রবিঠাকুরের চুরি যাওয়া নোবেল আজ কোথায়? যে প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে বাঙালি
Nobel prize 2022: ক্রমে ক্রমে বিনোদনের আফিমের তীব্রতায় বুঁদ বাঙালি ভুলে গেছে নোবেল চুরি।
সাল ১৯১৩। ১৫ নভেম্বর। গরুর গাড়িতে চড়ে আশ্রম-সচিব নেপালচন্দ্র রায়ের সঙ্গে কোনও এক জায়গায় যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ জোব্বার পকেট থেকে বের করলেন এক টেলিগ্রাম। বারদুয়েক পড়ে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইলেন দূরে। তারপর টেলিগ্রামটা আশ্রম সচিবের হাতে এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'নিন নেপালবাবু। এই আপনার ড্রেন তৈরির টাকা।' নেপালচন্দ্র তখন রবীন্দ্রনাথের কথার খেই না পেয়ে টেলিগ্রাম পড়লেন। পড়ে তাঁর দু'-চোখে জল। প্রথম নন-ইউরোপিয়ান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মুহূর্তেই শান্তিনিকেতন আশ্রমে ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র ও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন' গ্রন্থে লিখছেন,
সহসা অজিতকুমার চক্রবর্তী রান্নাঘরে ঢুকিয়া চিৎকার করে বলিলেন 'গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পাইয়াছেন।' লক্ষ করিলাম অজিতবাবুর চলাফেরা প্রায় নৃত্যের তালে পরিণত হয়েছে।… তারপর ক্ষিতিমোহন বাবু প্রবেশ করিলেন। স্বভাবত তিনি গম্ভীর প্রকৃতি লোক, চলাফেরায় সংযত, কিন্তু তাহাকে ও চঞ্চল দেখিলাম। ব্যাপার কী? তারপরে জগদানন্দবাবু পৌঁছিয়া ঘোষণা করিলেন তিন চারদিনের ছুটি তখন বুঝিলাম ব্যাপার কিছু গুরুতর।
গুরুতর ব্যাপারই বটে। ১৯১২-র শুরুর দিকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাতিল হয় রবীন্দ্রনাথের বিদেশযাত্রা। তখন শিলাইদহে বসে 'গীতাঞ্জলি'-র পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু কবিতা তিনি ইংরেজিতে তরজমা করেন। পরে 'গীতাঞ্জলি'-র ৫৩টি এবং 'গীতিমাল্য', 'নৈবেদ্য', 'খেয়া' মিলিয়ে আরও ৯টি কাব্যগ্রন্থ থেকে মিলিয়ে ১০৩টি কবিতার অনুবাদ নিয়ে তৈরি হয় ইংরেজি 'গীতাঞ্জলি'। ১৯১২-র ২৭ মে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন রবীন্দ্রনাথ। লন্ডন পৌঁছে চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইনের হাতে তুলে দেন সেই পাণ্ডুলিপি। ৩০ জুন রোদেনস্টাইনের বাড়িতে এক সান্ধ্য-আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ইংরেজি গীতাঞ্জলি-র কিছু কিছু কবিতা। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, আর্নেস্ট রাইসের মতো দিকপাল লোক। পরবর্তীকালে নোবেল কমিটির কাছে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন ইয়েটস। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর নোবেল কমিটি ঘোষণা করে এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও পড়ুন: বারবার নিজের স্মৃতির ময়নাতদন্ত, নোবেল জয়ী অ্যানি এরনোঁর সাহিত্য যে কারণে জনপ্রিয়
রবীন্দ্রনাথের কাছে নোবেল-প্রাপ্তির খবর এসে পৌঁছয় ১৫ নভেম্বর বিকেলে। নোবেল-প্রাপ্তির খবর জানিয়ে কবিকে প্রথম টেলিগ্রাম করেন কবির ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
নোবেল-প্রাপ্তির ঠিক ৯১ বছর পর এশিয়ার প্রথম নোবেল চুরি গেল শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন থেকে। ২৫ মার্চ, ২০০৪। দিনটা ছিল বুধবার। আশ্রমের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্রভবনের তালা খুলতেই দেখা গেল, চুরি গিয়েছে নোবেল পদক। শুধু নোবেল পদক নয়, সঙ্গে চুরি গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের সোনার আংটি, সোনার পকেট-ঘড়ি, মৃণালিনী দেবীর প্রিয় বালুচরী শাড়ি, রুপোর রেকাবি, রুপোর কফি কাপ-সহ মোট ৩৭টি জিনিস। চুরির খবর প্রকাশ্যে আসতেই দেশজুড়ে বিভিন্ন মানুষ তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানালেন। নবনীতা দেবসেন লিখলেন, "আমি বিস্মিত, বিমূঢ়। এমন যে হতে পারে, সে তো কল্পনার বাইরে। যেখানে যে প্রতিষ্ঠানে এই জিনিস ছিল, সেখানে যে এমন তীব্র নিরাপত্তার অভাব পড়েছিল, সেখান থেকে যে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারে, এ ঠিক ভেবে ওঠা যায় না।"
বিশ্বভারতীর উপাচার্য তখন অধ্যাপক সুজিত বসু। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট এবং কেন্দ্রে এনডিএ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানালেন, "আমরা অবশ্যই এই কালপ্রিটদের গ্রেপ্তার করে নোবেল প্রাইজ ফেরত আনব।" এহেন চুরির ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-কে। তদন্তের সময় দেখা গেল, রবীন্দ্রভবনের পিছনের জানলার গ্রিল ভাঙা। চুরির রাতে গোটা 'উত্তরায়ণ' এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মাত্র দু'জন এনডিআরএফ কর্মী।
