মাঘের দিনে শাক মহোৎসব একখানা ছবি হয়ে উঠতে চাইছে...

মাঘের হাওয়ায় কাজ সারা যায় না বাপু। জাড়ে টুকুরি লেগে যেছে। তবু, বললি আর শুনবে কে! এ পাড়ার মেয়েরা আজ হাত চালিয়ে কাজ সারছে। সবার চোখে মুখে আজ ব্রিগেড সমাবেশের ব্যস্ততা। খাওয়া সেরে, চুলো নিভিয়ে মেয়ের দল মায়ের দল এখন মাঠে মাঠে শাক কুড়োতে যাবে। দলে দলে ওদের বেরিয়ে পড়া দেখতে দেখতে তখন মনে হবে, কোন মহামিছিলের অহ্বানে ওরা বুঝি আজ ঘরছাড়া। ঘরের ডাক ওদের আজ দাবিয়ে রাখতে পারবে না কোনো মতেই। মাঘের হাওয়ার মতোই ওদের ইচ্ছেরা আজ উড়ছে, কেবলই উড়ছে। সাঁওতাল মেয়ের শরীর ঘিরে এখন কেবলই জেগে উঠতে চাইছে কাজের হর্ষ। একেই কি কর্মযোগ বলে? জানি না। আসলে এসব জানা বা না জানায় কিছু এসে যায় না কারও। এখন মাঠে মাঠে বাথুয়া শাকের মরশুম, সর্ষে শাকের মরশুম। মেয়ের দল এখন কোচড় ভরে শাক তুলবে। এই শাক কোচড় ফেরতা বাড়ি এসে রোদ্দুর মাখবে কত! তবে তো কুটো ডাঁটা ঝেড়েঝুরে শুকনো শাক কৌটোয় ভরে তুলে রাখবে শাক কুড়ানি মেয়ে! টাটকা শাকের চেয়ে এ শাক ঢের বেশি পছন্দ সক্কলের। আহা, সামান্য ফ্যানে শাকের গুড়ো দে ফুটিয়ে নাও আর টুকুন খানিক লবন। এক খানা মরিচ ডলে নিলে নিমেষে গরাস ভরে, গ্রীবা ভরে তখন পার্থিব সুখ গড়িয়ে পড়তে চাইবে। চুরকি বাসকের, মাখানি কিসকুর এমন করে ভাত খাওয়ার সুখ কী জানি কেমন করে মিলে যায় নদের চাঁদের প্রণয় মহিমায়!

ষোড়শ শতকের কবি তো লিখেছিলেন, ‘ বাস্তূক শাক খাইলে হয় কৃষ্ণভক্তি’... আহা! কেমন করে তিনি মানুষের স্বাদ কোরককে ছুঁয়ে গেলেন কৃষ্ণ প্রেমের নাম সংকীর্তনে! এ তো সামান্য শাক নয়! নদের চাঁদের স্নেহ ধন্য সে। সে কি সামান্য হলো? সে তো উদ্ভিদ নয়! সে ভূত বস্তুকে ভেদ করে ওঠে, তাই না সে বাস্তূক! চোত বোশেখের রুখা শুখা মাঠে ওর বীজ গড়াগড়ি যায় গরম হাওয়ায়। বর্ষার জলও পারে না তার ঘুম ভাঙাতে, না পারে শিশিরের ওম। এমন শীতের দিনেই কেবল তার জেগে ওঠা। সে যেন জমি জিরেতের বাসিন্দে, সব ফেলে এই কি তার ঘুম ভাঙানিয়া গান? একে একালের মানুষ রেজারেকশন বলে দাগিয়ে দিতে পারেন কিন্তু সেই কোন এগারো শতকের চক্রদত্ত! তিনি কি তার সামান্য সুখ্যাত করেছেন! এই সুখ্যাতের নদী কেবলই পলিদ্বীপ গড়েছে মানুষের স্বাদ কাহনকে ভালোবেসে। সেই আর্য ঋষির মুগ্ধতা কি চুরকি বাসকের মুগ্ধতার চেয়ে কম! না বোধহয়! ওই শাককুড়ানি মেয়ের হাসিখানা দেখলেই আপনি টের পাবেন ঋষিবাক্য নির্ভুল। এমন করে মাঘের দিনে হাওয়া আর ঝুপ করে ডুবে আসা রোদ্দুরকে সাক্ষী রেখে ওদের এই শাক মহোৎসব একখানা ছবি হয়ে উঠতে চাইছে আপাদমস্তক দিয়ে।

