চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা
সেই কবে থেকে রসকদম্বের রসে মজে গৌড়বঙ্গ। ধূর! রসকদম্বে এখন আর রস কোথায়? আছে রসকদম্বের রসে অবগাহন করা এই গৌড়ীয় ইতিহাস। আছে প্রাচীনতার মিশেল। কদমফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টির গায়ে লেগে রয়েছে সুলতান আমলের ইতিহাসের গন্ধ। এই মিষ্টি আজও বহন করছে চৈতন্যদেবের কেলিকদম্ব গাছের স্মৃতি। আজ টাঁড়ার খাজা, মনোহরার জায়গা দখল করেছে হালফিল ক্যাডবেরি মিষ্টি, বেকড রসোগোল্লা-আরও কত কী! কিন্তু এত কিছুর পরেও মালদার রসকদম্ব সুলতানি আমলের ইতিহাস ধরে রেখেছে, ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিদেশেও।
চলুন এই মিষ্টির ইতিকথা জানতে টাইম মেশিনে করে ফিরে যাওয়া যাক যোজন যোজন পিছনে, সুলতানি আমলে।
মালদার গণ্ডী ছাড়িয়ে এ মিষ্টি বহুদিন আগেই পৌঁছে গেছে দেশের অন্য়ত্র এবং বিদেশেও। কদম ফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টির ভিতরে থাকে ছোট রসগোল্লা। ওপরে ক্ষীরের প্রলেপ। গায়ে পোস্ত, এলাচের গুঁড়ো।
চৈতন্য সংযোগ
রসকদম্ব একটি প্রাক-আধুনিক যুগের মিষ্টি। রসকদম্বের উৎসের কোন তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি, সুলতান হুসেন শাহের আমলে চৈতন্যদেব গৌড়ে আসেন। কেলিকদম্ব গাছের নীচে রূপ-সনাতনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। জনশ্রুতি, সেই কদম্ব গাছ থেকেই রসকদম্বের জন্ম। ঐতিহাসিকরা তা মানতে না চাইলেও বৈষ্ণবদের কাছে এ মিষ্টি অমৃত সমান। ফ্রিজে না রাখলেও সাত দিন টাটকা থাকে রসকদম্ব।
আরও পড়ুন: চৈতন্য মহাপ্রভুর চরণচিহ্ন রয়েছে বাংলার এই তীর্থক্ষেত্রে
মালদায় সবচেয়ে পুরানো মিষ্টি টাঁড়ার খাজা। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের শেষ সুলতান ছিলেন সুলেমান করবানি। করবানির বংশধরেরা রাজধানীকে টাঁড়ায় সরিয়ে নেন। সেই সময় জয়নগর থেকে এক মৌলবী টাঁড়ায় এসে খাজা তৈরি শুরু করেন। সুলতানি আমলের সেই খাজা এখন আর তৈরি হয় না। আঙুরের মতো দেখতে মনাক্কা মিষ্টিও নেই। নেই ছোট কুলের মতো দেখতে মনোহরাও। কিন্তু এখনও আছে শুধু রসকদম্ব। রসগোল্লা, চমচম, গোলাপজামুন, দিলখুশের ভিড়ে আজও সেরা মিষ্টি এই রসকদম্ব। কিন্তু আজ রস নেই। এককালে ক্ষীরের প্রলেপের ভতরে ছিল ছোট্ট রসগোল্লা। স্বাদে অতুলনীয় এই মিষ্টি।
যে ভাবে তৈরি হয় রসকদম্ব
রসকদম্বের মূল উপাদান ছানা, ক্ষীর, চিনি ও পোস্ত। প্রথমে ছানা দিয়ে মাঝারি থেকে ছোট আকারের রসগোল্লা তৈরি করা হয়। তারপর দানাদার তৈরি করার মতো করে রসগোল্লা থেকে বাড়তি রস ঝেড়ে ফেলা হয়। এই রসগোল্লায় লাল রঙ দেওয়া হয় ও ভ্যানিলা এসেন্স যোগ করা হয়। তারপর রসগোল্লাকে গুঁড়ো খোয়া ক্ষীরের আস্তরণে ঢেকে ফেলা হয়। সব শেষে মাঝারি রকমের ভাজা পোস্তর একটি প্রলেপ দিয়ে মিষ্টিটাকে কদম ফুলের মতো দেখতে করা হয়। ফ্রিজে না রাখলেও এই মিষ্টি বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত টাটকা থাকে। পোস্তর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক পোস্তর পরিবর্তে চিনির দানা ব্যবহার করেন। কেউ কেউ পোস্তর পরিবর্তে ক্ষীরের গুঁড়ো ব্যবহার করেন।
রসগোল্লার সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই
বাংলার মিষ্টি মেলায় কলকাতার রসগোল্লা কিংবা মুর্শিদাবাদের ছানাবড়াকে বরাবর টেক্কা দিয়েছে মালদার এই মিষ্টি। সুলতানি আমলের রসকদম্বের কদর এখন রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। পশ্চিমবঙ্গ রসগোল্লার পেটেন্ট পাওয়ার পর মালদা যাতে রসকদম্বের পেটেন্ট পায় সেই দাবিও ওঠে বহুদিন আগে। তারপর মহানন্দা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে।
দেখতে ঠিক কদম ফুলের মতো, তাই নাম রসকদম্ব। মালদার কোনও অনুষ্ঠানে রসকদম্ব থাকবে না এমনটা কেউ ভাবতেই পারে না। তবে এখন সময়ের হাত ধরে মিষ্টিতেও বিবর্তন এসেছে।
বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলে এই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যাওয়া এখানকার প্রথা। পুজো এবং অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে রসকদম্বের চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে কারিগরদের ঘুম ছুটে যায়। বৈষ্ণব সম্প্রদায় ছাড়াও মালদাবাসীর কাছেই জনপ্রিয়। রসকদম্বের রস থুড়ি স্বাদ যে মালদাবাসীকে আমোদিত করেনি, একথা মৃদুস্বরেও বলা যায় না।
মালদার মন
মালদার রাজমহল রোড, নেতাজী সুভাষ রোড ও মনস্কামনা রোডের মিষ্টির দোকানের রসকদম্ব সর্বাধিক জনপ্রিয় মালদায় যে কোনো ধরনের শুভ অনুষ্ঠানে রসকদম্ব ব্যবহার করা হয়। মালদাবাসী আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি গেলে এই মিষ্টিই নিয়ে যান। পুজো ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে রসকদম্বের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়। বর্তমানে রসকদম্বের জনপ্রিয়তা মালদা জেলা ছেড়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে, ভারতে এবং বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
মালদার এই রসকদম্ব নিয়ে উৎসবের দাবি তুলেছেন বিশিষ্টজনেরা।
মালদা জেলার বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক তথা গৌড় কলেজের অধ্যাপিকা সুস্মিতা সোম তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, গৌড় সংলগ্ন রামকেলিতে চৈতন্যদেব একটি কদম ফুলের গাছের নীচে তিনদিন অতিবাহিত করেছিলেন। কদম্ব ফুলে ভরেছিল গাছটি। সেই কদম্ব ফুলের অনুকরণে তৈরি মিষ্টি দিয়ে চৈতন্যদেবকে আপ্যায়ন করা হয়। তা থেকেই সেই মিষ্টির নাম হয় রসকদম্ব। গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, রসকদম্ব আসলে ছোট রসগোল্লার ওপর খাঁটি ক্ষীরের প্রলেপ দেওয়া এক ধরনের মিষ্টি। ক্ষীরের ওপর থাকে মিষ্টি পোস্তর আরেকটি প্রলেপ। দেখতে একেবারেই কদম্ব ফুলের মতো। এই মিষ্টি কেবল মালদায় পাওয়া যায়।
রসকদম্বে থাকে পোস্ত। মালদায় পোস্ত চাষ হয়, তাই রসকদম্বের দাম সস্তা। পিস ৬ টাকা আর ১০ টাকা। শহর জুড়ে দোকান। তবে সেরাটা পেতে গেলে যেতে হবে নেতাজি সুভাষ রোডে। মালদা শহরের চারশো বিশ মোড়ের কাছে। মেহেরপুরের কারিগররা এর নতুন রূপ দেন। রসগোল্লার পুর দেওয়া শুরু হয় তখন। সেই প্রাচীন ঘরানা আজও বদল হয়নি। এতকাল পরেও সেই ঐতিহ্য রয়েছে। তবে ইদানিং পোস্তর দাম বেড়েছে, তাই অনেকে পোস্তর বদলে দিচ্ছেন চিনি। পুরানো কারিগররা অবশ্য চিনি দেন না। মালদাবাসী মনে করেন, বাড়িতে রসকদম্ব না থাকলে বোধহয় কৌলিন্য হারাতে হবে।
এই মিষ্টি অন্য কোনও মিষ্টির মতো স্বাদে-আস্বাদে, তৃপ্ত করার রসদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গৌড়ীয় ইতিহাস। কালের গহ্বরে যাতে না হারায় ইতিহাস, তাই ইতিহাসের বাহক এই মিষ্টিরও আজ বেঁচে থাকা দরকার। অর্থনৈতিক কারণে নয়, ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে বেঁচে থাক রসকদম্ব।