তদন্তভার হাতে নিয়েও এশিয়ার প্রথম নোবেল চুরির কোনও সুরাহা করতে পারেনি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তারপরে এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু তাতেও নোবেলের কোনও দিশা পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর প্রায় ১২ বছর পরে চুরির বিষয়ে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতির কথা জানায় সিবিআই। সেই তদন্ত প্রসঙ্গে 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া'-র একটি প্রতিবেদন জানায়, নোবেল পাচারের মূল চক্রী ছিলেন বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মুহাম্মদ হোসেন শিপলু এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী জীবন সিং। গোয়েন্দাদের মতে, নোবেল চুরির ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল শান্তিনিকেতনের স্থানীয় লোকজন।
নোবেল চুরির অন্য গল্প
কেবল রবীন্দ্রনাথের নোবেল নয়, আরও তিনটি নোবেল পদক চুরি হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালফোর্নিয়া বার্কলে থেকে ২০০৭ সালে চুরি যায় বিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্সের নোবেল পদক। সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরির জন্য ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছিলেন লরেন্স। পরে দেখা যায়, এক ছাত্র মজা করার জন্য লুকিয়ে রেখেছিল নোবেল পদক।
১৯৮৫ সালে 'ইন্টারন্যশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়ার' সংস্থাটিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয় সুইডিশ অ্যাকাডেমি। ২০০৬ সালে সেই পদক চুরি হয়। পরে তদন্ত করে উদ্ধার হয় সেই পদকটি।
১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আর্থার হেন্ডারসন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালে নিউক্যাসলের মেয়রের অফিস থেকে চুরি যায় নোবেল পদকটি। অনুসন্ধান করেও আর পদকটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি ও বাঙালির উদাসীনতা
নোবেল চুরির প্রায় ১৮ বছর কেটে গিয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য, সিবিআই-সিআইডি কেউই উদ্ধার করতে পারেনি এশিয়ার প্রথম নোবেল। একটু সচেষ্ট হলে কি উদ্ধার করা যেত না রবি ঠাকুরের নোবেল? যে পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি তথা ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক মঞ্চের স্বীকৃতির আখ্যান, তার ব্যাপারে কোনও উৎসাহই দেখাল না প্রশাসন থেকে আমজনতা। এমনকী, বরাবরের মতো মৌনব্রত পালন করেছে রবীন্দ্রনাথের সাধের বিশ্বভারতীও। এই প্রসঙ্গে প্রবীণ আশ্রমিক ও ঠাকুর পরিবারের সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুরের বক্তব্য, "একটু চেষ্টা করলেই হয়তো উদ্ধার করা যেত। মুখে যত হইচই হলো, নোবেল উদ্ধারের কাজে তার প্রতিফলন তেমনভাবে দেখা গেল না। ভাবতে দুঃখ হয়, বাঙালির গর্বের জিনিসটা চিরতরে হারিয়ে গেল আমাদের সকলের গাফিলতির জন্যই।"
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প স্মরণ করাই যায়। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের খ্যাতির ভাগ পেতে একদিন যতখানি উন্মুখ হয়েছিল বাঙালি জাতি, নোবেল পুরস্কার আসার আগে তাদের কাছেই রবি ঠাকুর ছিলেন সমালোচনার পাত্র। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে কলকাতা থেকে প্রায় ৫০০ জন শান্তিনিকেতনে গিয়ে উপস্থিত হন। আম্রকুঞ্জে বিরাট সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে বাঙালি আপনজনের কাছে রবীন্দ্রনাথের হেনস্থার কথা ধরা আছে কবির সেই অনুষ্ঠানের প্রতিভাষণে। প্রমথনাথ বিশী সেদিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখছেন,
গুরুদেব বললেন, "আমি পূর্ব সমুদ্রের তীরে বসে যাঁর উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দিয়েছিলাম তিনি পশ্চিম সমুদ্রের তীরে তা কেন গ্রহণ করলেন জানিনা। কিন্তু আপনাদের সম্মানের এই মদিরা ওষ্ঠে স্পর্শ করলুম কিন্তু অন্তরে গ্রহণ করতে পারলুম না।"
এই বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়, মানুষের সেদিনের হঠাৎ খুশি হয়ে ওঠা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি কবি। সেদিনের দুঃখের কথা ধরা আছে 'লুকিয়ে আসো আঁধার রাতে' এবং 'আমার সকল কাঁটা ধন্য করে' গানদু'টিতে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময় থেকে নোবেল চুরি- অবস্থা বোধহয় একটুও বদলায়নি। মানুষের ওপরের চটক বুঝতে পেরে আহত হয়েছিলেন কবি। নোবেল চুরির পরও সেই আমবাঙালিই হতাশায় ফেটে পড়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশও ফিকে হয়ে এসেছিল। ক্রমে ক্রমে বিনোদনের আফিমের তীব্রতায় বুঁদ বাঙালি ভুলে গেছে নোবেল চুরি। একের পর এক নিত্যনতুন ঘটনার আমদানিতে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে নোবেলও। আদৌ কি কোনও দিন উদ্ধার হবে নোবেল! প্রশ্ন অনেক। কিন্তু 'উত্তর মেলে না।'