মান্না দে আসতেন সরবৎ খেতে, এখনও সমান জনপ্রিয় কপিলা আশ্রম

২০১৯ সালে প্রথমে রাস্তার ধারে শেড করে দোকান চালু হলেও আজ ছোট্ট নতুন দোকানঘরে ফিরে এসেছে কপিলা আশ্রম।

 

বাঙালি কোকোকোলা খায়, মোজিটো খায়, ক্রাশার খায়, কিন্তু বাঙালি একদা একচেটিয়া সরবৎ খেত। জ্যৈষ্ঠর ঝাঁ ঝাঁ রোদে গলা শুকিয়ে গেলে পথের ধারে বুড়ো বটের তলায় জিরিয়ে নিত, গলা ভেজাত নানা কিসিমের ঘরোয়া ঠান্ডাইয়ে। বাঙালির এই অভ্যেসকে মূলধন করেই প্রায় ১১৪ বছর আগে উত্তর কলকাতার শ্রীমানী মার্কেটে একটি সরবতের দোকান খোলেন হৃষিকেশ শ্রীমানী। প্রোমোটারির চক্করে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার ২০১৯ সালে শুরু হয় কলকাতার এই ভিনটেজ সরবতের দোকান কপিলা আশ্রম।

 

বিবেকানন্দ রোড থেকে বিধান সরণি ধরে একটু এগিয়েই ‘কপিলা আশ্রম’। হাতিবাগান থেকে কলেজ স্ট্রিটের মধ্যে এক অন্যতম ল্যান্ডমার্ক । ১৯০৭ সালে ১২ বছর বয়সে দোকানটি তৈরি করেন হৃষিকেশ শ্রীমানী। গঙ্গাসাগরের কপিল মুনির আশ্রমের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নাম রেখেছিলেন ‘কপিলা আশ্রম’। ব্যবসা নয়, এটিকে তিনি সেবার মতোই দেখতেন। তাই ন্যূনতম একটা মূল্য ধার্য করেছিলেন সরবতের জন্য। যাত্রা শুরু হয়েছিল লেবুর সরবত দিয়ে, তারপর এল দইয়ের ঘোল।সরবতের জন্য ব্যবহৃত দই ঘরে নিজেই তৈরি করতেন হৃষিবাবু। টাঙ্গাইল অঞ্চল থেকে আসত ‘চন্দনী ক্ষীর'। সেই ক্ষীরের স্বাদও নাকি ছিল অসাধারণ। সেই ক্ষীর এবং দুধ থেকে বাড়িতেই তৈরি হত মালাই এবং তা থেকে মালাই সরবৎ। আস্তে আস্তে অন্যান্য নানা ফ্লেভারের সরবৎ বিক্রি শুরু হয়।

 

১৯৫২ সাল নাগাদ দোকানের দায়িত্ব নেন হৃষিবাবুর ছেলে বোধিসত্ত্ব শ্রীমানী। আয় বাড়াতে সরবতের পাশাপাশি কেকও বিক্রির পরিকল্পনা করেন বোধিসত্ত্ব। সাহেবপাড়া, নিউ মার্কেট এবং পার্ক স্ট্রিট চত্বর বাদ দিয়ে বাঙালিকে যদি কেউ কেক খাওয়াতে শেখায়, তা নিঃসন্দেহে কপিলা আশ্রম। এছাড়া আরও একটা জিনিস বিক্রি করতেন এই বাবা-ছেলে, যার নাম দিয়েছিলেন ‘টিফিন’। দোকানের ঠিক একটা বাড়ির আগেই ছিল ‘উইমেন্স কলেজ'। খুব সস্তায় ঠোঙা করে কোনওদিন কেক-কলা-নিমকি, আবার কোনওদিন কচুরি-সিঙাড়া-মিষ্টি (টিফিন) বিক্রি হতো। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়মিত দোকানে যেতেন বোধিসত্ত্ববাবুর ছেলে ছোট্ট দিব্যেন্দুও। ১৯৯৫ সাল থেকে দোকানের দায়িত্ব নেন তিনি।

 

আরও পড়ুন: এমবিএ করে চায়ের দোকান! এই ‘চা-ওয়ালা’ এখন দেশের অনুপ্রেরণা

 

