এককালে ভারতের সর্বোচ্চ ধনী, একা হাতে মুম্বইয়ের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি
দক্ষিণ মুম্বইয়ের ফার্মহাউস এবং আয়ারল্যান্ডের বাড়ি ছিল তাঁর শেষ জীবনের সবটুকু। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত গোটা পরিবার। তবে, সাপুরজি গ্রুপের বর্তমান অবস্থা হয়তো পালোনজি মিস্ত্রির খুব একটা ভালো লাগত না।
ভারতীয় শিল্পজগতের অন্যতম নক্ষত্রপতনের সাক্ষী থাকল গোটা দেশ। গত সপ্তাহে ৯৩ বছর বয়সে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতের অন্যতম বিজনেস টাইকুন শিল্পপতি পালোনজি মিস্ত্রি। ভারতের নির্মাণক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসার কান্ডারি ছিলেন তিনিই। নিজের সংস্থার মাধ্যমেই তৈরি করেছিলেন মুম্বইয়ের আইকনিক আরবিআই-এর পুরনো বিল্ডিং থেকে ফ্লোরা ফাউন্টেনের বিপরীতে এইচএসবিসি-র ছয় তলা বিল্ডিং পর্যন্ত। ভারতের বাণিজ্যনগরীর দিক এবং দিশা পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বাবার তৈরি করা কোম্পানি হাতে পেলেও ভারতবিখ্যাত সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের উত্থান কিন্তু তাঁরই হাত ধরে।
বছরের পর বছর ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ডব্লিউএইচ ব্র্যাডি গ্রুপ অফ কোম্পানিজ, দ্য অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বশীল তিনি। ছিলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদেও। রিয়েল এস্টেট এবং কনস্ট্রাকশন কংগ্লোমারেট সংস্থা কীভাবে ভারতে ব্যবসা করবে, তাঁর অনেকটাই পথপ্রদর্শন করে দিয়েছিলেন তিনিই। শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও ছড়িয়েছিল তাঁর ব্যবসার প্রসার। ওমানের সুলতানের নীল এবং সোনালী রঙের আল আলম প্যালেসও তৈরি করেছিলেন তিনিই। ১৫৭ বছরের সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের কর্ণধার হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন টাটা সনস কোম্পানির সবথেকে বড় শেয়ারহোল্ডারও। এই ব্যবসা সম্পর্কের দিকেও এগিয়েছিল, একটা সময় যখন রতন টাটার ভাই নোয়েল টাটাকে বিয়ে করেন পালোনজির বোন আলু মিস্ত্রি।
তবে জীবনে একাধিক বিতর্কও তাড়া করে বেড়িয়েছিল তাঁকে। টাটা সনসের প্রধানের পদে ছেলে সাইরাস মিস্ত্রির অভিষেক বিতর্ক থেকে শুরু করে, ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আয়ারল্যান্ডের নাগরিক হওয়া, জীবনে একাধিক বিতর্কে জড়িয়েছেন এসপি গ্রুপের প্রাক্তন কর্ণধার। একটা সময় তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম ধনী ব্যক্তি এবং যে-সময় তিনি আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, সেই সময় তিনি ছিলেন সেই দেশের সবথেকে ধনী মানুষ। তবে শুধুমাত্র ঘোড়ার প্রতি ভালবাসা থাকার কারণে, নিজের দেশে নাগরিকত্ব ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ, এই বিষয়টি নিয়েও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর ঔদার্যর নিদর্শনও রয়েছে প্রচুর। বয়স্ক মানুষদের সাহায্য করা হোক, কিংবা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা, যেখানে যতটুকু পেরেছেন, তাই দিয়েই চিরকাল ভারতের মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে গিয়েছেন পালোনজি মিস্ত্রি। ব্লুমবার্গের বিলিয়নের ইনডেক্সে তাঁর নেটওয়ার্থ ছিল ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম একজন ধনী মানুষ। তবে তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। কখনওই নিজের সম্পত্তির জন্য অহংকার করতেন না তিনি, বরং সকলকে সঙ্গে নিয়েই বেঁচে থাকা ছিল তাঁর জীবনের পলিসি।
আরও পড়ুন: কেন জিও থেকে সরে দাঁড়ালেন মুকেশ আম্বানি?
