চৈতের চাঁদ আর মরিচ পান্তার দাস্তান

চৈতের দিন বড় নিদারুণ। এখনই সে মাঠকে মাঠ জ্বলিয়ে দিচ্ছে আগুনের তাপে। ওই দূরে দূরে যারা খরার চাষ দিয়েছে এ বচ্ছর, তারা সব সকাল সকাল ছায়া খোঁজে। কাদায় গোড়ালি ডুবিয়ে সার ছড়িয়ে দিচ্ছে ওই মাঠে মাঠে। দশ ছাব্বিশ দিচ্ছে কেউ কেউ বা ইউরিয়া। সবুজ ধানের দিকে তাকালে চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায় আচমকা। সারে জলে গাছেরা সব ফলফলিয়ে উঠেছে এমন চৈতি দিনেও। এসব ছাপিয়ে মাঠে মাঠে এখন কলকলিয়ে শ্যালোর জল চলেছে ওই। চাষনালা শুকিয়ে গেলে ওই তো ভরসা। আকাশের জল নামলে তবু এদিক ওদিকে ঝরণা ফোটে খানিক খানিক। তা বাদে ওই ম্যাশিনেই ভরসা করে মানুষ।

এ গাঁয়ের সম্পন্ন চাষি ফকির সাহেব সেই ফজরের নামাজ ফুরোলেই মাঠে মাঠে টহল দিয়ে বেড়ান। একেক মাঠের আল বুজিয়ে দেন একেকদিন। জল কমিয়ে ধানের গোড়া শক্ত করেন, মাটি আঁটো করেন। মাঠ চরা পাখিরাও ওনাকে চেনে। বকের ঝাঁক ওনার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় ওই। আহিরি কলাইয়ের ক্ষেত পেরিয়ে ওরা এবার ওই নদীর পাড়ের গাছ গুলোয় ঝিমোবে খানিক। চৈতি দিন তো এমনই, পশুতে পাখিতে মানুষে না মানুষে তখন ছায়া খোঁজে কেবল। ছায়া খোঁজা মানুষের বিবিরা, বউরা সেই ভোর থাকতে উঠে আকা জ্বালায়। ভোর ভোর ভাত নামলে পর এমন দিনে রসুন বাগাড় দিয়ে লালতে শাকের ঝোল হয়, পাতলা করে ডাল হয়, আলু চোখা হয়। সক্কাল সক্কাল কাজের মানুষেরা এক পেট ভাত খেয়ে কাজে যাবে। স্বর্ণ চালের গোল গল মোটা ভাত তাই হাড়ি উপচিয়ে ফুটে ওঠে। খাওয়া শেষ হলিপ্পর কাজের মানুষেরা দু-একখানা বিড়ি ধরায়। আঙুলের ফাঁকে বিড়ি খানিক ডলে নিতে নিতে ভেবে নেয় আজকের কাজ কম্মের হিসেব নিকেশ।

ততক্ষণে ঘরের মানুষ তার পান্তা গুছিয়ে দেয় সযতনে। অ্যালুমনিয়ামের ক্যানে ডুবে থাকে স্বর্ণের নিটোল শরীর। পেঁয়াজ লঙ্কা ভাসান পান্তায় ভেসে থাকে আলু সানার বাটি। একেকদিন বেগুনের সালন দিয়ে পান্তার পাত্তর সাজিয়ে দেয় ঘরের মানুষ। মুড়ি খেয়ে কি চৈতের দুপুর কাটাতে পারে মানুষ? ফজল আলি তাই একেকদিন বলে আজ ছাতু দিয়ে পান্তা দিস বউ। বউ মানুষেরা এসব কতদিন ধরে শুনে আসছে! সে কি আজ হলো? হাজার বছর ধরে যারা পথ হাঁটে তারা জানে এসব। ঘরের মানুষদের কি এসব শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হয়! তারা চৈতি দিনের রান্না জানে, তারা আগুন নেভানোর মন্তর জানে। তাই না তারা ফাগুনের মাঝ বেলায় উঠোনের কোণে খেরোর বীজ পোতে, শসার মাঁচা তোলে। এসব চাষাবাদে ওরা বেশ পটু। ভারি যত্নে বেড়ে ওঠা খেরো গাছখানা দেখলেই আপনি টের পাবেন, কত যত্নে ও বড় হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। ওর নরম পাতায় আলোছায়ার মকশো তাই আলপনা এঁকে দেয় এ বাড়ির নিকোনো দাওয়ায়। এসব কে কি আর চাষ বলা যায়? এরা সব চাষি বউ। সামান্য লাউ কুমড়ো ফলায় যে সে আর চাষি হতে পারে? তার জমিই বা কই বলো! স্বামী শ্বশুরের ভিটেয় এমন কত কত ভাগ চাষি যে চৈতি দিনে ফসল ফলায় সে গল্প হিসেবের আওতায় আসে না।

