ভেসে আসা মতুয়া মোচ্ছবের সুর আর খিচুড়ির গন্ধ

গরমে মানুষ তবু ছায়ার নীচে এসে দু দণ্ডের আশ্রয় পায়, স্বস্তি পায়। আকাশের দেওতা মাঠ ঘাট পুকুর সব জ্বলিয়ে দিতে লেগেছেন। তাল পুকুরেই কেবল গাছেদের ছায়া পড়া বুক ডোবানো জল। বাদবাকি পুকুরে জল সেই কোথায় গিয়ে পৌঁছিয়েছে সে কথা আর কোন মুখে বলি। মানুষের ঘরে ঘরে এবচ্ছর রোগ বালাইয়ের যেন শেষ নেই। বাজারে গেলি তো বুকে ছ্যাঁকা লাগে! বলি এই যে আগুন লাগানো দাম হেঁকেছিস তোরা, তা বলি মানুষ খাবে কী? বউ বাচ্চা নিয়ে তোরা কি মানুষকে তিষ্ঠোতে দিবিনে! পাড়ায় কান পাতলে এমন সব আকালের দুঃখু এর তার মুখে ঘুরে ফিরে ভেসে বেড়ায়। তবু আকাল বলে কি মানুষের সাধ থাকবে না! এই তো জীবন। একটাই তো!

বাচ্চির মা তাই ফাটাফুটা সিমেণ্টের বস্তা পেতে টুল টুল করে গুল দেয়। ওর কয়লার গুঁড়ো মাখা হাতখানা তখন শ্রমের হর্ষে নিপুণ হতে চেয়েও পারে না। পেতি বচ্ছর হরি ঠাকুরের জন্ম তিথিতে এমন কীত্তন হয়। ম্যারাপ বেঁধে এই উঠোনেই তো! বচ্ছরকার পাব্বন বলো, আদিখ্যেতে বলো ওই একখানাই। এ পাড়ার ছেলেরা সব দল বেঁধে ঠাকুরনগরের মেলায় যায়। ওদের সর্দার অবশ্যি দাশু। ওই টেম্পো ভাড়া করে, চাল ডাল আলুর বস্তা ওঠায়। এমন মেলা এ তল্লাটে দুটো নেই। বাচ্চির মা মেলায় যায় না। ছেলেপুলেরা যায় যাক। ওর ওই মেলা বলো খেলা বলো সে কেবল কীর্তনের রসমোক্ষণে। এই পেল্লায় হাড়ি কড়া সব ভাড়া করতি হয় তখন। বড় বড় উনোন কেটে নিকিয়ে পোষ্কার করে রাখতি হয়। এসব কাজে কি আলিস্যি পোষায়। কত মানসের কত অশেরেদ্দা, কত কথা পেরিয়ে এই নম জন্মের কীর্তি কম্ম। তেত্তিরিশ কোটি দেওতা মাথায় থাক, ওসব দেওতাপনা ভদ্দরলোকেদের জন্যি।

বাচ্চুর মায়ের কেবল আছে হরি ঠাকুর। তেলে জলে চন্দনে হরি ঠাকুরের মুখখনা ঠিক চেনা যায় না আর, তবু তিনি আছেন। আছেন বলেই না, এমন আকালের বচ্ছরেও বাচ্চির বাপ দর করে চাল ডাল তেল নুন কেনার সাহস পাচ্ছে! সেদ্ধ আতপের খিচুড়ি হবে, রাঙা টুকটুকে কুমড়ো দিয়ে ঘাঁটা চচ্চড়ি হবে আর হবে পায়েস। বোঁদে আর বেঙনিও হোতো আর আর বচ্ছর। এ বচ্ছরে আর পেরে উঠবে না বাচ্চির মা-বাপ। ও পাড়ার নন্দ খুড়ো তো বলছিল! তোদের আবার অত নাটক কেন! কেত্তনের পয়সা জোটাতে ঘাম ছুটে যাচ্চে, এদিকে খিচুড়ি খাওয়ানো চাই। কেমন করে বোঝাবে বাচ্চির বাপে, গরীব গুর্বো মানসের মনে শক্তি দ্যালেন তিনি। নম শুদ্দুররে দ্যালেন মানুষের সম্মান। তিনি কি মানুষ? তিনি দেওতা। এসব কথা নন্দ খুড়ো ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চান। তবু কেত্তনের দিনে এমন ঘাম ঝরানো তাপেও কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে রান্নি রান্না বসায়। সে কি সামান্যি রান্না গো! চালে ডালে মিলে মিশে তার বন্ন আর গন্ধের তুলনা দিই কীসে তোমায়!

