এমবিএ করে চায়ের দোকান! এই 'চা-ওয়ালা' এখন দেশের অনুপ্রেরণা
MBA chaiwallah of India : দু'মাসের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয় চায়ের দোকান। কিন্তু প্রফুল হার মানেননি।
ব্যস্ত জীবনে দু'দণ্ড বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বা অতিথি আপ্যায়ন কিংবা তর্কের সময় খানিক গলা ভিজিয়ে নিতে সকলেরই প্রথম পছন্দ চা। আর এই চা বেচে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যাও ভারতে কম নয়।তবে আমরা কিন্তু কেউই চাওয়ালাদের খুব উঁচু নজরে দেখি না। কিন্তু এমন এক চা-ওয়ালা রয়েছেন, যিনি শুধু সফল ব্যবসায়ী নন, অনুপ্রেরণাও বটে। তাঁর কথা জানলে চা-ওয়ালা সম্পর্কে ধারণাই বদলে যাবে আপনার। আজ তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষ। কেউ আবার অভাবের তাড়নায়, চাকরির অভাবে বাধ্য হয়েছেন এই পথে হাঁটতে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন এক চা-ওয়ালার কথা।
এমবিএ চা-ওয়ালা
ভারতের প্রতিটা ছাত্রের কাছেই আজ স্বপ্নের ডিগ্রি এমবিএ। এমনই একজন ছাত্র প্রফুল বিল্লোর। দু'বছর ধরে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারেনি প্রফুল। হতাশা কাটাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এই তরুণ। এরপর জীবনে কী করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে গিয়েছিল ছেলের। কিছু করার ইচ্ছায় একসময় ৩৭ টাকা প্রতি ঘণ্টা হিসেবে 'ম্যাকডোনাল্ডস'-এ কাজ জুটিয়ে নেন তিনি। সুইপার থেকে শুরু করে অর্ডার নেওয়ার কাজ সবই তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেন প্রফুল। কিন্তু নিজের পরিচয় তৈরির তাগিদে অন্য কিছু করার কথা ভাবতেন এই তরুণ। প্রফুলের কথায়, "এমন কিছু বেচার পরিকল্পনা করছিলাম, যা সারা দেশের মানুষকে বাঁধতে পারে। দিনরাত সবসময়ই মানুষ তা খেতে চাইবে। সেই সময় চায়ের কথা মাথায় আসে। একমাত্র চা-ই আমাকে ক্যাটের প্রস্তুতির সময়েও সঙ্গ দিয়েছিল।"
তিনি আরও বলেছেন, "ছোট ভাবেই শুরুর কথা ভেবেছি প্রথমে। সেইমতো প্রয়োজনীয় বাসনপত্র কিনতে শুরু করি।" জিনিস কিনেই যে দোকান শুরু করতে পেরেছিলেন, এমন নয়। নিজেকে সাহস জোগাতে সময় লেগেছিল আরও ৪৫ দিন। নিজে কখনও বাড়িতে এক কাপ চা বানিয়েও খাননি। তাই আদৌ তিনি সেই কাজ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ও ছিল মনে। অবশেষে বাবার কাছে মিথ্যে বলে ১০,০০০ টাকা ধার নিয়ে শুরু করেন চায়ের দোকান। কোনও কাজই ছোট নয়, শুধু লক্ষ্য বড় হওয়া প্রয়োজন - এই ছিল প্রফুলের জীবনের মন্ত্র।
প্রথমদিন কোনও লোকের দেখা মেলেনি দোকানে। দ্বিতীয় দিন নিজেই লোকের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন একবার চা চেখে দেখার জন্য। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে শুরু করে দোকানে। দ্বিতীয় দিনের ৩০ টাকা তৃতীয় দিনে ৬০০ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে স্থানীয় এক কলেজে এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তিও হয়ে যান প্রফুল। কিন্তু সাত নম্বর দিনেই ছেড়ে দেন কলেজ।
আরও পড়ুন: তিরিশ বছর ধরে পুরুষ সেজে কাটালেন এই মহিলা! কারণ জানলে মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জায়
ব্যবসা বাড়তেই প্রথম বাধা আসে পথে। দু'মাসের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয় চায়ের দোকান। কিন্তু প্রফুল হার মানেননি। নতুনভাবে, বেশ কিছুদিন পরে এক হাসপাতালের সামনে ফের চায়ের দোকান শুরু করেন সেই জেদি তরুণ। তবে এবার শুধু চা নয়, সঙ্গে চাকরি জোগাড়, পাত্র-পাত্রীর সন্ধান, এমনকী, সেবামূলক কাজের সাথে জড়াতে শুরু করেন এই তরুণ। এই সময় দোকানের নাম দেন 'এমবিএ চায়ওয়ালা'। আজ কোটি টাকার মাসিক টার্নওভার রয়েছে এই ব্র্যান্ডের। সম্প্রতি কলকাতাতেও একটি আউটলেট চালু হয়েছে এই ফ্যাঞ্চাইজির। প্রফুলের কথায়, "নিজের জীবনের নকশা নিজের মতো করে তৈরি করো। কখনও নিজের প্রতি বিশ্বাস যেন না কমে। সাফল্য আসবেই।"
চা-ওয়ালি
২৪ বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ২০১৯ সালে পাটনা কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন। এরপর অর্থনীতির মন্দা এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে কিন্তু কোনও কাজ জোগাড় করতে পারেননি পাটনার তরুণী প্রিয়াঙ্কা গুপ্ত। একদিন ইন্টারনেটে 'এমবিএ চায়েওয়ালা' প্রফুলের ভিডিও চোখে পড়ে প্রিয়াঙ্কার। সেই থেকেই চায়ের দোকান দেওয়ার কথা মাথায় আসে প্রিয়াঙ্কার। তরুণীর মতে, "আমাদের চারপাশে অনেক চা-ওয়ালা রয়েছে তাহলে চা-ওয়ালি কেন নয়?"
