ডিজিটাল মুদ্রা আর ক্রিপ্টোকারেন্সির ফারাক কোথায়, নতুন অর্থব্যবস্থা নিয়ে যে তথ্যগুলি জানতেই হবে

১ ফেব্রুয়ারি সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এবারের বাজেটে সবথেকে বেশি পরিবর্তন এসেছে ডিজিটাল কারেন্সি এবং ডিজিটাল ব্যাঙ্কিংয়ের জগতে। বাজেট বলছে যাঁরা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকারী রয়েছেন, তাদেরকেও এবার থেকে দিতে হবে আয়কর। আর শুধু যে তাদেরকে আয়কর দিতে হবে তাই নয়, তাদের ক্ষেত্রে আয়করের লিমিট সব থেকে উপরেরটা অর্থাৎ একেবারে ৩০%। অর্থমন্ত্রীর নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করলেন, ভারতের কোনো নাগরিক যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ডিজিটাল মুদ্রায় কোনো লেনদেন করেন, কিংবা তাতে বিনিয়োগ করেন, তাহলে তাদেরকে বেশ মোটা অঙ্কের আয়কর দিতে হবে। তবে শুধু যে আয় করলেই আয়কর দিতে হবে তা কিন্তু নয়, যদি ক্রিপ্টো বিনিয়োগে আপনাদের লোকসানও হয়, তাহলেও আপনাকে দিতে হবে সেই ৩০ শতাংশ আয়কর। 

এছাড়াও, যদি আপনি কাউকে ক্রিপ্টোকারেন্সি গিফট করেন, তা হলেও তা আয়করের মধ্যেই পড়বে। ঘুরপথে সরকার ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মান্যতা দিলেও ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীদের জন্য এই ঘোষণা একেবারেই সুখকর নয়। অন্যদিকে, যারা ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং এবং ভারতের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে আগ্রহী তাদের জন্যও একাধিক বড় ঘোষণা করলেন নির্মলা সীতারামন। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন এই বছর কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ দফতর ডিজিটাল মুদ্রা এবং ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং এর উপরে জোর দিতে চলেছে। তৈরি করা হবে ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং সেক্টর এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ে আসবে তাদের নিজস্ব ডিজিটাল কারেন্সি। কিন্তু কীভাবে এই সমস্ত সেক্টরে কাজ করবে কেন্দ্রীয় সরকার?

ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ঘোষণা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে ৭৫টি জেলায় ৭৫টি আলাদা আলাদা ডিজিটাল ব্যাংকিং ইউনিট তৈরি করা হবে। কিন্তু, এই ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং ইউনিট কাজ কীভাবে করবে? অর্থমন্ত্রী বললেন, ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতার বছরে ৭৫ জেলায় ৭৫টি ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং ইউনিট তৈরি করবে কেন্দ্র। এই সমস্ত ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং ইউনিট কাজ করবে মূলত বিভিন্ন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের দ্বারা। 

সরকারে আসার সময় থেকেই আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি ভারতের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার উপরে সরাসরি নজর দিয়েছেন এবং ইউপিআই এবং অন্যান্য খাতে উন্নতির জন্য খরচ হয়েছে দেদার। তবে, এখনো ভারতের সিংহভাগ জনতা নগদ মাধ্যমে লেনদেন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই বিষয়টি আরো বেশি করে নজরে পড়ে। তাই গ্রামের জনতাকে ডিজিটাল লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করতেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং ইউনিট তৈরি করার পদক্ষেপ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। 

অন্য দিকে, ইন্ডিয়া পোস্ট পেমেন্ট ব্যাঙ্ক অর্থাৎ পোস্ট অফিসের অ্যাকাউন্টকেও কোর ব্যাংকিং এর মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পোস্ট অফিস ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও চালু হয়ে যাবে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং, মোবাইল ব্যাঙ্কিং, অনলাইন ফান্ড ট্রানস্ফার, এটিএম এবং ডেবিট কার্ডের সুব্যবস্থা সহ একাধিক বিষয়। এতদিন পর্যন্ত পোস্ট অফিসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এত কিছু সুবিধা দেওয়া হতো না, ফলে এমআইএস বা পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়া বিশেষ কেউ পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট খুলতেন না। ফলে পোস্ট অফিসের গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে কমে আসছিল। সেখান থেকে পোস্ট অফিসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকে পুনরায় উজ্জীবিত করার পরিকল্পনা নিলেন অর্থমন্ত্রী।

