছনে যে জনরুচি, তা বলিউডেরই নির্মাণ নয়তো? সম্ভাবনা রয়েই যায়। স্বাদ তৈরি হলে লোকে আসলটাই পছন্দ করবে বেশি এও জানা কথা। সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশই কি অজয়ের ফিরতি মন্তব্যে। 

কিচ্চা সুদীপের ‘হিন্দি আর জাতীয় ভাষা রইল না”-র উত্তরে অজয় লিখেছেন, “তবে নিজেদের ছবি তোমরা হিন্দিতে ডাব করাও কেন? হিন্দি আমাদের মাতৃভাষা, হিন্দি আমাদের জাতীয় ভাষা। জন গণ মন।” রাগ কি তবে দক্ষিণি ছবি বলিউডের তারকাদের বাজার কেড়ে নেওয়ার উপর? হিন্দিতে ডাব করাতে সে জন্যই কি বারণ করছেন অজয়? কারণ ‘আমাদের মাতৃভাষা হিন্দি’--এই অংশটি সমস্যার। কারা এই ‘আমরা’? কিচ্চা সুদীপের মাতৃভাষা হিন্দি? নাকি আপনার আমার মাতৃভাষা হিন্দি?

অজয়ের নিজের জন্যেও এ বক্তব্য খুব একটা সুবিধের না। কারণ পারিবারিক হিসেবে অজয়ের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি। এ নিয়ে পাঞ্জাবেও বিতর্ক শুরু হয়েছে। নাকি নিজের ‘পাঞ্জাবি’ পরিচিতি আর ব্যবসার ক্ষেত্রে খাটবে না বুঝে গিয়েছেন অজয়? বিশেষত কৃষক আন্দোলনের পর? নিজের কফিনে পেরেক যখন নিজেই পুঁতে চলেছেন আমাদের আর কীই বা বলার থাকতে পারে! দ্বিতীয় অংশটি প্রকৃত প্রস্তাবেই বিজেপির প্রচার এবং তথ্যগত ভাবে ভুল। দক্ষিণী ছবিতে বিনিয়োগের খেসারতও হতে পারে। একজন তারকার অন্তত ভুল তথ্য পরিবেশনের আগে আরও ভাবনা চিন্তা করা উচিত বলেই মনে হয়। কারণ ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। এবং ভারতের কোনও ‘জাতীয় ভাষা’ নেই। পাঞ্জাবের মানুষ সরাসরি অজয়কে আরএসএস-এর ভাবধারা দেশে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্তও করেছেন।

আরও পড়ুন-শাহরুখের নিজস্ব স্বর্গ ‘মন্নাত’-এর অন্দর কেমন?

ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী দেশে ২২টি ‘সরকারি ভাষা’ ভাষা রয়েছে। অসমিয়া, বোরো, বাংলা, দোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নাড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কানি, মালায়লম, মণিপুরী, মারাঠি, মৈথিলি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতালি, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু ও উর্দু। কাজেই হিন্দি আলাদা কিছু নয়। বহু ভাষার মধ্যে একটি ভাষা মাত্র। ১৯৬৩ সালের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্টে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে ইংরেজি ও হিন্দি ব্যবহারের কথা বলা হয়। এই দুটি ভাষাই সংসদে, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বার্তালাপে এবং কিছু ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতেও কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। সেখানে এও বলা রয়েছে কোনও রাজ্য বার্তালাপের সময় হিন্দি গ্রহণ না করলে তার সঙ্গে ইংরেজিতেই বার্তালাপ হবে। অথচ দীর্ঘদিন হিন্দি ‘জাতীয় ভাষা’ গোছের ভুয়ো প্রচার চালানো হচ্ছে। সর্বত্র হিন্দি ব্যবহারের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। টাকা  আলাদা করে খরচ করা হচ্ছে। বাকি ভাষাগুলি সেই অবহেলিত থাকছে। এই অবস্থায় এক তারকা এই ধরনের ট্যুইট করলেন, যার মূল বক্তব্যটি ‘হিন্দিই ব্রহ্ম’ এবং শেষ বাক্যটি বাংলা।

সুদীপের উত্তর আমাদের আরো একবার এই আধিপত্যবাদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যে আধিপত্যের ভাষ্যতেই অজয় সবাইকে এক করে দেখতে চেয়েছেন, তা একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল চিন্তাভাবনারও পরিপন্থী। সুদীপ উত্তরে বলেছিলেন, “হিন্দিতে লিখেছেন, পড়তে পারছি। আমি কন্নড়ে লিখলে পড়তে পারতেন তো?” এ অভিযোগ সর্বৈব সত্যি। বলিউড কোনও দিনই আঞ্চলিকতাকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং ওয়েব সিরিজে এই আঞ্চলিক উপাদানগুলি ব্যবহারের ঝোঁক অনেকখানি বেড়েছে। বলিউড চিরকাল আঞ্চলিকতাকে ব্যঙ্গ করে এসেছে। বাংলার গত, দক্ষিণের গত, পাঞ্জাবের গত সবই হিন্দি ছবিতে কমিক এলিমেন্টে পরিণত হয়ে যায় এক আশ্চর্য উপায়ে। হিন্দি স্বমহিমায় বিরাজ করে। ‘সন অব সর্দার’ ছবিটির কিছু সংলাপ নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক তৈরি হয় পাঞ্জাবে। শিখ কৌমকে ব্যঙ্গ করে বেশ কিছু কথা বলা হয়েছিল সেখানে। যা শিখেরা অপমান হিসেবেই নিয়েছিলেন।

এদিকে ছবির মূল টার্গেটেড অডিয়েন্স ছিলেন পাঞ্জাবিরা। বেগতিক দেখে প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা চেয়ে সংলাপ গুলি বাদ দিতে বাধ্য হন অজয়। এরপরে কৃষি আন্দোলনে অজয়ের অজেয় ভূমিকা এবং বর্তমানে পালটে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে তাঁর দেশের মানুষজন একরকম তাঁর উপরে বেজায় খাপ্পা। এদিকে সুদীপের পক্ষ নিয়েছেন কর্ণাটকের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াও। এ পর্যন্ত গোবলয় ছাড়া সমস্ত রাজ্যেই নিজভাষাপ্রেমী মানুষ এই মন্তব্য সমর্থন করেননি। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে গিয়ে একাধিক ঢিল এখন অজয়ের দিকেই। আসলে মোদ্দা কথাটা হল, বাজার দখলের জন্য ঈর্ষাকাতর যুদ্ধ করে লাভ নেই। বরং দক্ষিণী ছবির সাফল্য স্বীকার করে নিয়েই হিন্দি ছবিতেও যাতে ভালো কাজ হয়, সেইটে দেখা যেতে পারে। আঞ্চলিক ছবিতেও যাতে ভালো কাজ হয় সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। তা না দেখে এমন দর্শক খেপানো মন্তব্য করলে সৌরভ শুক্লার কথার প্রতিধ্বনিই শোনা যাবে। গুটখার বিজ্ঞাপন ছাড়া দিনের শেষে আর কিছুই দাঁড়াবে বলে মনে হয় না।

More Articles