ছিলেন বহিরাগত, টাটা গ্রুপে পা রেখে কর্পোরেটের মানেই বদলে দিয়েছিলেন সাইরাস

শেষ হলো কর্পোরেট দুনিয়ার এক চলমান অধ্যায়ের, যার রচয়িতা সাইরাস পালোনজি মিস্ত্রি।

শেষ হলো কর্পোরেট দুনিয়ার এক চলমান অধ্যায়ের, যার রচয়িতা সাইরাস পালোনজি মিস্ত্রি। আইরিশ নাগরিক, কিন্তু মুম্বইতে জন্ম (ভারতে স্থায়ী বসবাসের বিশেষ অনুমতি ছিল)। চার বছরের জন্য শাসন করেছেন টাটা সাম্রাজ্য। রতন টাটা-র এককালের উত্তরাধিকারী। ২০১২ সালে সাইরাস হাল ধরেন টাটা সনস-এর। ঝড়ের গতিতে উত্থানের মতোই সাইরাসের বিদায় নেওয়াও আকস্মিক হয়ে রইল। রবিবার দুপুর সোয়া ৩টে নাগাদ মহারাষ্ট্রের পালঘরের কাছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলো সাইরাসের। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে লেখা হয়ে গেল এক উদ্যোগপতির জীবনের শেষ অধ্যায়। পারিবারিক গোষ্ঠীর একটি ব্যবসায়িক সংস্থার ডিরেক্টরের পদ থেকে দেশের অন্যতম নামী সংস্থার চেয়ারম্যান- সাইরাসের উত্থান ছিল আক্ষরিক অর্থেই চোখে পড়ার মতো। পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তাকে পুঁজি করে দেশের শিল্প-মানচিত্রে লিখে দিয়েছেন এক সাফল্যের খতিয়ান।

রবিবারের দুপুরের আলস্য তখনও কাটেনি। সোয়া ৩টে নাগাদ টিভির পর্দায় চোখ নিবিষ্ট হতেই ব্রেকিংয়ের ধাক্কা। দুর্ঘটনার খবর থমকে দিল সবকিছু। গুজরাত-মহারাষ্ট্র সীমান্তর কাছে, পালঘরে জাতীয় সড়কে চাটোরি সেতুর কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে সাইরাসের গাড়ি। দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন তিনি। তাতেই মৃত্যু হয়েছে সাইরাসের। দুর্ঘটনাস্থল থেকে যে ছবি এবং ভিডিও সামনে এসেছে, তাতে গাড়িটির সামনের অংশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাড়ির ভেতরের অবস্থাও প্রায় লন্ডভন্ড। গাড়িটি ডিভাইডারে ধাক্কা মারে বলে জানা গিয়েছে।

কে এই সাইরাস মিস্ত্রি?
সাইরাস মিস্ত্রি হলেন সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের মালিক এবং টাটা সনস-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তিনি পালোনজি মিস্ত্রির ছেলে। ২০১২ সালে তিনি টাটা সনস-এর ষষ্ঠ চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। টাটা পরিবারের বাইরে তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এই গ্রুপের প্রধান হন। মাত্র চার বছরের জন্য এই পদে ছিলেন সাইরাস।

আরও পড়ুন: এককালে ভারতের সর্বোচ্চ ধনী, একা হাতে মুম্বইয়ের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি

পদবি-তে টাটা নেই। তবে সাইরাস হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এককালে টাটা পদবিহীন হলেও টাটাদের ব্যবসা সামলেছেন। রতন টাটার অবসরের পর টাটা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এক্ষেত্রে অবশ্য টাটা পদবি না হয়েও টাটা-র ব্যবসা সামলানোর ইতিহাসে সাইরাসের আগে রয়েছেন নওরোজি সাকলতওয়ালা। ১৯৩২ সাল থেকে ’৩৮ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু যিনি এই গোষ্ঠীর তৃতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব সামলে গেছেন।

টাটা গোষ্ঠী-র হোল্ডিং সংস্থা টাটা সনস-এর ১৮.৩৭ শতাংশ অংশীদারি সাপুরজি-পালোনজি গোষ্ঠীর হাতে ছিল। যার প্রোমোটার সাইরাস মিস্ত্রির পরিবার। টাটাদের সঙ্গে সাপুরজিদের সম্পর্ক ছিল প্রায় ৭০ বছর। পরে আইনি লড়াই। জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে।

রতন টাটার অবসরের পর সেই ব্যাটন চলে আসে সাইরাসের হাতে। তিনিই হন টাটার ষষ্ঠ ও সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান। রতন টাটার পর টাটা সাম্রাজ্যে তাঁর অভিষেক হয় অনেকটা বিনা বাধায়। কিন্তু বেশিদিন সেই রাজত্ব স্থায়ী হয়নি।

