রথ দেখা ও কলা বেচার প্রবাদের শুরু বাংলার এই রথযাত্রা থেকেই

বয়স এবং আয়োজনে অনেকটা ছোট হলেও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তাকালে আমরা এমন বহু রথযাত্রা খুঁজে পাই, যেখানে স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প, কিংবদন্তি সবকিছু মিলেমিশে তাদের সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে।

রথযাত্রা উৎসব-সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা সবাই শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রা উৎসবের কথা বলতে পারি। ভারতের প্রাচীনতম এই রথযাত্রার উল্লেখ ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ এবং কপিল সংহিতায় পাওয়া যায়। বয়স এবং আয়োজনে অনেকটা ছোট হলেও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তাকালে আমরা এমন বহু রথযাত্রা খুঁজে পাই, যেখানে স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প, কিংবদন্তি সবকিছু মিলেমিশে তাদের সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে।

বাংলায় প্রাচীনতম রথযাত্রার নাম বললে সকলেই এক বাক্যে শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রার নাম বলতে পারেন। ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এই রথযাত্রার সূচনা হয় ১৩৯৬ সালে। কথিত আছে যে, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে মন্দির এবং রথ নির্মাণ করেছিলেন। ৬২৫ বছর পেরিয়ে সেই প্রথম রথ এবং মন্দিরের আজ অস্তিত্ব নেই। বর্তমান মন্দিরটি ১৭৫৫ সালে নারায়ণচন্দ্র মল্লিক নামে এক ভক্ত নির্মাণ করিয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু তৎকালীন বিখ্যাত মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিকে একটি রথ তৈরির বরাত দিয়েছিলেন। বর্তমানে সেই রথ আমাদের কাছে মাহেশের রথযাত্রার উৎসবের রথ হিসেবে পরিচিত। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু, ১২৫ টন ওজনের এই রথ নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি করা হয়েছে। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে অতিমারীর পূর্বে প্রায় প্রত্যেক বছর মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'রাধারাণী' উপন্যাসে মাহেশের রথযাত্রার এবং মেলার কথা পাওয়া যায়। জনশ্রুতি রয়েছে যে, রথ দেখা ও কলা বেচা প্রবাদটা মাহেশের রথযাত্রা উৎসব থেকেই শুরু হয়।

শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রার মতো জনপ্রিয় না হলেও চন্দননগরের যদু ঘোষের রথযাত্রার জনপ্রিয়তা কম নয়। ১৭৬৩ সাল নাগাদ চাল ব্যবসায়ী যাদবেন্দ্র ঘোষ বা যদু ঘোষ লক্ষ্মীগঞ্জ এলাকায় প্রথম মন্দির এবং রথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। ১৭৭৪ থেকে ১৭৯৮-এর মধ্যে কোনও এক সময় নিম কাঠ দিয়ে একটা রথ বানানো হয় এবং সেই রথ ১৯৬২ অবধি প্রত্যেক বছর রথযাত্রার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে চন্দননগর রথ কমিটি জনগণের অর্থসাহায্যে একটি নতুন রথ তৈরি করার বরাত দিয়েছিল। ১৪ চাকাসমেত বর্তমান রথটির ওজন প্রায় ৬০ টন। বর্তমান রথ তৈরি করে পুরনো রথটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। চন্দননগর জাদুঘরে পুরনো রথের কিছু অংশ এখনও সংরক্ষণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীগঞ্জ মন্দির থেকে তালডাঙা মোড়ের মধ্যের সামান্য সরু রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই রথটিকে টানা হয়।

আরও পড়ুন: স্নানযাত্রা থেকে রথ, ১৫ দিন কেন বন্ধ থাকে জগন্নাথের গর্ভগৃহ? যে পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে

১৭৪৫ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির এলাকার রথযাত্রার উৎসবের সূচনা হয়। সাধারণের থেকে বেশি জনসমাগম নিয়ে প্রায় প্রতি বছর এই রথযাত্রার উৎসব পালন করা হয়। ১৭৪৫ সালে তৈরি হওয়া রথটির তেরোটা চূড়া ছিল। ১৮৭৩ সালে একটি দুর্ঘটনার পরে চূড়ার সংখ্যা কমিয়ে নয় চূড়াবিশিষ্ট রথ তৈরি করা হয় এবং জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

রথ উৎসবের কথা বললে বিভিন্ন রাজপরিবার অথবা জমিদার পরিবারের রথযাত্রার উৎসব পালনের কথা উঠে আসে। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির প্রাক্তন রাজপরিবারের রথযাত্রা নিজের মতো করেই অনন্য। ১৭৭৬ সালে রানি জানকী দেবী এই রথযাত্রার সূচনা করেন। তেরোটা চূড়াসমৃদ্ধ সেই পাঁচতলা রথটি প্রায় ৭৫ ফুট উঁচু ছিল। বর্তমানে পুরনো রথটির বদলে একটি নতুন রথ তৈরি করে রথযাত্রার সময় ব্যবহার করা হচ্ছে। পরম্পরা মেনে রাজা অথবা রাজপরিবারের প্রধান প্রতি বছর লোকলস্কর-সমেত পালকি করে এসে রথের দড়িতে টান দিয়ে রথযাত্রার সূচনা করেন।

কলকাতার হারিয়ে যাওয়া রথযাত্রার কথা বললে প্রথমেই নাম আসবে বৈঠকখানার ৭০ ফুট উঁচু রথের, যার বর্ণনা বিভিন্ন বইতে পাওয়া যায়। বউবাজার থেকে লালদীঘি অবধি সেই রথ টানা হতো। এছাড়া পোস্তার তিনটে রথের কথাও সেই সময়ের বিভিন্ন নথি থেকে জানতে পারা যায়। সেই রথ বৈঠকখানার রথের মতো আকারে বড় না হলেও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। যদিও ১৭১৯ সালে সূচনা হওয়া বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির রথযাত্রা উৎসব এখনও প্রতি বছর পালন করা হয়।

রথযাত্রার দিনে রথ না হয় টানতে পারলাম না, কিন্তু এই আলাদা আলাদা রথযাত্রার মধ্যে কোনও একটা উৎসব দেখে মেলায় গিয়ে পাঁপড় খাওয়াটা রথ দেখা আর কলা বেচার আদর্শ উদাহরণ হতে পারে।

More Articles