ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ঠিক কতটা মান্যতা দিচ্ছে সরকার? জানুন অন্দরের কথা
সাল ২০০৮। আমেরিকান বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স জানালো তারা দেউলিয়া হয়েছে, তাদের পক্ষে আর বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ঘটনা সূচনা করল নতুন শতাব্দীর প্রথম বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধসের। গোটা পৃথিবীতে নেমে এলো মন্দার অন্ধকার। ইতিহাসে যখনই এমন কিছু ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, যখনই সঙ্কট এসেছে, তখনই পাওয়া গেছে নতুন দিশার খোঁজ। ওই অর্থনৈতিক সঙ্কটের আবহে, খানিকটা সিনেমার ধাঁচে জন্ম হয়েছিল এক বিপ্লবীর, যিনি ভবিষ্যত পৃথিবীর অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে বিপ্লব আনবেন। তার নাম সাতোশি নাকামোতো। ছদ্মনাম বললে বেশি ভালো হয়, কারণ তার আসল পরিচয় আজ ও আমরা জানতে পারিনি।
সম্প্রতি সংসদে পেশ হল আগামী অর্থবর্ষের বাজেট। অন্যান্য বছরের থেকে এই বাজেট খানিক আলাদা। হ্যাঁ, প্রত্যেক বাজেটের পরেই সংবাদমাধ্যমগুলি এক সুরে একই কথা বলে, কিন্তু এই বারের বাজেট সত্যিই আলাদা, এবং ভবিষ্যতের দিক নির্দেশকারী। কিন্তু এবারের বাজেটকে আলাদা বলছি কেন? কারণ এই অর্থবর্ষে প্রথম সরকারের ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে নীতির দিশা পাওয়া গেল, অর্থাৎ ভবিষ্যতে কীভাবে এই বিষয়ে নীতি নির্ধারণ হবে তার আভাস পাওয়া গেল। কী ভাবে? সরকার জানাল, ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলিকে তারা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম বা মুদ্রা হিসেবে দেখছেন না, বরং এগুলিকে শুধু মাত্র সম্পদ হিসেবে দেখা হবে, এবং এই ক্রিপ্টো কয়েনে বিনিয়োগ করে আপনি যে পরিমাণ অর্থ লাভ করবেন, সেই লাভের অঙ্কের ওপর ত্রিশ শতাংশ কর আদায় করবে সরকার। ধরুন, আপনি একশ টাকার বিটকয়েন কিনেছেন, বিক্রি করলেন দুশো টাকায়। তার মানে আপনার লাভ হল একশ টাকা, এবার আপনি এই লাভের একশ টাকার তিরিশ শতাংশ অর্থাৎ ত্রিশ টাকা কর দেবেন।
এখানেই শেষ নয়, আরো আছে চমক। আগামী অর্থবর্ষেই শীর্ষ ব্যাঙ্ক ব্লকচেন প্রযুক্তির উপর ভর করে আনতে চলেছে দেশের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা বা বলা যেতে পারে আরবিআই-এর নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি। তবে এই মুদ্রা হবে আমাদের টাকার ডিজিটাল অবতার, অন্যান্য ক্রিপ্টোকয়েনের মত সম্পদ হিসেবে এটি গন্য হবেনা। তবে কি এই কর বসানোর মাধ্যমে ভারত সরকার কৃপ্টোকে মান্যতা দিল? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রা এলে বাকিদের ভবিষ্যত কী?