এসপি গ্রুপের অগ্রগতি ও পালোনজি মিস্ত্রি
পালোনজি মিস্ত্রির পারিবারিক ব্যবসাটি আদতে শুরু করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। ১৮৬৫ সালে এক ইংরেজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে একটি কনস্ট্রাকশন ব্যবসা শুরু শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রির ঠাকুরদা। তাঁদের কোম্পানির প্রথম প্রোজেক্ট ছিল মুম্বইয়ের প্রথম স্থাপিত জলের ট্যাঙ্ক। তারপর এই কোম্পানির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন পালোনজি মিস্ত্রির পিতা এবং জন্ম হয় এসপি গ্রুপের। যদিও, ১৯২০ থেকেই সাপুরজি পরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু হয় টাটা পরিবারের। এই দু'টি পরিবারই ছিল জরাথ্রুষ্টিয় এবং ধর্মীয় নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে এই দুই পরিবারই পারস্য থেকে পালিয়ে এসেছিল ভারতে।
১৯২৯ সালের ১ জুন, তাঁর জন্ম হয়েছিল তৎকালীন বম্বেতে। কলেজের পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি বিশেষ কিছু না ভেবে যোগ দিয়েছিলেন নিজের পারিবারিক ব্যবসায়। ভারত যে বছর স্বাধীনতা লাভ করল, সেই ১৯৪৭ সালেই পালোনজি মিস্ত্রি যোগদান করেন সাপুরজি-পালোনজি অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে। মাত্র ১৮ বছর বয়স থেকেই নিজের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পালোনজি। ব্যবসা প্রথম থেকেই যেন তাঁর রক্তেই ছিল। ভারতে একাধিকবার ব্যবসার ধারা পরিবর্তন হলেও তিনি নিজের জায়গা থেকে সরতে পছন্দ করতেন না। বরং, নিজেকে কীভাবে সমাজের সঙ্গে আরও বেশি মানিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই তাঁর লক্ষ্য থাকত সবসময়।
১৯৭৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ কোম্পানির দায়িত্বভার চলে আসে পালোনজি মিস্ত্রির কাঁধে। সেই সময় এই কোম্পানি শুধুমাত্র রিয়েল এস্টেট এবং বড় কনস্ট্রাকশনের কাজ করত। কিন্তু, শুধুমাত্র এই রিয়েল এস্টেট এবং কনস্ট্রাকশন ব্যবসা দিয়ে এমন একটি কংগ্লোমারেট সংস্থা চলতে পারে না। পাশাপাশি, সেই সময় ভারতে শুরু হয়েছিল ব্যবসার মূল ধারার পরিবর্তন। বিভিন্ন নতুন সেক্টর আসতে শুরু করেছিল ভারতীয় মার্কেটে। শুরু হয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির অগ্রগতি। তাই নতুনকে বরণ করে নেওয়ার ভাবনা নিয়েই সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের পরিবর্তনের দায়িত্বভার নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন পালোনজি মিস্ত্রি।
ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই কোম্পানির দায়িত্ব ধীরে ধীরে নিজের হাতে গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন পালোনজি। মাঝারি আকারের একটি কোম্পানিতে নিজের দূরদর্শিতা এবং ব্যবসার কৌশলের মেলবন্ধন ঘটিয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো এসপি গ্রুপের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। ভারতীয় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো যে-সময় ভারতের মধ্যে বড় বড় কনস্ট্রাকশনের দিকে নজর দিয়েছিল, সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার ইকোনমিকে লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। বিশ্বের কাছে এসপি গ্রুপের নাম ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বুমিং ইকোনমিকেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তিনি।