এখন মূলত তিন রকমের সরবৎ (রোজ মালাই, কেশর মালাই এবং আবার খাই) এখানে সারাবছর পাওয়া যায়। সরবতের জন্য বাজার থেকে কাঁচামাল হিসেবে মূলত চিনি, দুধ, ক্ষীর এবং এসেন্স কেনা হয়। অনেক আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত এই এসেন্স। রোজ মালাইয়ে ব্যবহৃত এসেন্স ইউকে থেকে আনা হতো। তবে কেশর মালাইয়ে আজ আর কেশর দেওয়া হয় না। মানুষ মূলত যে দু'টি সরবৎ খোঁজেন, সেগুলো হল ‘কেশর মালাই’ এবং ‘আবার খাই’। এই ‘আবার খাই’ সরবৎটি ১৯৯২ সালের পর বোধিসত্ত্ববাবুর মারা যাবার পর বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালে নবসাজে ফিরে আসে এই ‘আবার খাই’। এলাচ, রোজ ভ্যানিলা এবং স্যাফ্রনের সংমিশ্রণে তৈরি এই সরবৎ যেন বেহেস্তের প্রবেশদ্বার। এছাড়া গরমের সময় পাওয়া যায় কাঁচা আমের সরবৎ। আমের সরবতের সঙ্গে নানা রকম মশলাও মেশানো হয়। এছাড়া গরমকালে থাকে পুদিনা পাতার সরবৎ। দধিতি এখানের আরও একটি বিখ্যাত সরবৎ। তবে আজ আর তৈরি হয় না দধিতি। উত্তর কলকাতা এলে একবার এই দোকানের মালাই সরবৎ খেয়ে দেখতে পারেন। আর একবার খেলেই প্রেমে পড়ে যাবেন এর। স্বাদ ও স্বাস্থ্যবিধি দুইয়ের সঙ্গেই কোনও আপস করা হয় না আজও।

 

কপিলা আশ্রমে তৈরি কেক বরাবরই গোল আকৃতির। সারাবছর কেক তৈরি হলেও মূলত বড়দিনের সময়ই তার চাহিদা বেশি। সেই সময় মূলত আটরকমের কেক তৈরি হয়। কপিলা আশ্রমের কেকের ইউএসপি হল এতে বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয় না। একসময় পেস্ট্রি এবং নানা দিলবাহারি কেক পাওয়া গেলেও এখন আর মেলে না। মূলত কারিগরের অভাবে বন্ধ হয়েছে এই রেসিপি। বড় ঝকঝকে প্রতিষ্ঠানের মতো পুঁজি নেই কপিলা আশ্রমের, ফলত কারিগর ধরে রাখা অসুবিধের। এখন প্রধানত ফ্রুট কেক তৈরি হয় এবং তাতে রকমারি স্বাদেরও উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।

 

দুধ বা ক্ষীরের মানের পরিবর্তন হওয়ায় সরবতের মানেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে বলে স্বীকার করছেন দিব্যেন্দুবাবু। কিছু বছর আগেও পুরনো ভাঙাচোরা দোকানের অবস্থা দেখে অনেকে বুঝতেই পারতেন না এটি একটি সরবতের দোকান। তবে সরবতের জনপ্রিয়তা আজও কমেনি। ২০১৯ সালে প্রথমে রাস্তার ধারে শেড করে দোকান চালু হলেও আজ ছোট্ট নতুন দোকানঘরে ফিরে এসেছে কপিলা আশ্রম। এলাকার পুরনো মানুষ, কলেজ পড়ুয়ারা আজও এই এলাকায় এসে খোঁজ করেন কপিলা আশ্রমের সরবতের।

 

তবে সহজে মেলেনি এই দোকান। দীর্ঘ দিন কোর্ট কেস চলেছে এর জন্য। অবশেষে নতুনভাবে ফিরে এসেছে দোকান। আজও বাজারের তুলনায় যথেষ্ট কম দামেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি হয় সরবৎ। সময় বদলেছে, কাঁচা জিনিসের গুণমানও বদলেছে অনেক। তবে এখনও স্বাদের কোনও তুলনা হবে না শতাব্দীপ্রাচীন সরবতের দোকানের। এক সময় মান্না দে সরবৎ খেতে আসতেন এই দোকানে। আজ নতুন প্রজন্ম এসে ভিড় করলে হারানো প্রাণ ফিরে পায় এই সরবতের দোকান।

 

More Articles