খোদ ঠাকুরবাড়িতে তৃণমূলের পার্টি অফিস, ছাড় পেলেন না রবীন্দ্রনাথও!
Jorasanko Thakurbari: ঠাকুরবাড়িও এখন দলীয় রাজনীতির আখড়া?
কখনও তাঁর গানের লাইন ধার করে দলীয় প্যারডি, কখনও আবার সরাসরি তাঁর বসতভিটের রং বদলে আস্ত পার্টি অফিস, শাসক দলের এহেন স্বেচ্ছাচারিতায় রীতিমতো জর্জরিত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। কিছুদিন আগেই জানা যায়, রবীন্দ্র-জীবনে স্মরণীয় দক্ষিণের বারান্দার ঠিক নিচের অংশটিকে রীতিমতো সবুজ রঙে সাজিয়ে গড়ে তোলা হয় শাসক দলের শিক্ষাকর্মীদের ইউনিয়ন অফিস। রবীন্দ্রনাথের বদলে সেখানে ঝুলতে থাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। অথচ সামান্য খোঁজ নিলেই তো জানা যায়, “রবীন্দ্রনাথ কখনওই তৃণমূল করেননি!" তাই শুধু তৃণমূল কেন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা তাঁর হেরিটেজ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বসতভিটে কোনওটাই কোনও রাজনৈতিক দলের আখড়া হতে পারে না।
যেখানে হেরিটেজ ভবনের ফাটা ছাদ, নিদেনপক্ষে জানলার কোনও কাচ বদলাতে চাইলেও হাজারটা সই, দরখাস্ত জমা করতে হয়, সেখানে বিনা আলোচনায় কীভাবে রাতারাতি বদলে গেল ঠাকুরবাড়ির সাবেকি দক্ষিণের বারান্দার নিচের অংশ? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তোলে বুদ্ধিজীবী মহল। দায়ের হয় জনস্বার্থ মামলাও। এরপর কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে খোলা হয় সেই অফিসের হোর্ডিং। যদিও, নেতা-কর্মীদের আনাগোনা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
আরও পড়ুন: রবিঠাকুরের চুরি যাওয়া নোবেল আজ কোথায়? যে প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে বাঙালি
দীর্ঘদিন হেরিটেজ কমিশনের পদে ছিলেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “হয়তো দলের ইমোশন থেকে করে ফেলেছে কাজটা, তবে কখনওই হেরিটেজ কোনও বিল্ডিং বদলে ফেলা উচিত নয়। করতে চাইলেও আলোচনা করা উচিত ছিল। কাজটা ঠিক হয়নি।”
জোড়াসাঁকোর ছ’নম্বর বাড়ি, পরিচিত নাম মহর্ষি ভবন। লালরঙা এ-বাড়িতে প্রবেশ করলেই শুরু হয় টাইম ট্রাভেল। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজও সজাগ এ-বাড়ির প্রতিটা ইট-কাঠ-পাথর। ঐতিহ্যের কোনও এক পিছুটান আজও গ্রাস করে আমাদের, পালাতে চাইলেও পা চেপে ধরে। পিছুটানের রেশ ধরে আমরা ফিরে যাই ঠাকুরবাড়ির অন্দরে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি সেকেলে ইতিহাসের গম্বুজ-খিলানকে।
বাঙালি তো বটেই, এমনকী, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের কাছেও উত্তর কলকাতার এ-বাড়িটার আবেগ অনেকখানি। উঁচু খিলান, গম্বুজ, খড়খড়ি দেওয়া জানলা, দালান, চৌহদ্দি, বাহিরমহল, অন্দরমহল অথবা সেই দক্ষিণের বারান্দা সবকিছু ঘিরেই রয়েছে অজস্র স্মৃতি। এ যেন ঠিক একটা গল্পের বইয়ের মতো, যার পরতে পরতে রয়েছে রহস্য, প্রতিটা পাতায় রয়েছে রোমহর্ষক কাহিনি।
ঠাকুর পরিবারের এই বাড়িটি এক সময়ে ছিল আধুনিক বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ১৭৮৪ সালে বৈষ্ণবচরণ শেঠের থেকে নীলমণি ঠাকুর এই জমিটি গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন জিউয়ের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন। তারপর এখানেই তিনি গড়ে তোলেন ইমারত। অবশ্য এ-বাড়ির গৌরবময় অধ্যায়ের শুরুটা হয় তাঁর নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের আমল থেকে। তাঁর নামেই এ রাস্তার নাম হয় দ্বারকানাথ লেন। বাড়ির প্রবেশপথে রয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ। আর অন্যপাশে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী স্বরূপ লাল তোরণ, ওপরে লেখা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। তবে রবীন্দ্রভারতীর গেটই হলো প্রধান ফটক।
গেট দিয়ে প্রবেশ করে, প্রথমেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। যেদিকেই চোখ যাবে, মুগ্ধ করবে স্থাপত্যশৈলী। দরজায় পিতলের কারুকাজ, সিঁড়ির, ভিতরের ঘরগুলোর দেওয়ালে বাহারি নকশা, সবটা ঘিরেই প্রকাশ পায় ঠাকুরবাড়ির রুচিবোধের পরিচয়। আজও এ-বাড়ির ভেতরে পা রাখলে কানে বাজতে থাকে রবীন্দ্রসংগীতের হালকা সুর। সেই সুরের মূর্চ্ছনায় অচিরেই ধরা পড়ে কবির উপস্থিতি। যেন পুরো সময়টাই একটা মোহ, সেই আবেশে মোহিত হয়ে না থেকে উপায় নেই।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে শুরুতেই কবিগুরুর খাবার ঘর, তারপর শয়ন কক্ষ। এই ঘরেই জীবনের শেষ সময়টা কাটিয়েছেন তিনি। ঠিক এর পাশের একটি কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন কবি। মৃত্যুর সাতদিন আগে অর্থাৎ ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই এ বাড়িতেই কবি তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’-এর ডিকটেশন দিয়েছিলেন। কী মারাত্মক জীবনী শক্তি থাকলে এমনটা সম্ভব তা বোধ হয় বাঙালি আজও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারে।আজও এ বাড়িতে সযত্নে রয়েছে কবির ব্যবহৃত পোশাক, আরাম কেদারা, বইপত্র, বিলেত থেকে আনা নানান জিনিসপত্র। রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের ছবি এবং নানা জানা-অজানা তথ্য। বিভিন্ন নাটকে যেসব পোশাক পরে তিনি অভিনয় করতেন, তাও রয়েছে এখানে।
এছাড়াও রয়েছে মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর, সংগীতের ঘর ও পুজোর ঘর। রয়েছে তিনটি গ্যালারিও। যার মধ্যে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায় এবং আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কুটিরের ছবি, গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মতো নানা টুকরো টুকরো গল্পের ছবিও রয়েছে এ বাড়িতে। পুরো বাড়ি জুড়েই রয়েছে রবি ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন। আলোর পাশাপাশি অন্ধকারটুকুও কী অসীম যত্নে সজ্জিত এখানে। তিলোত্তমার একেবারে মধ্যস্থলে বিরাজমান এ বাড়িটিতে তাই সময়ের ঘষা লাগেনি আজও। অথচ অন্দরে পা রাখলেই অন্য দুনিয়া, অচিরেই কোন এক ঐতিহ্যের জালে আটকে পড়তে হয়। তাই কোনো দল প্যারোডি করে যতোই বলুক, “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বুকে একটাই দল...!” বাংলায় রবি ঠাকুরের আবেগ বিক্রি হওয়ার নয়।