যখন মাসকটে নিজের রাজপ্রাসাদ তৈরি করার জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছিলেন সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ, সেই সময় সেই প্রাসাদের টেন্ডার নিলামের বাজি জিতে নিয়ে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। ১৯৭৫ সালের যেদিন সুলতান তাঁর রাজপ্রাসাদের দরজা সকলের জন্য খুলে দিলেন, সেই দিনটা ছিল সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের জন্য একটা মাইলফলকের সমান। মধ্যপ্রাচ্যের মতো পেট্রোডলার ইকোনমির দেশে ভারতীয় একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির পদচিহ্ন যেন গোটা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছিল, ভারতীয়রাও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এই মাসকট প্যালেস অন্যান্য ভারতীয় কোম্পানিগুলির জন্যও খুলে দিয়েছিল ব্যবসার রাস্তা। ভারতের অন্যান্য কোম্পানিরাও বিদেশে ব্যবসা করার সাহস পেয়েছিল এই একটি পদক্ষেপেই।
মাসকটের এই প্যালেস মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতেও সাপুরজি-পালোনজি কোম্পানির ব্যবসার রাস্তা খুলে দিয়েছিল পুরোপুরি। এই দু'টি জায়গায় বেশ কিছু ল্যান্ডমার্ক প্রোজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিল সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপ। ঘানার রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে শুরু করে, গাম্বিয়ার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, এবং মরিশাসের ইবেন আইটি পার্ক পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল এই এসপি গ্রুপের কনট্র্যাক্টেই। বিশ্বজুড়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল এসপি গ্রুপের নাম। ভারতীয় শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য পালোনজি মিস্ত্রি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের উন্নতির পিছনেও তাঁর অবদান ছিল বিপুল।
পালোনজি মিস্ত্রির হাত ধরে গত শতাব্দীর শেষ দিকে দারুণভাবে উন্নতি করেছিল এসপি গ্রুপ। সেই সময় পালোনজি মিস্ত্রি ছিলেন ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান। মুম্বইয়ের মায়ানগরীর বড় বড় বহুতল তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির অংশীদারিত্ব গ্রহণ করতে শুরু করেছিল এসপি গ্রুপ। স্টার্লিং অ্যান্ড উইলসন, ইউনাইটেড মোটরস, ফোর্বস গোকাক, একন ইনফ্রাস্ট্রাকচার-সহ বহু কোম্পানির অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেছিল এসপি গ্রুপ। একটা বড় সময় পর্যন্ত বেশ কিছু কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সেও নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, এসিসি সিমেন্ট গ্রুপ, ডব্লিউএইচ ব্র্যাডি গ্রুপের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শামিল ছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। পাশাপাশি, ভারতের অন্যতম বড় কংগ্লোমারেট সংস্থা টাটা সন্স লিমিটেডের ১৮.৪ শতাংশ অংশীদারিত্বও ছিল তাঁর হাতেই।
তাঁর ম্যানেজমেন্টের ধরন এবং বিশ্বজুড়ে এসপি গ্রুপের নাম ছড়িয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর পিতার থেকে ছিল অনেকটাই আলাদা। তাঁর পিতা তেমনভাবে কোনওদিন বিশ্বে নিজের ব্যবসাকে অগ্রগতি দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। জীবনে মাত্র দু'বার তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন, তাও চিকিৎসা করাতে। কিন্তু, ২০০৭ সালে মনোজ নাম্বুরু রচিত 'মুঘলস অফ রিয়েল এস্টেট' বইতে পালোনজি মিস্ত্রির দূরদর্শিতা এবং তাঁর ব্যবসার ধরন নিয়ে করা হয়েছে একটি অন্যরকম ব্যাখ্যা।