নতুন কিছু করতে গেলে যে কটু কথা শুনতে হবে, তা ভালোভাবেই জানেন প্রিয়াঙ্কা। তাঁদের মুখ বন্ধ করতে দোকানে ব্যানারে লেখা রয়েছে, 'লোকে কী ভাববে- এই কথাও যদি তুমিই ভাবো, তাহলে তাঁরা কী ভাববে?' সঙ্গে আরও লেখা, 'খেতেই হবে!'
প্রিয়াঙ্কার এই পদক্ষেপ নেট নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মুহূর্তের মধ্যে। তবে প্রতিক্রিয়া এসেছে মিলিয়ে-মিশিয়ে। অনেকে বলেছেন যে, প্রিয়াঙ্কা মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা। মোটা মাইনের চাকরিকে যে সমাজ বেশি গুরুত্ব দেয়, সেখানে তাঁর এই পদক্ষেপ সব ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। অনেকে আবার অর্থনীতির বেহাল দশা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, এই পদক্ষেপ প্রিয়াঙ্কার অন্তপ্রনর হওয়ার থেকেও দেশের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে কাজের অভাবের দিকটিই তুলে ধরছে।
প্রফুল অনুপ্রেরণা
প্রফুলের যাত্রা তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছে জীবনকে নতুনভাবে দেখার। প্রফুলের নিজেও মনে করেন, "স্বপ্নের চাকরি না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, কিছু হবে না তোমার দ্বারা।" কেরলের আনন্দু, মহম্মদ সাফি এবং তাঁর ভাই সভানাস সকলেই পেশায় ইঞ্জিনিয়র। কিন্তু করোনা অতিমারী কেড়ে নিয়েছে চাকরি। অবশেষে তিন বন্ধু মিলে চায়ের দোকান খুলেছেন। দোকানের নাম 'বিটেক চায়'। প্রায় ৫০ রকম স্বাদের চা বিক্রি করেন তাঁরা। নীল চা, ডিম-দুধ চা- এমন নানা স্বাদের চা রয়েছে এই দোকানে।
প্রিয়াঙ্কার চা-ওয়ালি হয়ে ওঠার কথা আমরা জানলাম। এবার কলকাতা থেকে কিছু দূরে তেমনই এক চা-ওয়ালির হদিশ দিতে চলেছি। হাবড়া স্টেশনে ২৬ বছর বয়সি টুকটুকি দাসের চায়ের দোকান। দোকানের নাম 'এমএ ইংলিশ চাওয়ালি'। বাড়ির লোকের অবশ্য ইচ্ছে মেয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হোক। কিন্তু টুকটুকির কথায়, "দোকানের নাম রাখার পিছনে এমবিএ চায়ওয়ালা নামটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছে। যেহেতু চাওয়ালি নামটি আগেই ছিল তাই এই নাম রেখেছি। তবে এমএ চাওয়ালি রাখিনি কারণ আমি ভারতীয়দের ইংরেজি বলার প্রতি ঝোঁককে নামের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলাম।" এক বছর পর টুকিটুকি সেই দোকান তুলে দিয়েছেন। এখন কলকাতার বুকে একই নামে ক্যাফে খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
প্রফুলের যাত্রা নতুন প্রজন্মকে সাহস জুগিয়েছে। ভরসা দিয়েছে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করার। যতদিন পরিস্থিতি ঠিক না হয়, ততদিন অন্যভাবে বাঁচতে শেখাচ্ছে প্রফুলের কাহিনি।