বাজারের থলে ফাঁক করে টোপা কুল আর শিস পালংয়ের সই পাতানোর গল্প

নদীর পাড়ে হাট বসেছে। প্রতি বছরই বসে, চতুর্থীর দিনে। হাটের ওপাশে একখানা পোটো পাড়া আছে, তার গা ঘেঁষে কুমোর পাড়া। সকাল থেকেই তাই মেটে হাড়ি, ছাঁচে ফেলা সরস্বতী, সরা, মুচি গাছ প্রদীপ কত কী সাজিয়ে হাটের চত্বরখানা জমজমাট। বচ্ছরকার দিনে সকলেই দু’পয়সা কামিয়ে নিতে চায়, এই আর কী। হাকাহাকি, ডাকাডাকির শেষ নেই তাই সকাল থেকে। ও পাড়ার বিশে খুড়ো উবু হয়ে বসে কড়াইশুঁটির দর করতি লেগেচে। ক্লাবের পুজোয় কী আর কেজি দু-পাঁচের হিসেব হয়! খুড়ো তাই বলতেচে, তুই পাল্লা কত নিবি বল। ফুলকপি কড়াইশুঁটি দে মাখো মাখো খিচুড়ি হবে, বাঁধাকপির ঘণ্ট হবে, টমেটার চান্নি হবে, লোকে খেয়ে সুখ্যাত করবে – তবে না! বিশু খুড়ো তাই সকাল থেকে চটের বস্তা হাতে দরাজ গলায় দরাদরি করছে। শুধু কি খুড়ো! গেরস্ত মানুষ আজ ভিড় জমিয়েছে হাটের এদিক সেদিকে। যার ছেলে এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে তার বাজারের ফর্দ খানিক লম্বা বইকি। গোটা নৈবেদ্য, মাটির দোয়াত খাগের কলম, সব ফর্দ মিলিয়ে না নিলে কী চলে! কত কথা, কত রঙ, কত কত মুখ কেবলই আসছে আর যাচ্ছে, কেউ বা বাজারের থলে ফাঁক করে টোপা কুল কিনছে কেউ বলছে শিস পালং যে সব ঝিমিয়ে পড়েছে গো!

দুগ্গা পুজোয় কি আর গেরস্তের এমন করে থলে ভরে বাজার করার সুযোগ থাকে! একেকটা উপমহাদেশের গল্পে কেমন করে যে কার্নিভালের সুর বেজে ওঠে, সে কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত। এই হাটের এক পাশটিতে দাঁড়ালে সেসব টের পাওয়া যায়। মানুষের সাধ আর সাধ্যের কত পারা আর না পারার গল্প ছাপিয়ে ওই দ্যাখো বাবা আর মেয়ে কেমন দর করে মূর্তি কিনছে। এসব দরাদরি ফুরোলে কাঞ্চন গাছের ওপারে পঞ্চমীর চাঁদ উঠবে। সে চাঁদে হিমের গন্ধ ভরে থাকবে রাত ভর। চাঁদ ডুবে গেলে ভোরের হাওয়া মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইবে কেবলই। ক্যাঁথা কম্বলের ওম ঠেলে তবু ঘরে ঘরে তখন কেবল পুষ্পাঞ্জলির সকাল। মঠ কদমা আর নারকেলি কুলে মুঠো ভরে নেবার পালা ফুরোলে মানুষ টের পাবে এখন দুপুর হলো বুঝি। এমন দিনে ওই সদরের বাজারে ইলিশ ওঠে মাঝে মধ্যে। তবু, জোড়া ইলিশ কেনার খরিদ্দার কই! কুলো হাতে মৎস বরণের গল্প তাই ফুরিয়ে আসতে চায় পিতরিপুরুষের সঞ্চয়ের মতো। তার চেয়ে বরং চাক চাক করে বেগুন ভাজা দে খিচুড়ি খেতে ভারী সুখ।

ব্যস্ত মানুষে টের পায় না, উৎসবের খাবার তো অমনই। সে খাবারে সাধ আর সাধ্যকে মিলিয়ে দেবার কী আকুলতা। খিচুড়ির মধ্যে কে যে এমন করে একখানা গণতন্ত্রের ইস্তেহার বুনে দিয়েছে কে জানে! আহা! শাল পাতায় গড়িয়ে যেতে চাইছে নিরিমিষ খিচুড়ি, অমন সোনার বন্ন তার, কী তার গন্ধ! তবুও কি মানুষের কাঁচা ইলিশের ঝোল দে ভাত খেতে ইচ্ছে হয় না? খায় তো। নিয়মে ডুবে যাবার সাধ হয় না বুঝি ওর! সেসব নিয়ম পোহানো মানুষের গল্প না হয় আরেক দিন হবে।