পালোনজি মিস্ত্রির পিতার ব্যবসার ধরন ছিল অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। তিনি চাইতেন প্রত্যেকটা ছোট থেকে ছোট বিষয়ের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে। তিনি চাইতেন যেন তাঁর প্রত্যেকটি ইঞ্জিনিয়ার দিনের শেষে তাকে রিপোর্ট জমা করে। কিন্তু পালোনজি এরকম মানুষ একেবারেই ছিলেন না। বরং তিনি নিজের কাজকে অনেকের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন ম্যানেজমেন্টের ভিন্ন একটি ধাঁচ। ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলেও, শুধুমাত্র যাতে নিজের কোম্পানির নাম বজায় থাকে, তাঁর জন্য পালোনজি মিস্ত্রি সমস্ত কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্ট শেষ করতেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সময়ে শুধু রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় নয়, জল, বিদ্যুৎ এবং অর্থনৈতিক সার্ভিসের সংস্থা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিল এসপি গ্রুপ। ফোর্বস কোম্পানি লিমিটেডে তাদের অংশীদারিত্ব এসপি গ্রুপকে টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, শিপিং বিজনেসের জগতেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।
আইরিশ নাগরিকত্ব ও ব্যক্তিগত জীবন
২০০৩ সালে পালোনজি মিস্ত্রি ডাবলিনের নিবাসী প্যাৎসি পেরিন দুবাশকে বিয়ে করার মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে গ্রহণ করেন আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব। তবে আয়ারল্যান্ডের পাশাপাশি ভারতেও তিনি একটা দীর্ঘ সময় বসবাস করেছেন। দক্ষিণ মুম্বইয়ে তাঁর নিজের একটি বাড়িও রয়েছে। তাঁর পরিবারে এই মুহূর্তে রয়েছে তাঁর স্ত্রী প্যাৎসি, কন্যা লায়লা রুস্তম জাহাঙ্গির এবং আলু নোয়েল টাটা, এবং দুই ছেলে সাপুর মিস্ত্রি এবং সাইরাস মিস্ত্রি।
কঠিন সময়
মুম্বইয়ের ওবেরয় হোটেল এবং আরবিআই বিল্ডিং ছাড়াও এসপি গ্রুপ আরও বেশ কিছু প্রজেক্টের জন্য ভারতে বেশ জনপ্রিয়। ১৯৭০ সালে এই কোম্পানিটি মুম্বইয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং ইম্পেরিয়াল তৈরি করেছিল। পাশাপাশি, ২০১০ সালে কোম্পানিটি তৈরি করেছিল দু'টি ৬০ তলার রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার। ৮০ একর জায়গাজুড়ে এসপি গ্রুপ তৈরি করেছিল পুনের বিখ্যাত টেকনোলজি পার্ক ওজোন।
টাকা কোম্পানি স্টিল কারখানা এবং গাড়ির কারখানা তৈরি করলে একই সঙ্গে পালোনজি গ্রুপের টাকার অঙ্কটাও বৃদ্ধি পায়। টাটা ফ্যামিলির অন্যান্য কিছু সেক্টর থেকেও কিছু পরিমাণ অংশীদারিত্ব গ্রহণ করতে শুরু করে এসপি গ্রুপ। ১০০-রও বেশি কোম্পানি তৈরি হয় টাটার পোর্টফোলিওতে। জাগুয়ার থেকে শুরু করে ল্যান্ডরোভার, টেটলি চা, করুস স্টিল এবং অন্যান্য বিভিন্ন কোম্পানি চলে আসে টাটার পোর্টফোলিওর মধ্যে। সেই সূত্রে অংশীদারিত্ব গ্রহণ করতে শুরু করে সাপুরজি গ্রুপ। পালোনজি মিস্ত্রি পরিচিত হতে শুরু করেন 'দ্য ফ্যানটম অফ বম্বে হাউস' হিসেবে। কিন্তু তাঁর খামখেয়ালিপনার জন্য টাটা গ্রুপের অন্যতম অংশীদার হিসেবে তাঁর গুরুত্ব অনেকটাই কমতে শুরু করে। তাঁর পরিবারের ব্যাপারেও খুব একটা বেশি কিছু জানা যায় না কোনওদিন।
২০০৪ সাল থেকেই পাকাপাকিভাবে গ্রুপ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পালোনজি মিস্ত্রি। এসপি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে আবির্ভাব হয় পালোনজি মিস্ত্রির বড় ছেলে সাপুর মিস্ত্রির। ২০১২ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন সাইরাস মিস্ত্রি। প্রথমদিকে সব ঠিকঠাক চললেও, টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে সাইরাস মিস্ত্রির অভিষেককে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি টাটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ। সেখান থেকেই শুরু হয় এসপি গ্রুপের অবক্ষয়।
টাটা গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ এবং সাইরাস মিস্ত্রি
