সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু, কোন নরকে বাস করছে ভারতের নাবালিকারা?

 

আজকের পৃথিবী আধুনিক হলেও এমন কিছু সমস্যা পৃথিবীজুড়েই রয়েছে, যা নির্মূল করা যাচ্ছে না। নাবালিকা বিবাহ এমনই এক সমস্যা। রাষ্ট্রসংঘের চিলড্রেন'স ফান্ডের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে যত সংখ্যক নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে, তার মধ্যে ভারত সামনের সারিতে।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথের সমীক্ষা অনুসারে, ভারতের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকাগুলিতে নাবালিকা বিবাহের হার অনেকটাই বেশি। যেমন, শহরাঞ্চলে ১৭.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নাবালিকা বিবাহের ঘটনা ঘটছে। আর গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ১৮ বছরের আগেই নাবালিকা বিবাহের ঘটনা ঘটছে ৩১.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

এও দেখা যাচ্ছে, যে সমস্ত দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়া চালানোর মতো সুযোগ থেকে দারিদ্রের কারণে বঞ্চিত, তাদেরই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রতি বছর ভারতে ১৫ লক্ষ নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন: কন্যাসন্তানকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করায় এই সম্প্রদায়!

করোনা পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ভারতই নয়, আবিশ্ব নাবালিকা বিবাহের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র দেওয়া তথ্য অনুসারে, করোনা পরিস্থিতিতে ভারতে নাবালিকা বিবাহের হার অন্তত ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

নাবালিকা বিবাহ পুরোপুরিভাবে বেআইনি। কিন্তু অভিভাবকরা 'ঘাড় থেকে বোঝা নামানো'-র জন্য নাবালিকাদের লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেও সব ক্ষেত্রে প্রশাসনের কাছে খবর পৌঁছচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতিতে এই ধরনের মাত্র ৭৮৫টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে 'প্রোহিবিশন অব চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট'-এ।

এতেও কিছুটা আশার আলো দেখছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কারণ এই ধরনের বেআইনি বিয়ের ঘটনাগুলি কিছুটা হলেও নথিভুক্ত হচ্ছে।

কিন্তু করোনাকালে কেন বেড়েছে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যা? স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'সেভ দি চিলড্রেন' জানিয়েছে, করোনার আবির্ভাবের পর বহু মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্রের আরও গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছেন। এই পরিবারগুলো নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে রেহাই পেতে চাইছে।

ভারতে সুলতান আমল থেকেই নাবালিকা বিবাহের চল ছিল। সেই সময় এদেশের অনেক বাসিন্দাই নাবালিকা কন্যাসন্তানকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিত ধর্ষণ এবং অপহরণের ঘটনা এড়ানোর জন্য।

সেই আমল কবেই অস্তমিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও নাবালিকা কন্যাসন্তানকে বিয়ে দেওয়ার চল নির্মূল হয়নি। বরং ভারতে এটি এখনও জ্বলন্ত সমস্যা।

কোন কোন কারণে নাবালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হচ্ছে, সেও একনজরে দেখে নেওয়া যাক। এই কারণগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে পরিবারে আগ্রাসী দারিদ্র অথবা শিক্ষার অভাব- তেমনই আছে পিতৃতন্ত্রের অভিশাপ, লিঙ্গবৈষম্য এবং নাবালিকা বিবাহ রোধ করতে আইনের প্রয়োগে গড়িমসি।

ভারতে নাবালিকা বিবাহ রোধে প্রথম আইন প্রণয়ন করা হয় ব্রিটিশ আমলে। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রথম চাইল্ড 'ম্যারেজ রেসট্রেইনড অ্যাক্ট' প্রণয়ন করে। জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

সেই সময় এই আইনবলে ১৮ বছরের কম বয়সের কোনও নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত হলে ১৫ দিনের কারাবাস এবং আর্থিক জরিমানা করা হত। ১৯৪০ সালে সংশোধনী এনে আইন আরও কঠোর করা হয়।

