গরমে হাসফাঁস, দিঘা-পুরী নয়, দু'দণ্ড শান্তি দেবে বরফে ঢাকা চারধাম

হিন্দু পুরাণে উল্লেখ আছে চারধাম যাত্রার। বলা হয়, জীবনে একবারমাত্র এই সুযোগ আসে। এবার ৩ মে থেকে শুরু হতে চলছে চারধাম যাত্রা। করোনার ভয় কাটিয়ে দু’বছর পর ফের তীর্থযাত্রার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন তীর্থযাত্রীরা। করোনা এখনও বিদায় নেয়নি। সেই কারণেই সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে শুরু হবে এই তীর্থযাত্রা। ৬ মে খুলতে চলেছে কেদারনাথ মন্দিরের দরজা। বদ্রিনাথ মন্দির খুলবে ৮ মে। কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রী- এই চারটি স্থানে যাত্রাই চারধাম যাত্রা নামে পরিচিত। প্রতি বছরেই লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী এই চারটি জায়গায় তীর্থযাত্রায় যান। ৩ মে শুরু হতে চলা চারধাম যাত্রার আগেই এবার উত্তরাখণ্ড সরকার দৈনিক জনসমাগমের সীমা নির্ধারণ করেছে। জানানো হয়েছে, বদ্রিনাথে প্রতিদিন ১৫ হাজার, কেদারনাথে ১২ হাজার, গঙ্গোত্রীতে ৭ হাজার এবং যমুনোত্রীতে ৪ হাজার তীর্থযাত্রীকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হবে। ৪৫ দিনের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।


একটা পুরনো গানের লাইন রয়েছে, 'কর লো কর লো চারো ধাম, মিলেঙ্গে কৃষ্ণ মিলেঙ্গে রাম।' হিন্দুদের তীর্থযাত্রার ইতিহাস বহু প্রাচীন। যখন তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশেষ কোনও সুযোগসুবিধা ছিল না, তখনও পায়ে হেঁটে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী ভিড় করতেন নানা তীর্থে। এর মধ্যে চারধাম বিখ্যাত। 
হিন্দু পুরাণ বলে, চারধাম যাত্রায় মুছে যায় সব পাপ। আদি শঙ্করাচার্য এই চারধামের কথা বলে গিয়েছেন। কবে আদি শঙ্করাচার্য প্রথম চারধামের কথা উচ্চারণ করেন, তার কোনও লিখিত প্রমাণ নেই। তবে এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আদি শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী দর্শনশাস্ত্রের প্রবক্তা। তিনি ভারতের প্রধান চারটি ধাম ভ্রমণ করেন এবং সেখানে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রায় সকল হিন্দু দেবদেবীর উদ্দেশে স্তোত্র রচনা করেন। 


মূলত চারধাম ছড়িয়ে আছে ভারতের নানা প্রান্তে। উত্তরে বদ্রিনাথ, দক্ষিণে রামেশ্বরম, পূর্বে পুরী এবং পশ্চিমে দ্বারকা। বিংশ শতাব্দী থেকে চারধাম আবার পাল্টে যায়। একে বলা হয় ছোট চারধাম। নতুন চারধাম হয়- গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রিনাথ। 

আরও পড়ুন: চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা


প্রথম ধাম: গঙ্গোত্রী

গঙ্গোত্রী উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার একটি শহর। এটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি হিন্দু তীর্থ শহর। গঙ্গোত্রী হিমাদ্রি হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গঙ্গোত্রী গঙ্গা নদীর উৎসস্থল। তাই এখানে দেবী গঙ্গার একটি মন্দির আছে। গঙ্গোত্রী ছোট চার ধাম তীর্থ-চতুষ্টয়ের একটি। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, রাজা ভগীরথের পূর্বপুরুষের পাপস্খালনের জন্য দেবী গঙ্গা এইখানে নদীরূপে অবতীর্ণ হন। তার অবতরণের আগে ভগীরথ এখানে অনেকদিন তপস্যা করেছিলেন।


দ্বিতীয় ধাম: যমুনোত্রী

যমুনোত্রী হচ্ছে যমুনা নদীর উৎস এবং হিন্দু ধর্মে যমুনা দেবীর আসন। এটি ৩,২৯৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। যমুনোত্রীর প্রধান আকর্ষণ হল যমুনা দেবীকে উৎসর্গ করা মন্দির। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে অসিত মুনির আশ্রম এখানে ছিল। সারা জীবন তিনি প্রতিদিন গঙ্গা ও যমুনায় স্নান করতেন। বার্ধক্যকালে গঙ্গোত্রীতে যেতে না পারায় গঙ্গার একটি ধারা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিল।


অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে মন্দির এবং স্থানটি প্রতি বছর খোলা হয়, যা সাধারণত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বা মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পড়ে। মন্দিরটি অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলির পবিত্র দিনে বন্ধ হয়। মন্দিরের কর্মীরা তাঁদের গ্রামগুলিতে ফিরে আসেন এবং বাকি সময় উপত্যকাটি তুষারের সাদা চাদরে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মে তুষার গলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরটি আবার খোলে।


তৃতীয় ধাম: কেদারনাথ

কেদারনাথ মন্দির হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয় পর্বতশ্রেণিতে অবস্থিত। কেদারনাথ শহরে মন্দাকিনী নদীর তীরে স্থাপিত একটি শিব মন্দির। এখানকার তীব্র শীতের জন্য মন্দিরটি কেবল এপ্রিল মাসের শেষ থেকে কার্তিক পূর্ণিমা অবধি খোলা থাকে। শীতকালে কেদারনাথ মন্দিরের মূর্তিগুলিকে ছ'মাসের জন্য উখিমঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়। তবে বাঙালির কাছে কেদারনাথ মোটেই নতুন কোনও তীর্থক্ষেত্র নয়। বছরের পর বছর বাঙালি তীর্থযাত্রীরা কেদারনাথে যাচ্ছেন। এমনকী, সত্যজিৎ রায়ের রহস্য উপন্যাস ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’-ও শিবঠাকুরের আপন দেশ উঠে এসেছিল। রহস্য সন্ধানে কেদারনাথে যেতে হয়েছিল ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ুকে। সেখানে আবার নিজের ছোটকাকা দুর্গামোহন গঙ্গোপাধ্যায়কে খুঁজে পেয়েছিলেন জটায়ু।


অনেকেই চারধাম যাত্রা না করে শুধু কেদারনাথ-বদ্রীনাথ ঘুরেই চলে আসেন। কেউ কেউ আবার শুধু কেদারনাথ যাত্রা সেরেই ফিরে আসেন। 


চতুর্থ ধাম: বদ্রিনাথ

হিন্দু ধর্মের অন্যতম বিখ্যাত তীর্থস্থান হল বদ্রিনাথ মন্দির। হিমালয়ের গাড়োয়াল অঞ্চলে অবস্থিত এই মন্দির চারধাম যাত্রার অন্যতম ধাম। শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশে নিবেদিত এই মন্দিরটির কথা বহু প্রাচীন শাস্ত্রে ও পুরাণে উল্লেখ রয়েছে। উত্তরাখণ্ডের ছোটা চার ধামেরও অন্তর্ভুক্ত হল বদ্রিনাথ। উত্তরাখণ্ডের বাকি তিন ধাম হল কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী। শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশে নিবেদিত দেশের পাঁচ বদ্রি মন্দিরেরও অন্যতম হল বদ্রিনাথ মন্দির। ভাগবত্‍ পুরাণ, স্কন্দপুরাণ এবং মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে বদ্রিনাথ মন্দিরের। পদ্মপুরাণেও বদ্রিনাথের আশপাশের অঞ্চল পবিত্র ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা আছে। পুরাণে বর্ণিত আছে যে, এখানে একটি বদ্রি গাছের নিচে ধ্যান করেন স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। সেই কারণেই এই অঞ্চলের নাম বদ্রিনাথ। অনেকে বলেন যে, অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত এই এলাকায় বৌদ্ধ মন্দির ছিল। আদি শঙ্করাচার্য এটিকে হিন্দু মন্দিরে পরিণত করেন। মন্দিরের গঠনশৈলি ও উজ্জ্বল রং দেখেও অনেকে এই মতবাদের সপক্ষে ব্যাখ্যা দেন।
চারধাম যাত্রার সঙ্গে শুধু যে ধর্মের অনুষঙ্গ রয়েছে, তা নয়, এই তীর্থযাত্রার অন্যতম অনুভূতির নাম রোমাঞ্চ। তাই কি তীর্থযাত্রীদের কাছে এর আকর্ষণ অনিবার?

More Articles