মাত্র চার বছরের জন্য এই পদে ছিলেন সাইরাস। টাটা গ্রুপের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রধান। মিস্ত্রিকে ২৪ অক্টোবর, ২০১৬ সালে টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সালে তাঁকে হোল্ডিং কোম্পানির বোর্ডের পরিচালক পদ থেকেও অপসারণ করা হয়। এই অপসারণের আগে অবধি সাইরাস মিস্ত্রি এবং রতন টাটা-র মধ্যে সম্পর্ককে বন্ধুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখা হত। কিন্তু, তাঁর জমানায় টাটা কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডারদের রিটার্ন কমেছিল। রতন টাটা-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে বেশ কয়েকটি কারণে। যেমন, ব্রিটেনে টাটা স্টিল পোর্ট প্ল্যান্টের প্রস্তাবিত বিক্রয় বিদেশে টাটার ব্যবসা বৃদ্ধির সদিচ্ছার অভাব হিসেবে বিভিন্ন মহলের কাছে বার্তা যায়। ডোকোমো গ্রুপের সঙ্গে বর্ধিত বিরোধও মিস্ত্রির অপসারণের কফিনে অন্যতম পেরেক হিসেবে মনে করা হয়। জাপানি গোষ্ঠীর সঙ্গে এই বিরোধের জন্য টাটাদের ১০০ কোটির বেশি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়।

লন্ডনের স্বনামধন্য ইম্পেরিয়াল কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সাইরাস মিস্ত্রি টাটা কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে পারিবারিক নির্মাণ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। টাটাদের সঙ্গে মিস্ত্রি পরিবারের সম্পর্ক ১৯৩০ সালে শুরু হয়েছিল। যখন সাপুরজি-পালোনজি মিস্ত্রি একই দিনে এস্টেট থেকে টাটা সনস-এর ১২.৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছিলেন। মিস্ত্রিরা পরবর্তীতে টাটা পরিবারের কাছ থেকে আরও বেশি অংশীদারি অধিগ্রহণ করে, এসপি গ্রুপের হোল্ডিং প্রায় ১৬.৫ শতাংশে নিয়ে যায়। টাটা কোম্পানি-তে তার অংশীদারিত্ব বজায় রাখার জন্য মিস্ত্রি নয়ের দশকে টাটা সনস রাইট ইস্যুতে ৬০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছিলেন।

এতদিনের সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। টাটা গোষ্ঠীর অন্যতম কর্তা রতন টাটার সঙ্গে মতবিরোধের পর, মিস্ত্রিকে টাটা সনস বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয়। মিস্ত্রি পরে বিষয়টি ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনালে (এনসিএলটি) নিয়ে গিয়েছিলেন।

টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হওয়ার চার বছরের মাথায় আচমকাই ছন্দপতন। ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর সাইরাসকে তাঁর পদ থেকে অপসারিত করে টাটা সনস-এর বোর্ড। সে পদে বসানো হয় রতন টাটা-র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে। যার জল গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। এর জেরে টাটা ও মিস্ত্রিদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়। কর্পোরেট ইতিহাসের অন্যতম তিক্ত দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে সুপ্রিম কোর্টে জয়ী হয়েছিল টাটারা। ২০১৬ সালে সাইরাসকে আচমকা টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্তকে 'দমনমূলক' তকমা দিয়েছিল এনসিএলএটি। সাইরাসকে টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহালের জন্য এনসিএলএটি-র নির্দেশও খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন সাইরাস?
যতদূর জানা যায়, কর্পোরেট দুনিয়ায় রাজত্ব করা এই উদ্যোগপতি ছিলেন স্বল্পভাষী, আদ্যন্ত নিভৃতচারী মানুষ। বিলাসিতা আর শখ বলতে গাড়ি। বিশেষ করে ভালোবাসতেন এসইউভি। ১৯৬৮ সালের ৪ জুলাই মুম্বইতে তাঁর জন্ম। তাঁর মা আইরিশ। সেই সূত্রেও তাঁরও আইরিশ নাগরিকত্ব ছিল। লন্ডনের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন সাইরাস মিস্ত্রি। প্রথমে তিনি পারিবারিক নির্মাণ ব্যবসাতেই জড়িত ছিলেন। ২০০৬ সালে টাটা গোষ্ঠীর বোর্ড থেকে অবসর নিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। তখন সাইরাস তাঁর বাবার পদে আসীন হয়েছিলেন। তারপর থেকে টাটা ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা স্টিল, টাটা কেমিক্যালস এবং টাটা মোটরসের বিভিন্ন পদে থেকে ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখেছিলেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অল্প সময়েই তিনি ফোর্বস গোকাক, ইউনাইটেড মোটরস (ইন্ডিয়া) এবং সাপুরজি-পালোনজি অ্যান্ড কোং-এর মতো আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার ডিরেক্টর হন।

১৯৯০ সালে ডিরেক্টর হয়ে তিনি পারিবারিক ব্যবসা সাপুরজি-পালোনজি কনস্ট্রাকশনের দায়িত্ব নেন। তারপর ১৯৯৪ সালে এমডি। অল্প সময়ের মধ্যে সংস্থাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। সারা ভারতে এই সংস্থার এখন ২৩,০০০ কর্মী। গাড়ি-বিলাসের পাশাপাশি ঘোড়সওয়ার হিসেবেও তিনি একইভাবে দক্ষ ছিলেন। এই চলমানতাই কি কাল হলো এক সফল উদ্যোগপতির জীবনে?

২০১৩ সালে 'দ্য ইকনমিস্ট’ ব্রিটেন এবং ভারত, দুই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপতির আখ্যা দিয়েছিল সাইরাসকে। অকালে থেমে গেল সেই শিল্পপতির জীবন, কিন্তু ভারতের শিল্প-মানচিত্রে রয়ে গেল তাঁর সাফল্যের আখ্যান।

More Articles