আরও পড়ুন-স্মৃতির ভিতর যে স্বাদের নিরন্তর চলাচল

সে গল্পে ঢুকে পড়লে গোটার জোগাড় পড়ে রইবে যে! এই তো, বেলা থাকতে থাকতে তিন্নির মা কাঠখোলায় কলাই ভেজে, সেসব জলে ভিজতে দিলেন সবে। ওর ভিজে হাতে এখনও লেগে আছে কাঁচা হলুদের রঙ। কলাই ভিজোনো হলে গোটা সেদ্ধর বাজার ধুয়ে, জল ঝরিয়ে হাতের কাজ এগিয়ে রাখবেন তিন্নির মা, এ বাড়ির গিন্নি। ভাগে ভাগে আলু, রাঙালু, শিম, বেগুন, কড়াইশুঁটি, সজনে ফুল, শিস পালঙ সব কেমন সাজিয়ে রেখেছন চালুনির ওপর। ওর সাজিয়ে রাখা আনাজপাতি এমন পড়ন্ত বিকেলে একখানা ছবি হয়ে উঠতে চাইছে পশ্চিমের আলোয়। সে আলোখানা নিভে গেলে বিজলি আলো জ্বলে উঠবে। সেসব হলুদ আলোর বচ্ছরকার সন্ধ্যায় তিন্নির মা, এ বাড়ির গিন্নি রান্নাঘর আরেকবার ধুয়ে মুছে দুধ জ্বাল দিয়ে দই পাতবেন, ওই যে, ওই নির্জনে। টোপা কুলের টক রাঁধবেন, সজনে ফুলের চচ্চড়ি করবেন। এরপর হাত অবসর হলে গোটা সেদ্ধ বসাবেন ভারি যত্নে। সে সেদ্ধখানা নিজের মতো করে রান্না হতে হতে হতে হতে যখন নিটোল একখানা শিল্প হয়ে উঠবে তখন চুলো নিভিয়ে তিন্নির মা গিন্নি, গরম ভাতে জল ঢেলে দেবেন। এসব মিটতে রাত খানিক গড়াবে।

এ রাতে শিলপাটাও শয্যা যাবেন মানুষের পাকশালে। নিদালি মন্ত্র পড়ে কেই বা আর তাদের ঘুম পাড়ায়! শীতল ষষ্ঠীর দিনে এ যেন তাদের দিবানিদ্রার অগাধ সুখ। ভাদ্রমাসের রান্নাপুজোর চেয়েও এ ভারী অন্যরকম। এত কাজের ভিড়েও একখানা শীতল ষষ্ঠী তিন্নির মা গিন্নিকে কেমন করে ছুটি পাইয়ে দিতে চেয়েছে সে কেবল সেই জানে। তিন্নির মা গিন্নির মশলা পেষা হাত, জাল ঠেলা কবজি খানিক জিরোক এবার।

তিন্নি এখন মুড়ি দিয়ে গোটা সেদ্ধ খাবে, খাবে তিন্নির বাবা, কাকা, পিসি। তিন্নির মা ভিজে চুল কখানা পিঠে মেলে দিয়ে রোদ্দুরে বসে দেখবেন সেসব। এমন অবসরের ফূর্তিতেই বুঝি বা ভিজে ভাত, গোটা সেদ্ধ আর কুলের টক খাবেন তিনি আজ। মাঘের রোদ্দুর তখন ওর শরীরে আতপ্ত আদরের রেখা বুনে দিতে চাইবে। সেই আদরে ডুবে যেতে যেতে খানিক চোখ লেগে আসতেও পারে। ঘুমোক খানিক ও। ও তো আর তেমন করে ইতিহাস পড়ার সুযোগ পায়নি। পেলে পরে ও ঠিক জানতো, হাইতির মানুষ কেমন করে জাউমাউ স্যুপ রাঁধতো। সে রান্নায় মিশে থাকতো শ্রমের ক্লান্তি, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। কালো মানুষের সেসব রান্নার গল্প তিন্নির মা, গিন্নি জানে না। জানলে পরে তিনিও জানতে পারতেন, মার খাওয়া কালো মানুষের সে রান্নার নাম ফ্রিডম স্যুপ। কত কত সময়ের তাপে চাপে সে রান্নার মুন্সিয়ানা। সেও কি এমন গোটা সেদ্ধর মতোই মেহনতি মানুষের, মাহনতি মায়েদের রান্নার গল্প নয়! বেঁচে থাক শীতল ষষ্ঠীর ভোর, বেঁচে থাক কর্ম বিরতির সকাল। বেঁচে থাক গোটা সেদ্ধর হাড়ি। শ্রমের গানেও তো কিছু কিছু কর্মবিরতির স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা মিশে থাকে! সে কথা কে না জানে। শিলপাটারাও জানে সেসব, আর জানে শিস পালং, জোড়া শিম, রাঙালু আর সজনের ফুল। এসব গল্প জানলে তিন্নির মায়েরও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করতো একে স্বাধীনতার রান্না বলে দাগিয়ে দিতে। না জানুক ও এসব, ও বরং আরো খানিক ঘুমোক। ওর কবজি জুড়োক, ওর মশলা পেষা হাত জুড়োক। শিল ঘুমোক, নোড়া ঘুমোক। ঘুমোক তিন্নির মা। স্বাধীন মানুষ ঘুমোবে বইকি। নরম রোদ্দুরে ঘুমোবেই তো।

More Articles