আরও পড়ুন-দশজন সেরা ক্রিকেটার যাদের উপেক্ষা করেছেন অধিনায়ক কোহলি
ভারত সরকার এই যে ক্রিপ্টো বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইছে, এটা নতুন নয়, একেবারে অস্বাভাবিকও নয়। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যেই এই কাজ শুরু করে দিয়েছে, এল স্যাল্ভেদরের মতো দেশ বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি ও দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন? এবং বাকি যা যা প্রশ্ন উঠে আসছে সব বুঝতে গেলে ইতিহাসটা একটু জানতেই হবে। জানতে হবে ব্লকচেন প্রযুক্তির কথা, ওয়েব থ্রির কথা।
সাতোশি ২০০৯ সালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। যেখানে গোটা বিশ্বকে ব্লকচেন প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এক বিকেন্দ্রীভুত অর্থব্যবস্থার সাথে পরিচয় করান। ব্লকচেন কী? তথ্য স্থানান্তর ও তথ্য সংগ্রহের এক মাধ্যম। কিন্তু ব্লকচেন নাম কেন? কারণ এই প্রযুক্তিতে চেন বা শৃঙ্খলার মাধ্যমে তথ্য ব্লকের আকারে সঞ্চিত থাকে। প্রত্যেকটি ব্লক একেবারে স্বতন্ত্র এবং তার একটি কোড থাকে। এবার আপনি যদি এই তথ্যে বা ধরুন একটি ব্লকে জল মেশাতে যান, তাহলে তার পরের প্রত্যেকটি ব্লকের কোড পরিবর্তন হয়ে যাবে, এবং আপনি ধরা পড়ে যাবেন। খুব সংক্ষেপে বললাম বিষয়টা। এবার ফিরে যাওয়া যাক ২০০৯ সালে। সাতোশি গোটা পৃথিবীকে কেন্দ্রীভুত অর্থ ব্যবস্থার ওপর তাঁর অনাস্থার কথা জানান। তিনি দেখান ২০০৮ সালের মন্দা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ভঙ্গুর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থারই ফলাফল এবং তারই পরিণামে জন্ম বিটকয়েনের।
তথ্য না হয় সুরক্ষিত এই ব্যবস্থায়, কিন্তু কিভাবে এই অর্থ ব্যবস্থা বিপ্লব আনবে? ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আপনি ব্যাঙ্কের অনুমতি ছাড়া এক পাও চলতে পারবেন না। ব্যাঙ্কের অনুমোদিত মুদ্রা, এবং সেই সঙ্গে ব্যাঙ্ক অনুমতি দিলে তবেই আপনি লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ, এখানে সমস্ত ক্ষমতা ব্যাঙ্কের কাছে কেন্দ্রীভূত এবং আপনি ব্যাংককে বিশ্বাস করেন আপনার সম্পদ আপনার অর্থ সুরক্ষিত রাখার জন্যে। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ লেনদেন হয় পিআর টু পিআর নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে। অর্থাৎ আপনি কারোর অনুমতি ছাড়া, নিজের সুবিধা মত অর্থ লেনদেন করবেন, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। এখানে আপনার লেনদেনটি স্বচ্ছ কিনা তার অনুমোদন দেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসে থাকা মাইনাররা, কোনো এক জন নয়। জটিল? আচ্ছা ধরুন, আপনি বিটকয়েনের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করবেন, আপনি টাকা পাঠাবেন আপনার বন্ধুকে। আপনার কাছে একশো টাকা আছে, আপনি টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মাইনাররা দেখলেন যে আপনার কাছে প্রকৃত অর্থেই একশো টাকা রয়েছে, তারা অনুমোদন করবেন, এবং টাকা পৌঁছে যাবে ঠিক জায়গায়, এবং একটি ব্লকে সেই তথ্য থেকে যাবে যা বদল করা প্রায় অসম্ভব।
২০০৯ সালে জানুয়ারির তিন তারিখে প্রথম বিটকয়েন তৈরি করেন সাতোশি। বাকিটা ইতিহাস। ২০১১ সালের পর থেকে বিখ্যাত হতে শুরু করে এই ক্রিপ্টোকয়েন। পরিণত হয় সম্পদে। বাজারে আসে একে একে ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন এবং আরো অনেক কয়েন। জীবন পাল্টে যেতে থাকে বিশ্বের চারদিকে অসংখ্য মানুষের। যে বিটকয়েনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ডলারের ভগ্নাংশ দাম দিয়ে, তার দাম গত বছর প্রায় সত্তর হাজার ডলারে গিয়ে পৌঁছায়, এবং কিছু দিন পরেই অনেকটা দাম পড়েও যায়।
