কন্যাসন্তানকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করায় এই সম্প্রদায়!

বহু ক্ষেত্রে আজও ভারতীয় পরিবারে জন্মগ্রহণের পর থেকে কন্যাসন্তান পরিবারে উপেক্ষিত। ভ্রুণহত্যা এদেশের নিয়মিত বাস্তবতা। কিন্তু এদেশে এমন জনগোষ্ঠীও আছে, যাঁরা পরিবারে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে খুশি হয়। পরিবারে নতুন অতিথি হিসেবে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে মধ্যপ্রদেশের বানচাদা সম্প্রদায়ের মানুষ যথাসম্ভব ঘটা করে গ্রামবাসীদের খাওয়ান, উদযাপন করেন। কিন্তু কেন কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণের পরে ওঁরা ঘটা করে উদযাপন করেন, সেই তথ্য শিউরে ওঠার মতো!

বানচাদা সম্প্রদায়ে কন্যাসন্তানকে যৌনকর্মীর পেশায় নিযুক্ত করা হয়। যৌনকর্মী হিসেবে বাড়ির মেয়েরা যেটুকু রোজগার করে, সেই টাকায় চলে সংসার। বানচাদাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী। এই সম্প্রদায়ের পুরুষরা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। সংসারে মূল আয়ের উৎস মেয়েরাই। মেয়েদের পতিতাবৃত্তি করানোটা বানচাদাদের মধ্যে শত শত বছর ধরে প্রচলিত। 

ব্রিটিশ আমলে বানচাদারা অপরাধী গোত্রভুক্ত উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। দেশ স্বাধীনের পর বানচাদা সম্প্রদায় তফসিলি জাতির অন্তর্গত হয়েছে। কিন্তু এখনও এই সম্প্রদায়ে কন্যাসন্তানকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর রীতি বহাল রয়েছে। আর সমাজ এবং পরিবারের চাপে মেয়েরা অভিশপ্ত জীবনের ফাঁদ কেটে বেরতে পারেনি।

আরও পড়ুন: নিজেদের সন্তানকেই হত্যা করে জারোয়ারা, কিন্তু কেন?

মধ্যপ্রদেশের রতলম, নিমুখ এবং মান্ডসৌরে বসবাস এই সম্প্রদায়ের মানুষের। ভারতের সর্বত্রই এখনও পরিবারে পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পায়। ভারতীয় দম্পতিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুত্রসন্তান আকাঙ্ক্ষা করেন। কন্যাসন্তানের আকাঙ্ক্ষা ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে। বানচাদারা কিন্তু এর বিপরীত। ওঁরা চান পরিবারে যেন বেশি সংখ্যক কন্যাসন্তান জন্মায়। সেক্ষেত্রে তাদের যৌনকর্মী হিসেবে বাজারে কাজ করিয়ে রোজগার করা যাবে।

মধ্যপ্রদেশের রতলাম, নিমুখ এবং মান্ডসৌরে প্রচুর পরিমাণে আফিমও চাষ হয়। বানচাদা সম্প্রদায় বেআইনিভাবে আফিম চাষের সঙ্গেও যুক্ত। বিস্তীর্ণ এলাকায় ৭৫টি গ্রামে মধ্যপ্রদেশে বানচাদা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। রাজ্য সরকারের নারী ক্ষমতায়ন দফতর মান্ডসৌর এবং নিমুখে বানচাদা সম্প্রদায়ের কতজন মানুষ বসবাস করেন, এই সম্পর্কে সমীক্ষা চালিযেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, মান্ডসৌরে বানচাদা সম্প্রদায়ের সাড়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। এদের ভেতর অধিকাংশ মহিলা। এছাড়া নিমুখের গ্রামগুলিতে বসবাসকারী বানচাদা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মানুষজনেরও বেশিরভাগই মহিলা। রতলমেও একই ছবি।

বানচাদারা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মেয়েদেরই যৌনকর্মী হিসেবেই কেবল কাজ করায় না। স্বেচ্ছাসেবীদের অভিযোগ, এই সম্প্রদায়ের মানুষজন নারী পাচারের ঘটনার সঙ্গেও যুক্ত। মধ্যপ্রদেশ এবং দেশের নানা প্রান্ত থেকে নাবালিকাদের কিনে কয়েক বছর প্রতিপালন করার পর, বয়স ১২ বছর পেরোলেই মেয়েটিকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজে লাগানো হয়। স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, বানচাদা সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ এইডসে আক্রান্ত।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছেন, বানচাদা সম্প্রদায়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশই মহিলা। এর অন্যতম কারণ হল ব্যাপক হারে শিশুকন্যা কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ওরা। একদিকে সম্প্রদায়ের ভেতর কন্যাসন্তান হলে তার ভবিষ্যৎ যৌনকর্মী হিসেবে নিশ্চিত থেকেছে বছরের পর বছর ধরে, আবার কন্যাসন্তান কিনে তাকে প্রতিপালন করাটা বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন বানচাদা সম্প্রদায়ের পুরুষরা। ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করলেই কন্যাসন্তান কেনা যায় দালালদের কাছ থেকে।