এই রৌদ্রতপ্ত শাকে কেবল কি সঞ্চয়ের ব্যাকুলতা? তা তো না! মানুষের স্বাদকোরককে তুমি কিনে নিতে চাও, সে কি ইমানদারের মতো কথা হলো? ফ্যানে ফোটা শাক দিয়ে ভাত খাক বরং মাখানি আর চুরকি, চলুন আমরা বরং বাজার থেকে এক চক্কর ঘুরে আসি। খাম আলু, আলু শাক মায় আলতাপাটি শিম তো জুটে যেতে পারে। অমন শিম কাটতে গেলে তার বাস ওঠে কত! কুয়াশার মতো শিমেরও তো গন্ধ থাকে। সে গন্ধ মানুষকে ঘর মুখো করে তুলতে চায় সকালের ব্যস্ততায়। সে গন্ধে মিশে আছে, ফ্যানভাতের উষ্ণতা। ফুরিয়ে আসা শীতের বিকেলে কোচড় ভরে শিম তোলে যারা তাদের বুঝি শিম ফুলের মতো নোলক পরতে সাধ যায় না! যাবেই তো, যেতেই হবে। নইলে গল্পের লাটাই গড়িয়ে গড়িয়ে চলবে কেমন করে? এ তো আর তুষার রাজকন্যের দেশ নয়! লালটুপি খুকি আর নেকড়ে বাঘের গল্পই এখানে আছে বুঝি! নেই, নেই। মাঘের রাতে চুলোর ধারে বসে বসে ভাত ফোটানো মা এখানে শাক কুড়ানোর গল্প বলে, আহিরি কলাইয়ের পাতার ফাঁকে ন্যাজ ঝোলা হলুদ পাখির গল্প বলে।

দেশের বাড়ির রান্না সিরিজের আগের লেখা-দুধ চিতই, চষির পায়েস, রসবড়া, কেবলই পার্বণের জলপান?

গল্পে গল্পে বেলা বাড়ে। মেয়ে তখন বায়না ধরে আমি মুড়ির মেলায় যাব। মায়ে তাকে কত যে বোঝায়! বলে, 'ক্যামনে যাবি! বাঁকড়ো কি এইখেনে! তার চেয়ে চল ব্রহ্মদত্যির পুজোয় মোচ্ছব খেয়ে আসি।' মেয়ে তখন গোল গোল চোখে কান্না থামায়। বলে, 'ব্রহ্মদত্যি কী মা? মা, বলে, জানোনি মণি! তিনিই যে এই খেতি, এই ফসল পাহারা দেন গো!' বলতে বলতে মা আরো খানিক জাল ঠেলে দেন। আগুন খানিক বেড়ে উঠলে টের পাওয়া যায় মায়ের মনের মধ্যে ছায়া ফেলে যাচ্ছে হাড়ির মেলা। এই তো আমাদের পাঁড়ুইয়ে গো। মেটে হাড়িতে কতদিন ভাত খায় না মা! সেই শুঁও ওঠা আগরা ধানের চাল! কী যে সোয়াদ তার! মেয়ের অবশ্য এই উদাসীনতা ভালো লাগে না। মেয়ে বলে, 'মা, ব্রহ্মদত্যি কি ওই মাঠে থাকে?' থাকেই তো! তবেই না শাকে শাকে ভরে ওঠে মাঠ! তবেই না পাকা ধানের গন্ধে মৌতাত লাগে মানুষ আর না-মানুষের! মাঠ পেরিয়ে মরা নদীর বাঁক পেরিয়ে ওই তো তিনি চলেছেন! গল্পে গল্পে ঘুম নামে চোখে। গোল গোল চোখের মেয়ে তখন স্বপনের মধ্যে তলিয়ে যায়। ওই বাথুয়ার মাঠ ওই সাদা সর্ষের ফুল ওকে ডাকে। ওর কি আর ফেরার অবকাশ আছে? মাঘের হিমে চুলার ওমে শাক কুড়ানি মেয়ে এখন তলিয়ে গেছে ঘুমে। এমন করে গাঁয়ে গাঁয়ে এখন রাত্তির নামবে। মাঘের হাওয়ায় ফিনিক ফোটা জোছনায় কেবল জেগে থাকবে বাথুয়ার মাঠ। মাটিতে মিশে গিয়েও মানুষের কাছে ফিরে আসার কী তার ব্যাগ্রতা!

মুড়ির মেলা, হাড়ির মেলা ঠেলে আমি আসলেই টের পাই কোন সে এক ব্রহ্মদত্যি মাঠের প্রান্তে বসে ফসল পাহারা দিচ্ছেন এক মনে। মোচ্ছবের গড়িয়ে যাওয়া খিচুড়ি পেরিয়ে ওঁরও কি ইচ্ছে করে একবার বাথুয়ার মতো মানুষের হাতে গড়া বেগুন বাড়িটির পাশে গিয়ে বসতে? হয়তো বা করে। মানুষের গপ্পে ওর ভূমিকা আর কতটুকুই বা! তবু, কি ওই ফসল ফলানো মানুষের কাছে ও সত্যি নয়? এই যে আমাদের চুরকি বলে, 'ওর নাম বাস্তূক না রে দিদি, ও হলো ভাথু আরা। সে কি কম সত্যি হলো!'

More Articles