আরও পড়ুন-ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ঠিক কতটা মান্যতা দিচ্ছে সরকার? জানুন অন্দরের কথা

নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করলেন, 'পোস্ট অফিসের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে এই ধরনের নতুন ব্যবস্থাগুলি গ্রামীণ জনতার কাছে লাভজনক প্রমাণিত হবে। কৃষক থেকে শুরু করে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই বিষয়টি কার্যকরী হবে।' এছাড়াও ডিজিটাল ট্রানজাকশন এবং ডিজিটাল পেমেন্টকে আরো সচল করতে এই সেক্টরের উপরে ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গ্রামীণ এবং উন্নতশীল এলাকায় ডিজিটাল পেমেন্টের উন্নতিকল্পে ও ফাইনান্সিয়াল টেকনোলজি ইকোসিস্টেমের আরো উন্নতি করতে এই বিনিয়োগ সাহায্য করবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। 

অর্থ বাজেট ২০২২ ও স্টার্টআপ 

ডিজিটাল পেমেন্ট এর অগ্রগতি হলেও স্টার্টঅাপের মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেটের উপরে তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না এবারেও। ফাইনান্সিয়াল টেকনোলজি স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরি করা হলেও, স্টার্টআপগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ বাজেট এর বিশেষ কোনো প্রভাব পড়লোনা। ইউপিআই এবং রূপে ট্রানজাকশনের ক্ষেত্রে স্টার্টআপের জিরো মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট নিয়ে কোনো ঘোষণাই করলেন না কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ভারত সরকারের ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমের সবথেকে বড় ইন্ডাস্ট্রি বডি পেমেন্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্টে উঠে এসেছে, ইতিমধ্যেই জিরো মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট এর জন্য ভারত সরকারের ৫,৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, এই সমস্যাটি নিয়ে কোনো রকম কোনো ঘোষণা শোনা গেল না অর্থমন্ত্রীর গলায়, যা স্টার্টআপ ব্যবসায়ীদের খুব একটা আশা যোগাতে পারল না।

ভারতীয় ডিজিটাল কারেন্সির ভবিষ্যৎ কী?

গতকালের অর্থ বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করলেন, এই অর্থবর্ষে কোন না কোন একটি সময় থেকে ভারতে চালু হবে নিজস্ব ডিজিটাল কারেন্সি। যেখানে ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়টির জনপ্রিয়তা বাড়ছে হু হু করে, সেখানেই নিজস্ব ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে এসে যুব সমাজকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন  কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। অনেকের মনে থাকবে, মাস কয়েক আগে থেকে ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিল চীন। ইতিমধ্যেই চীন সরকার তাদের ডিজিটাল ইয়ুয়ান নিয়ে ট্রায়াল শুরু করে দিয়েছে। চীনের সঙ্গে টেক্কা দিতেই এবারে নিজস্ব ডিজিটাল কারেন্সির ঘোষণা করে দিল ভারত সরকার। তবে এই ডিজিটাল কারেন্সি কতটা সুরক্ষিত এবং ডিজিটাল ইকোনমির ক্ষেত্রে কতটা লাভজনক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 

শ্রীমতি সীতারামন নিজের বাজেট ঘোষণা উল্লেখ করলেন, 'সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি ডিজিটাল ইকোনমির ক্ষেত্রে বিশেষ লাভজনক প্রমাণিত হতে চলেছে। এছাড়াও কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল কারেন্সি অনেকের ক্ষেত্রে অনেকটা লাভবান বলে প্রমাণিত হবে। তবে, যারা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করেন অথবা ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে চর্চা করেন, তারা কিন্তু কখনই ডিজিটাল রুপিকে ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস এবং একটি প্রধান জায়গায় ডিজিটাল রুপি বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির থেকে আলাদা। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কী ভাবে কাজ করবে এই ডিজিটাল রুপি এবং কী ভাবে সেটি ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে আলাদা হবে? 