২০১২ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন সাইরাস মিস্ত্রি। রতন টাটার পরবর্তীতে টাটা পরিবারের বাইরের কোনও একজন মানুষের টাটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের চেয়ারম্যান হিসেবে আবির্ভাব খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি টাটা ট্রাস্ট। ৪ বছর পর ২০১৬ সালে একটি বোর্ডরুম বৈঠকে সাইরাস মিস্ত্রিকে কোম্পানি থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় টাটা ট্রাস্ট। তৎকালীন সময় এই টাটা সনস এবং টাটা ট্রাস্টের নিয়ামক ছিলেন রতন টাটা নিজেই। তাঁর সরে যাওয়ার পর যেভাবে সাইরাস মিস্ত্রির আগমন ঘটে এবং টাটা গ্রুপের অবক্ষয় শুরু হয়, সেটা মেনে নিতে পারেননি রতন টাটা। কন্ট্র্যাক্ট শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাটা গ্রুপ। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে না পেরে টাটা ট্রাস্টের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সাইরাস মিস্ত্রি। প্রথমদিকে এসপি গ্রুপের পক্ষে আদালত রায় জানালেও ২০২১ সালের রায়ের পর এই মামলা সম্পূর্ণরূপে হেরে যায় এসপি গ্রুপ এবং সাইরাস মিস্ত্রি। ৭০ বছরের বিজনেস পার্টনারদের মধ্যে চলে আসে একটা বিশাল দূরত্ব।
টাটা কোম্পানি থেকে সরে যাওয়ার পর সাইরাস মিস্ত্রি নিজস্ব একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম তৈরি করেন। নামকরণ করেন মিস্ত্রি ভেঞ্চার্স এলএলপি। এই কোম্পানিটিও তেমনভাবে লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ২০২০ থেকে ধুঁকতে শুরু করে এসপি গ্রুপের প্রধান ব্যবসাও। তাদের পোর্টফোলিওতে একাধিক ধরনের ব্যবসা থাকলেও করোনা অতিমারী অনেকটাই ক্ষতি করতে শুরু করে সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের। পরিস্থিতি এমনটাই দাঁড়ায়, নিজেদের পক্ষে ব্যবসা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে সাপুরজি গ্রুপের। ২০২১-এর অক্টোবর মাসে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একটি সংস্থা মিস্ত্রি স্টারলিং অ্যান্ড উইলসন সোলার লিমিটেডের ৪০ শতাংশ অংশীদারিত্ব গ্রহণ করে। ততদিনে কার্যত মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে এসপি গ্রুপের।
শেষ জীবন
২০১২ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে সাইরাস মিস্ত্রির অভিষেকের পরেই সাপুরজি-পালোনজি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের সমস্ত অপারেশন এবং হোল্ডিং কোম্পানিগুলি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পালোনজি মিস্ত্রি। সম্পূর্ণ এসপি গ্রুপের দায়িত্ব আসে তাঁর বড় ছেলে সাপুর মিস্ত্রির হাতে। তখন থেকেই আর ব্যবসা নিয়ে খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করতেন না পালোনজি মিস্ত্রি। ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রি এবং মুম্বইয়ের হাইরাইজিং কমপ্লেক্স তৈরি করার মাধ্যমে ভারতের ব্যবসার জগতকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। এই অবদানের জন্যই ২০১৬ সালে ভারত সরকার থেকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৫ সালে যখন সাপুরজি-পালোনজি গ্রুপের ১৫০ বছরের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান হয়, সেই সময় শেষবারের মতো লোকসমক্ষে এসেছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি। তারপর থেকে নিজেকে লাইমলাইট থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন পালোনজি। দক্ষিণ মুম্বইয়ের ফার্মহাউস এবং আয়ারল্যান্ডের বাড়ি ছিল তাঁর শেষ জীবনের সবটুকু। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত গোটা পরিবার। তবে, সাপুরজি গ্রুপের বর্তমান অবস্থা হয়তো পালোনজি মিস্ত্রির খুব একটা ভালো লাগত না। নিজের হাতে বড় করা এই কোম্পানির এত বড় আর্থিক অবক্ষয় হয়তো তিনি মেনে নিতে পারতেন না।