বিভিন্ন সরকার ও তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেখে সিঁদুরে মেঘ। প্রথমত, সাতোশির তৈরি করা এই ব্যবস্থা সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্রীভূত অর্থ ব্যবস্থাকে, যেখানে মানুষ ব্যাঙ্ককের প্রভাব ছাড়া শুধু লেনদেনই করতে পারবে না, সেই সঙ্গে নিজে কয়েন মাইনিং করার মাধ্যমে তৈরিও করতে পারবে। ভেঙে পড়বে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। মুদ্রাস্ফীতি থেকে বাঁচতে মানুষ তাদের সব অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে বের করে ফেলবেন। তাই বেশির ভাগ সরকারই একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। কোনো দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পূর্ন নিষিদ্ধ করে নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কয়েন আনে (চিন), কোনো দেশ ৫৫% কর বসিয়ে দেয় (জাপান)। আমেরিকা এরকম কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও ভবিষ্যতে যে তারা পদক্ষেপ নেবে সে কথা জানিয়ে রাখে।
এবার আসি ভারতের কথায়। ২০১৮ সালে দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, তিনি ব্লকচেন প্রযুক্তি পছন্দ করেন কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সর্বনাশা মনে করেন। তাতে অবশ্য ভারতীয়দের বিনিয়োগ করা থেকে তিনি আটকাতে পারেননি। কেন্দ্রীয় সরকার জনগণকে চটিয়ে অপ্রিয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে অন্যান্য দেশের মত এই বিকেন্দ্রীভুত অর্থব্যবস্থাকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছে। শুরুতে কিছু প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করব বলেছিলাম। সবথেকে বড় প্রশ্ন, ভারত সরকার কি তাহলে ক্রিপ্টোকে মান্যতা দিলো? না। কর নেওয়া মানেই তাতে মান্যতা দেওয়া বলা যায় না। যতদিন না সরকার এই বিষয়ে বিল পাশ করিয়ে আইন প্রণয়ন করছে ততদিন বলা যায় না, বেআইনি কার্যকলাপ থেকেও সরকার অর্থ সংগ্রহ করে, করতে পারে। সুতরাং এখনই বিনিয়োগকারিদের খুব খুশি হওয়ার কারণ নেই। ভারতের ক্রিপ্টো বাজার ইতিমধ্যেই দশ হাজার কোটি টাকার। দেশের সরকারের মোটেই খুব একটা ভালো লাগার মতো বিষয় নয় এটা, কারণ এই দশ হাজার কোটির একটি টাকাও দেশের বাজারে বিনিয়োগ হয়নি। এখানেই আসে দ্বিতীয় প্রশ্ন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কয়েন আসার পর বাকিদের ভবিষ্যৎ। বলা খুব কঠিন, তবে সম্ভাবনা থেকেই যায় যে বাকি কয়েনগুলিকে নিষিদ্ধ করে সরকার শুধু তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েন রাখবে। সুতরাং, এখনই খুশি হবেন না।
আশা করি ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, যে ছদ্ম যুদ্ধ সবসময়ই চলছে, অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা এর বিকেন্দ্রীকরণ করে দেওয়ার মধ্যে। এইটুকু আপনাকে বলতে পারি, এই যুদ্ধের সবে শুরু। শুধু বিশ্বের সব দেশ নয়, বহুজাতিক সব অর্থনৈতিক সংস্থাও এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে শুরু করেছে, পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে ব্লকচেন নিয়ে। এবার সিদ্ধান্ত আপনার, আপনিও সময়ের দাবি মেনে নতুন সব প্রযুক্তিকে আপন করবেন না পুরোনো রীতি নীতি মেনে চলবেন।