ক্রিপ্টোকারেন্সি যেভাবে ব্লকচেইন টেকনোলজির মাধ্যমে কাজ করে, ঠিক একইভাবে কাজ করবে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি। তবে, এই মুদ্রাটি কিন্তু শুধুমাত্র ভারতীয় টাকার একটি ডিজিটাল ভার্সন। ফিয়াট কারেন্সি ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনারা একে অন্যের সঙ্গে এই ডিজিটাল কারেন্সি লেনদেন করতে পারবেন। ডিজিটাল পেমেন্ট এর ক্ষেত্রে ঠিক যেরকম ভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি কাজ করে, ঠিক একই ভাবে কাজ করবে সিবিডিসি। এর কিছু সুবিধাও আছে, ছেঁড়া নোট বা জ্বালিয়ে দেওয়া নোট, এই সমস্ত সমস্যা থাকবে না, আপনার কাছ থেকে কখনো এই ডিজিটাল কারেন্সি হারিয়ে যাবে না। নোট যেমন একটা সময় পরে অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যায়, সেরকম সমস্যা ও এখানে নেই। সমস্ত ধরনের ডিজিটাল পেমেন্ট এর ক্ষেত্রে এই ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করতে পারবেন আপনারা। এমনকী, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এই ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি কাজ করবে। সর্বোপরি, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সিতে আপনার ঝুঁকির পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে অনেকটাই কম, যা এটিকে বিটকয়েনের থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে ভারতীয় জনগণের জন্য।

সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির তফাৎ কি? 

এই দুই ধরনের ডিজিটাল কারেন্সির প্রধান তফাতটাই হল কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের। ব্লকচেইন টেকনোলজি, যা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রীকৃত, অর্থাৎ কম্পিউটারের একাধিক নেটওয়ার্কের মধ্যে বিটকয়েন এর সমস্ত তথ্য সঞ্চিত থাকে। সাইবার অ্যাটাকের ঝুঁকি, তথ্যের অপব্যবহার-সহ একাধিক সমস্যা থেকে যায় এই বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রাব্যবস্থার ক্ষেত্রে। সেই জায়গাতেই, কিছুটা আলাদা ভাবে কাজ করবে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি। যেহেতু আরবিআই এর দ্বারা ডিজিটাল কারেন্সি বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কিন্তু, সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে না এই মুদ্রার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সিকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। বস্তুত, ব্যাংক এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেক্টরের বাইরে এই ব্লক চেইন টেকনোলজি পৌঁছাবে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন পাবলিক এবং প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংক, এবং বিভিন্ন পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের মাধ্যমেই এই ব্লকচেইন সিস্টেম চালাতে পারে ভারত সরকার। ফলে, যারা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সিতে বিনিয়োগ করবেন তাদের ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটাই কমে যাবে। 

ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ভারত সরকার  

তবে, ২০২২-২৩ অর্থ বর্ষের কেন্দ্রীয় অর্থ বাজেটের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘোষণাটি ছিল কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে। একদিকে যেমন, ঘুরপথে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মান্যতা দিল ভারত সরকার, তেমনি অন্যদিকে যারা ভারতীয় ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকারী রয়েছেন তাদের জন্য নিয়ে এল খারাপ খবর। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মঙ্গলবার ঘোষণা করলেন, এবার থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির উপরে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে বিনিয়োগকারীদের। অর্থাৎ, আপনার সঞ্চয় করে রাখা ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্য এক ধাক্কায় কমে গেল ৩০ শতাংশ। এতদিন পর্যন্ত যারা ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে নিয়মিত চর্চা করতেন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে নিয়মিত বিনিয়োগ করতেন, তাদের জন্য এই বাজেট খুব একটা সুখকর না। আরবিআই এর ডিজিটাল রুপিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ঘুরপথে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ খানিকটা হলেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলেন নির্মলা সীতারামন। 