২০০৬ সালে 'প্রোহিবিশন অব চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট' আরও কঠোর করা হয় ২১ বছরের কম বয়সের পাত্র এবং ১৮ বছরের কম বয়সি পাত্রীর বিয়ে বন্ধ করতে। তবে কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত বছরের ডিসেম্বরে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করার জন্য ফের 'চাইল্ড ম্যারেজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল' পেশ করা হয়েছে।

বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেশগুলোতে ব্যাপক হারে নাবালিকা বিবাহের ঘটনা ঘটছে। বিশেষত, আফ্রিকার একাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। দুনিয়ার যে দেশগুলোতে ব্যাপক হারে ১৮ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই দেশগুলির মধ্যে ভারত ছাড়াও তালিকার শীর্ষে আছে পশ্চিম আফ্রিকার দু'টি দেশ- নাইজার এবং গিনি। এছাড়া ব্যাপক হারে নাবালিকা বিবাহের ঘটনা ঘটছে মালি, বাংলাদেশেও।

নাবালিকা থাকাকালীন মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের জীবন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ২১ বছরের আগে যে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারাও।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়ার পর বহু ক্ষেত্রে তারা পরিবারের অন্দরে হিংসার শিকার। এদের ভেতর অনেকেই আবার এইচআইভি-তে আক্রান্ত।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের 'ডিস্ট্রিক্ট লেভেল হাউসহোল্ড অ্যান্ড ফেসিলিটি সার্ভে' অনুযায়ী, দেশের যে রাজ্যগুলোতে ব্যাপক হারে নাবালিকা বিবাহের ঘটনা ঘটছে সেই রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ।

সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিহারের। বিহারের বাসিন্দা অন্তত পক্ষে ৭০ শতাংশ মহিলা সমীক্ষকদের জানিয়েছেন, নাবালিকা থাকাকালীনই তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এদের বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা।

'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন ওমেন' নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা আবিশ্ব নাবালিকা বিবাহের হালহকিকত খতিয়ে দেখেছে। এই সংস্থা জানিয়েছে, ফি-বছর পৃথিবীজুড়েই প্রচুর সংখ্যক নাবালিকা এবং নাবালকের বেআইনিভাবে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক কোনও পুরুষের সঙ্গে।

ভারতে আজও নাবালিকা বিবাহ রমরমিয়ে চলছে। ইউনিসেফের মতে, ভারত সরকারের উচিত নাবালিকা বিবাহ রুখতে যথাযথ কৌশল রচনা করা। এই পরিকল্পনা যাতে কেবলমাত্র কাগজ-কলমে বন্দি না হয়ে থাকে, এজন্য তাতে শামিল করা দরকার স্বেচ্ছাসেবীদেরও। কারণ নাবালক এবং নাবালিকাদের বিয়ে কতটা ক্ষতিকারক, সেই সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই সচেতনতা নেই। এছাড়া নাবালক কিংবা নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়াটা মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। একই সঙ্গে সমাজের পক্ষেও অত্যন্ত ক্ষতিকর, সেকথাও বলা বাহুল্য।

নাবালিকা থাকাকালীন বিবাহের ফলে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে গোটা পৃথিবীতে ২২,০০০ নাবালিকার মৃত্যু হয়। ভারতে কত জন নাবালিকা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে, এ-সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। নাবালিকা প্রসূতির মৃত্যুর নিরিখে এগিয়ে পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার দেশগুলি। ফি-বছর অন্তত  ৯,৬০০ জন নাবালিকা প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে। আর ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নাবালিকা প্রসূতির বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা ২,০০০।

আবিশ্ব এখনও নাবালিকাদের বিবাহের প্রচলন রয়েছে। এমনকী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়।

একাধিক সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই অভিশাপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও এর প্রধান কারণ যেমন দারিদ্র, পাশাপাশি অশিক্ষাও এই ব্যাধির কারণ।

More Articles