সেই টগবগিয়ে খিচুড়ি ফোটা কড়াইখানা দেখলে মানুষ টের পায়, পাব্বণের খাদ্য খাবারে মিশে আছে সোজাসাপটা জীবনের গন্ধ। সে জীবন মানুষকে খালি হাতে ফেরায় না। শাল পাতার থালায় গড়িয়ে যেতে চায় যে খিচুড়ি তার জন্ম কবে কে জানে! সেই কবে কোন বোগদাদে রান্না হতো হারিশা। ডালে গমে মাংসে মিশে যেতে যেতে সে জনিয়ে দিতে ভুলতো না, আম আদমির পেট ভরানোর খাবার এমনই। বাচ্চির মার কয়লা মাখা হাত এসব গল্প কখনও শোনেনি, যদি শুনতো, তবে ঠিক জানতো, লেভান্তে সেই কোন ইতিহাসের সড়ক পেরিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বড় বড় কড়া বসিয়ে হারিশা রান্না হতো মিশকিনদের জন্য। আহা দেশ কাল পেরিয়ে কেমন দ্যাখো গরিব গুর্বোর খাবারে কী আশ্চয্যি মিল! হরিচাঁদও জানতেন, নিশ্চয়ই জানতেন খিদের স্বাদ কেমন হয়। পালা পাব্বণ মহোৎসব সমস্ত কিছুর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষ গুলোকে তিনি বুঝি দেখেছিলেন বা। তিনি টের পেয়েছিলেন, নমশুদ্দুরের মহোৎসব না থাক মোচ্ছব আছে, ধুলোট আছে, কেত্তন আছে। এই না কত! ওই তো বিশু আর গুপি দু বস্তা আলু দে গেছে, বিনির মায়ে পায়েসের পয়সা দে গেছে। তবে না এমন সার সার পাত পড়েছে!

আরও পড়ুন-চৈতের চাঁদ আর মরিচ পান্তার দাস্তান

সেই ঠাকুরনগর থেকে বাচ্চির মাসিরা এসেছে, পিসিরা এসেছে ট্রেন ঠেলে। আসবে নাই বা কেন! বুইনের বাড়ির পাব্বণে না এলি চলে! দাঁতে মিশি ডলতে ডলতে ভাবে তন্ময় হয়ে নাম সংকেত্তন শুনছে বিরাজবালা। গলায় কণ্ঠী, গায়ে লেপটে আছে ত্যানার মতো শাড়িখান। তবু কী লাবণ্য, কী ভাব ওই চ্যায়রায়। মানুষে মানুষে ভাগাভাগি করে খিচুড়ি দেচ্ছে, ঘাঁটা চচ্চড়ি দেচ্ছে। মানুষেরা ভারী তৃপ্তিতে খাচ্ছে সেসব। কে বলবে, এমন চৈতি দিনে মানুষের জীবন শুকিয়ে গেছে! মানুষের জীবন কি অত সহজে শুকায়? শুকালে তার চলে না যে! সে তাই তাল পুকুরের মতো টলটলে বুক জলের পুকুর হয়ে দাঁরিয়ে থাকে। বুকে ছ্যাঁক লাগা হাটুরে মানুষ সেই জীবনের মধ্যেও খানিক খানিক উত্তাপ খুঁজে পেয়েছে নিশ্চয়ই, নইলে সে এমন ঘাম ছোটানো দুক্কুরে ম্যারাপের তলায় বসে পাত পেতে খিচুড়ি খাবে কেন?

খাবে মানুষের অধিকারে, খাবে খিদের অধিকারে। তুমি তার হাত থেকে লাল্টুকটুকে ডালিমখানা ছিনিয়ে নিতে পারো। খিচুড়ি তো নিয়ে নিতে পারোনি! ওই স্বর্ণাভ খিচুড়ির গন্ধে উড়ে এসে বসেছে যে মাছি সেও জানে, আজ পাব্বণের খুশি। নীল মাছির ওড়াওড়ি চলতেই থাকে চলতেই থাকে, কীত্তনের আসর আবার জমে ওঠে খোল – করতালের শব্দে। সে আওয়াজ দূর দুরান্তে ভেসে যেতে চায়। সে কেবলই মানুষকে বলে, মিশকিনকে বলে, এসো, বোসো, লাল বন্ন কুমড়োর চচ্চড়ি দে খানিক খিছুড়ি খাবে নাকি? সে তো আর জানে না। তাই সে নিশ্চয়ই বলে উঠবে, আজ তোমাদের পাব্বন বুঝি? বলতে বলতে তার পাতে ডাবু হাতা উপর করে দেবে কিশোরবেলার শ্রমক্লান্ত হাত। সে হাত সময়ের তাপে হাত পোড়ায়নি এখনও। মোচ্ছবের সুর আর গন্ধ ভেসে চলেছে ওই, ওই দূরে। সে গন্ধ মানুষকে ভালোবেসে এক থালা খিচুড়ি বেড়ে দেবে না? দেবেই তো।

More Articles