মূলত যুব সমাজের কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল বিগত কিছু বছরে। তাৎক্ষণিক এবং দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি, এটাই ছিল বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল ইউএসপি। কিন্তু এখন আর সেরকম নয়, এবার থেকে, আপনি ক্রিপ্টোকারেন্সিতে যত টাকা বিনিয়োগ করুন না কেন আপনাকে ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। সেবির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ কমিটির মুখপাত্র জিতেন্দ্র সোলাঙ্কি বললেন, বর্তমানে ভারতের বহু মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন, এবং এই বিষয়টাই ভারত সরকারের কাছে সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তিনি বললেন, "এতদিন পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কমিটি ছিল না এবং এই ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে বিশাল পরিমাণ এর রিটার্ন পাওয়া যেত, যা বিনিয়োগকারীদের অত্যন্ত আকৃষ্ট করে ছিল এতদিন। তবে এই ধরনের ডিজিটাল কারেন্সির কোনো মান্যতা ছিল না। এখন থেকে ভারত সরকার এই ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে আয় করা শুরু করবে। তবে হ্যাঁ, ভারত সরকার প্রথম থেকেই চেয়েছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার বন্ধ করতে এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করতে। এই নতুন করের নিয়মে একদিকে যেমন ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমবে, তেমনি যারা নিয়মিত ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে চর্চা করেন তাদেরকেও ভারত সরকারকে আয়কর দিতে হবে। ফলে এই একটি করের বোঝা ভারত সরকারের জন্য দুদিক থেকেই লাভবান হতে চলেছে।"

তবে হ্যাঁ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এর এই বিশেষ বাজেটের ডিজিটাল কারেন্সি এবং ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং বিষয়গুলি ভারতের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কতটা লাভজনক হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। নির্মলা সীতারামন এর এই বাজেটে উচ্চাকাঙ্খার অভাব অত্যন্ত প্রকট। তরুণ প্রজন্মের আশাভঙ্গের কোনরকম সুরাহা তিনি করলেন না। এমনকি যে সমস্ত তরুণ বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন সীতারামন। দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রম বাজারের মর্মান্তিক পরিস্থিতি, সেখানে তরুণ সমাজের আশাভঙ্গ নিয়ে তেমন কোনো ঘোষণা শোনা গেল না নির্মলা সীতারামন এর মুখে। অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পগুলিকে একসাথে এমএসএমই ক্ষেত্র হিসেবে বিচার করলেন তিনি। অনেকেই মনে করেছিলেন, স্টার্টআপ ব্যবসার জিরো এমডিআর নিয়ে কোনো বড় ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু তেমনটা তো হলোই না, বরং তিনি ডিজিটাল পেমেন্টকে আরো ছড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েই এখনও ব্যস্ত।

সরকারের আয় বৃদ্ধি করার একাধিক পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাল পেমেন্টকে সহায়তা করছেন যেন সকলে টাকা ব্যাংকে রাখতে চায়, এবং সরকারের আয়কর গ্রহণে কোনো সমস্যা না হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সির উপরেও আয়কর চাপিয়ে দিলেন তিনি, যাতে সরকারের আয় হয়। নিয়ে আসছেন ভারতীয় ডিজিটাল কারেন্সি, যা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হবে আর বি আই এর দ্বারা, ফলে সরকারের হাতে থাকবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি ছাড়া সমস্ত কিছুকেই অ্যাসেট এর আওতায় নিয়ে এলেন তিনি, যার ফলে বাধ্য হয়েই সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগ করতে হবে এই সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সিতে। স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং আর্থিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বর্ধিত ব্যবহার নিয়েও ঘোষণা করলেন তিনি। কিন্তু, ভালোভাবে দেখতে গেলে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের উপরে জোর দিয়ে এই ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিলেন তিনি। তিনি মনে করছেন, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা করোনাভাইরাস সংকট থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু সত্যি কি তাই? অর্থমন্ত্রীর যদি এরকম আত্মবিশ্বাস থাকে, তাহলে তাকে কিন্তু দুঃসাহসী বলতেই হয়। 

