শ্বাসের মধ্যে ভরে নেওয়া করোনা ভ্যাকসিন বেশি কার্যকরী? এবার জানিয়ে দিলেন গবেষকরা

সম্প্রতি গবেষকরা জানালেন, অন্যান্য কোভিড ভ্যাকসিনের তুলনায় এই নেক্সট-জেনারেশন কোভিড ভ্যাকসিন অনেক বেশি কার্যকরী।

নোভেল করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) প্রতিরোধের জন্যে নেক্সট-জেনারেশন ইনহেলড ভ্যাকসিন (Inhaled Vaccine) বানিয়েছিলেন ক্যানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির (McMaster University) গবেষকরা। মুখ দিয়ে প্রশ্বাস নেওয়ার মত করেই, নেওয়া যাবে এই ভ্যাকসিন। এই ইনহেলড কোভিড ভ্যাকসিনের (Inhaled Covid Vaccine) কার্যকারীতা পরীক্ষা করার জন্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও শুরু হয়েছিল গত বছর ডিসেম্বর মাসেই।

সম্প্রতি গবেষকরা জানালেন, অন্যান্য কোভিড ভ্যাকসিনের তুলনায় এই নেক্সট-জেনারেশন কোভিড ভ্যাকসিন অনেক বেশি কার্যকরী।

কেবল মূল নোভেলকরোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই নয়, নোভেল করোনাভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট ও সাবভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেয় এই ভ্যাকসিন। সম্প্রতি সেল নামের এক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার ফল।

এই গবেষণার মুখ্য গবেষিকা, ড: ফিওনা স্মাইল (Fiona Smille) ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে* লিখেছেন, "এই নেক্সট-জেনারেশন কোভিড ভ্যাকসিনের প্রভাব কেবল দীর্ঘ সময়ে ধরেই স্থায়ী থাকবে এমন নয়, এটি নোভেল করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলির বিরুদ্ধেও আমাদের সুরক্ষা দেবে"।

ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই ইনহেলড ভ্যাকসিন কেবল সহজে নেওয়া যায় এমনই নয়, সামান্য পরিমাণে নিলেই এই ভ্যাকসিন কার্যকরী হয়। মুখ দিয়ে নেওয়ার ফলে, এই ভ্যাকসিনের কণা সরাসরি ফুসফুস ও শ্বাসনালীর (Respiratory Tract) বাইরের কোশের স্তর বা মিউকোজা়ল লেয়ারে (Mucosal Layer) আটকে যায় এবং সেখান থেকেই সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে ইঞ্জেকশনের সুঁচের ব্যথাও পেতে হয় না, ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম দেখা যায়।

তিনি জানাচ্ছেন, এই ভ্যাকসিন শরীরে প্রবেশ করলেও B ও T-কোশ সহ, একাধিক ধরণের রোগ প্রতিরোধী কোশ (Immune
cells) রক্তে তৈরি হয়। এই রোগপ্রতিরোধী কোশগুলোর মধ্যে অন্যতম মেমোরি টি- সেল, এবং ট্রেইনড অ্যালভিওলার ম্যাক্রোফেজেস। ফুসফুসের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে এই রোগপ্রতিরোধী কোশগুলিকে। এবং এই ভাকসিনের প্রভাবে ফুসফুসের (Local Antibody) পাশাপাশি, সারা শরীরেও অ্যান্টিবডি (Systemic Antibody) তৈরি হয়েছে।

যেহেতু নোভেল করোনাভাইরাস প্রাথমিক ভাবে ফুসফুসের কোশেই প্রবেশ করে, এই রোগ-প্রতিরোধী কোশগুলি প্রথমেই ফুসফুসে তৈরি হলে, কোশের ভেতর ঢোকার ভাইরাস সঙ্গে সঙ্গেই তাকে প্রতিরোধ করবে এরা (রোগ-প্রতিরোধী কোশ)। অথচ ইন্ট্রামাস্ক্যুলার ভ্যাকসিন অর্থাৎ সুঁচের সাহায্যে পেশীতে নিতে হয় যে ভ্যাকসিনগুলি, সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি প্রাথমিক ভাবে সেখানেই তৈরি হয়, যেখানে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। পরে তা রক্তের মাধ্যমে ফুসফুস সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথম ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে (Phase I Clinical Trial) এই মানুষের শরীরের জন্যে কতটা নিরাপদ, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। এর পাশাপাশি, এই ধাপেই পরীক্ষা করে দেখা হবে, ইনহেলড ভ্যাক্সিন শরীরে প্রবেশ করার ফলে রক্তে এবং ফুসফুসে নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি-না।