ভারতীয় সমাজে নানা ধরনের ভেদাভেদ আজও বহাল তবিয়তে আছে। কিন্তু পরিবারের সদস্য মেয়েদের যৌনকর্মী হিসেবে প্রাচীন প্রথার দোহাই দিয়ে কাজ করানোর রীতি বজায় থাকাটা কলঙ্কজনকই।

১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতে বহুবিধ রাজনৈতিক এবং সামাজিক পালাবদল হয়েছে। যদিও বানচাদা সম্প্রদায়ের মানুষেকে কেন উন্নয়নে সামিল করা যায়নি, সেই প্রশ্নও সংগত। তবে এর যথাযথ উত্তর নেই।

গত কয়েক বছর ধরে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ  করছে অমানবিক প্রথার হাত থেকে বানচাদা সম্প্রদায়কে সভ্যতার আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে। সেই কাজ এখনও বহুদূর পর্যন্ত বাকি।

প্রশাসনের মতে, বানচাদারা দালালের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কন্যাসন্তানকে কিনে পরে তাকে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করছে, এই সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ হাতে নেই। এর ফলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে বানচাদা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা যাতে স্কুলে যায়, এব্যাপারে উদ্যোগী সরকার।

'নয়ি আভা সামাজিক চেতনা সমিতি' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মধ্যপ্রদেশে বানচাদা সম্প্রদায়ের মানুষের ভেতর সচেতনতা প্রসারের কাজ শুরু করেছে। যেহেতু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই সম্প্রদায়ের মেয়েদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে, সেজন্যে চেতনা সৃষ্টির কাজটা কঠিন বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। চেতনার প্রসারের কাজে অন্যতম বাধা অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে না চাওয়া বানচাদা সম্প্রদায়ের পুরুষ সমাজ।

রাজধানী ভোপাল থেকে ৩৭০ কিমি ভেতরে মান্ডসৌরে বানচাদা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসের এলাকায় উন্নয়নের কোনও ছাপ নেই। রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নেই। গ্রামগুলোতে অনুন্নয়নের ছাপ চোখে লাগার মতো।

স্বেচ্ছাসেবীরা এই এলাকায় বানচাদা সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা প্রচারে সামান্য হলেও সাফল্য পেয়েছেন। মেয়েরা এখন স্কুলে যেতে চাইছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় লেখাপড়া করার পাশাপাশি কম্পিউটার শিখছে। মেয়েদের ভেতর জীবন সম্পর্কে সুন্দর লক্ষ্য গড়ে উঠছে। বানচাদা সম্প্রদায়ের মেয়েরা কেউ কেউ ভবিষ্যতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নের কথা স্বেচ্ছাসেবীদের পাশে পেয়ে জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা করছে।

যেমন, ১৮ বছরের নেহা বানচাদা বলল, "আমি ডাক্তার হতে চাই। ডাক্তার হয়ে গ্রামের সেবা করতে চাই। কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে কাজ নেই। সংসার চালানোর খরচ জোটানোর মতো কাজ চাই। না হলে পরিস্থিতি পাল্টাবে না।"

'কমন সার্ভিস সেন্টার' নামে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা মধ্যপ্রদেশে বানচাদা সম্প্রদায়ের ভেতর কিছুদিন ধরে সচেতনতা তৈরির কাজ করছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, জীবন সম্পর্কে বানচাদা সম্প্রদায়ের পুরুষদের ধ্যানধারণা যাতে পাল্টায়। এছাড়া মেয়েদের সেলাই-সহ হাতে-কলমে নানা কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

যদিও স্বেচ্ছাসেবীদের বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। কারণ গ্রাম প্রধানদের একাংশ প্রাচীন প্রথা বহাল রাখতে উন্নয়নের বিরোধিতা করছেন। যদিও বানচাদা সম্প্রদায়ের যে মেয়েরা আজও গ্রামে, হাইওয়ের পাশে দেহব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছেন- প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহমান যন্ত্রণার এই জীবন থেকে ওঁরাও মুক্তি চাইছেন এবার।

বলা বাহুল্য, শিক্ষা ছাড়া যেমন এই প্রথা থেকে মুক্তি নেই, মুক্তি মিলবে না কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা না হলেও।

More Articles