এখনো করোনাভাইরাস এর তৃতীয় প্রবাহের হাত থেকে ভারত নিষ্কৃতি পায়নি। এখনো প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়েছে এই তৃতীয় প্রবাহ নিয়ে। তার মাঝেই বিভিন্ন রাজ্যে খুলে যাচ্ছে স্কুল কলেজ, যা এই করোনাভাইরাস এর গ্রাফকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে। ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর আশাবাদের সঙ্গে সোমবার তারই দপ্তর থেকে প্রকাশিত একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষার অমিল চোখে পড়ছে লক্ষ্যণীয়ভাবে। সেই অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেই স্পষ্ট, গত দুই বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। চাকরির বাজারে মন্দা, মানুষের আয় কমেছে একই সাথে। দেশের বাজারে চাহিদা যদি না ফেরে, তাহলে এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ফিরিয়ে আনাও বেশ মুশকিল। যদি আমরা ২০১৯-২০ সালের অর্থব্যবস্থাকে আপাতত অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নিই, তাহলেও কিন্তু ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সেই জায়গায় পৌঁছাতে সময় লাগবে বেশ কিছু বছর। এই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল মানুষের হাতে কাজ, শিল্পের উন্নতি, গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলিতে একাধিক ব্যয় বরাদ্দ। কিন্তু, সেগুলিতে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে, সরাসরি ডিজিটাল পেমেন্ট এবং ডিজিটাল কারেন্সিকে এগিয়ে নিয়ে আসলেন অর্থমন্ত্রী। সম্ভবত এই অর্থ বর্ষের বাজেটের সব থেকে বড় ধাক্কা খেতে চলেছে ভারতের গরিব এবং খেটে খাওয়া মানুষেরা। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প অর্থাৎ মনরেগা, এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে গণবণ্টন ব্যবস্থার উপরে ব্যয় বরাদ্দ প্রভূত পরিমাণে ছেটে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কর্মসংস্থানের উপরেও তেমন একটা গুরুত্ব দেননি অর্থমন্ত্রী। খুব একটা বুঝতে অসুবিধা হবে না, এই বাজেটে প্রান্তিক মানুষদের জন্য তেমন কোন সুবিধা দেওয়া নেই।

ভারতীয় কৃষির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার মতো কোনো প্রকল্প দেখা গেল না এই অর্থ বাজেটে। যদি মাঝারি মেয়াদে কৃষি লাভজনক করে তোলার চেষ্টা করা হতো তাহলে কিন্তু এতটা সমস্যা হতো না। কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্যমূল্য পান্তা নিশ্চিত করা দরকার ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুটি ক্ষেত্রে বরাদ্দ কিছুটা বৃদ্ধি হলেও মূল্যস্ফীতির অংক হিসাব থেকে বাদ দিলে এই দুটি সেক্টরেও খুব একটা লাভ হবে না। বরাদ্দ কমছে প্রত্যেকটি সেক্টরে, আয়কর ছাড় নিয়েও কোনো ঘোষণা করলেন না অর্থমন্ত্রী। বিরোধীদের কটাক্ষ রইল, গরিবদের জন্য এই অর্থ বাজেট সম্পূর্ণ ফাঁপা। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার প্রধান চালিকাশক্তি যেখানে মানুষের ভোগ ব্যয়, সেখানেই ডিজিটাল কারেন্সি এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে মাতামাতি করলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু, ভারতে ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করেন কয়জন? গ্রামের দিকের মানুষের কাছে যেখানে স্মার্ট ফোন পর্যন্ত নেই, তাদের কাছে ডিজিটাল কারেন্সি কি কাজে লাগবে? ইউপিআই বা এই সমস্ত ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম তাদের কি এমন সুবিধা দেবে? অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা ছিল, ভারতের জনসাধারণের সমস্যা দূর করতে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তা তো হলোই না, বরং, স্বাধীনতার অমৃত কালের চিন্তায় তিনি বিভোর হয়ে রইলেন।

More Articles