এখানে উল্লেখ্য নির্দিষ্ট চাবি যেমন একটি নির্দিষ্ট তালাকেই খুলতে পারে, তেমন একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডিগুলি, নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের সাথেই যুক্ত হতে পারে (Lock and Key Model)। ভাইরাসের কোশের যে কোনো অংশকেই অ্যান্টিজেন বলে।

সাধারণত কোভিডের অন্যান্য ভ্যাকসিনে এই ভাবেই বানানো হয়েছে, যাতে ভ্যাকসিনে থাকা অ্যান্টিবডিগুলি ভাইরাসের বাইরের কাঁটার মত দেখতে স্পাইক প্রোটিন (Spike Protein) বা S-Protein- এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ আটকাতে পারে।

এ পর্যন্ত বাজারে আসা কোনো কোভিডের ভ্যাকসিনের প্রভাবে এমন অ্যান্টিবডি শরীরে তৈরি হয় না, যা স্পাইক প্রোটিন বাদে নোভেল করোনাভাইরাসে থাকা অন্য প্রোটিনের সাথে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু এই ইনহেলড ভ্যাক্সিনের বৈশিষ্ট্য হল, এতে যে ধরনের অ্যান্টিবডি রয়েছে, তারা স্পাইক প্রোটিন বাদেও, নোভেল করোনাভাইরাসের বাইরের এবং ভেতরের একাধিক প্রোটিনের সাথে যুক্ত হতে পারবে।

যখন নোভেল করোনাভাইরাসের জিনে রাসায়নিক পরিবর্তন হয়, তখনই কিন্তু তৈরি হয় নতুন ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট। এবং নোভেল করোনাভাইরাসের জেনেটিক পরিবর্তন (Mutation) এলে, রাসায়নিক পরিবর্তন আসে স্পাইক প্রোটিনেও। তখন আর পুরোনো ভ্যাকসিনগুলো আগের মত কার্যকারীতা দেখায় না।

কিন্তু যেহেতু নতুন এই ইনহেলড ভ্যাকসিন, স্পাইক প্রোটিন ছাড়াও একাধিক প্রোটিনের ওপর কাজ করে, তাই আশা করা হচ্ছে, স্পাইক ভাইরাসটির জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে স্পাইক প্রোটিনের গঠন বদলালেও, ভ্যাকসিনটি ভাইরাসের অন্যান্য প্রোটিনের (যেমন নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন এবং আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ বা Rdrp) উপর কাজ করে ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে পারবে।

যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায় ভাইরাসের একাধিক প্রোটিনের উপর কাজ করছে এই ভ্যাকসিন, তাহলেও পরবর্তীকালে তৈরি হওয়া অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট ও সাবভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কাজ করবে এই ইনহেলড ভ্যাক্সিন", জানাচ্ছেন ড: স্মাইল।

এই ভ্যাকসিন কোভিডের পাশাপাশি, সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ইনফ্ল্যুয়েনজা় ও ব্যাক্টিরিয়া ঘটিত নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধেও আমাদের সুরক্ষা দিতে পারে, এমন সম্ভাবনাও দেখছেন গবেষকরা।

ড: স্মাইল ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছেন, "টিউবারকিউলোসিস প্রতিরোধের জন্যে, কোভিড মহামারী শুরুর অনেক আগে থেকেই আমি এবং আমার ল্যাবের অন্যান্য সদস্যরা প্রশ্বাসের সাহায্যে নেওয়া যাবে এমন ভ্যাকসিন বানানোর চেষ্টা করছি। দশকের পর দশক কাজ করার পরও আমাদের কাজের উন্নতি বেশ ধীরেই হচ্ছিল।
কিন্তু যেই  কোভিড মহামারীর মুখোমুখি হলাম আমরা, আমরা এই ধরনের ভ্যাকসিন দ্রুত বানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম"।

এই কাজের জন্যে প্যাথোলজি, মলিকিউলার মেডিসিন, সংক্রামক ব্যধি, ইমিউনিটি এবং এরোসল বিষয়ক গবেষকদের নিয়ে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম তৈরি করেন ড: স্মাইল।

মূল প্রতিবেদনটি পয়লা জুন দ্য কনভার্সেশন নামের ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

More Articles