 

এই যে আমাদের সাকিনা এখন বসে বসে শুকনো ধুধুলের খোসা ছাড়াচ্ছে এক মনে। এসব সারা হলে কুলের আচারের বয়র খানি রোদের দিকে খানিক এগিয়ে দেবে ও। দুপুরের নির্জনতায় এক মনে খেজুর পাতার চাটাই বুনতে বুনতে ওর মনে পড়ে যাবে দাদির মুখে শোনা কিস্সা যত। এই লাউ মাঁচা, এই দোল খাওয়া শসার লতা আর বেড়া ঘেরা নির্জন দুপুরে কী জানি কোন আরব্য রজনীর দুপুর নেমে আসবে তখন! সেই কিস্সার মধ্যে যদি সাকিনার জীবনখানি ডুবে যেত তবে বেশ হতো। সে জীবন কি পান্তার শরীরের মতো না! বটেই তো। এসব ভাবতে ভাবতে সাকিনা এবারে উঠে পড়ে। মরিচ ডলে ডলে ও এখন পান্তা খাবে। বুলবুলিতে খাওয়া পাকা পেঁপে আছে একখান। বটি পেতে ভারি যত্নে পেঁপেখানা কেটে নেয় ও। পেপে দিয়ে পান্তা খেতে দিব্যি লাগে। খেতে কেমন চোখ জুড়ে ঘুম নামে ওর, নামবেই তো কিস্সার মধ্যে ডুবে গেছে যার জীবন, সে জীবন তো অমনই। সাকিনা তবু ঘুমায় না, যার খসম এখন তেতেপুড়ে নিম জিউলি গাছের তলায় ছায়া খুঁজছে তার কি চাটাই পেতে ঘুমিয়ে পড়া সাজে? ছড়ানো পাটির সরঞ্জাম তুলে রেখে সাকিনা এখন উঠোনের এক ধারে খেরোর গোড়া খুড়ে দেয়, মুখী কচুর চারা বেরোলো কিনা দেখে। এইসব দেখে যখন ওর আশ মেটে তখন ও বটি পেতে পেঁয়াজ কুচোয় মরিচ কুচোয় ভেজানো ডাল বাটে। রোদ্দুর নরম হয়ে এলে ওর খসম ফিরবে মাঠ থেকে। খানিক জল বাতাসা খেয়ে নাইতে যাবে খিড়কির পুকুরে।

সাকিনা তখন আকা জ্বালিয়ে গরম গরম ডাল বড়া ভাজবে। ডাল বড়ায় কামড় দিতে দিতে দাঁতের কষে আলতো করে মরিচে কামড় দেবে ফজল আলি। ঝালে ওর গাল জ্বলে উঠলে বলবে, শিগরির পানি দে বউ! শিগগির পানি দে। বাপরে, এ মরিচ কই পেলি? কী ঝাল! সাকিনা তখন মিটিমিটি হাসবে। বলবে, এ মরিচ আমি বুনেছি যে। কেমন ঝাল দ্যাখো! এই নাও শোসা খাও। আজ হয়েছে দুটো। শসা খেতে খেতে আরামে চোখ লেগে আছে ফজল আলির। বলে, রঙ চা করবি খানিক? করবেই তো সাকিনা। এসব কি বলে দিতে হয়? চাষি বউরা এসব জানে। কাপখানা নামিয়ে দিতে দিতে বলে, দেখে যাও আমার বাগানখানা! দাও না খানিক দশ ছাব্বিশ আ ইউরিয়া! এ কথায় ফজল আলি না হেসে পারে না। বলে, দেব। কাল সক্কালে দিয়ে দেব।

এখন আস্তে আস্তে চৈতের চাঁদ ওই দূরে মসজিদের মাথার উপরে উঠবে। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ফজল আলি আর সাকিনা ওদের কিস্সা বুনে চলবে রাত ভোর। না না সে তো কিস্সা না, সে হলো দাস্তান। সে ফুরোবার নয়। আলোয়, জলে সে প্রাণ পেয়েছে অফুরন্ত। সাকিনা আর ফজল আলি বসে গল্প করছে ওই। ওরা কি কেবল চাষি আর চাষি বউ! কী জানি! আমার কিন্তু মনে হয় ওরা সেই কোন আদম আর ইভের জাতভাই। রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওরা এখন চাষিভাইদের খবর শুনবে, হাওয়া অপিসের হদিশ শুনবে। হাওয়া তখন পাক খেয়ে উরে যাবে ওই, ওই দূরে। চৈতি রাতে যেমন যায় আর কী।

More Articles