আম-কাঁঠালের দুপুর আর দাওয়ায় কাঁসার থালায় ভাত

মায়ে কয়, আমাদের মধু কুলকুলির গাছ আছিল না এট্টা! সেই যে ঝরে পইড়া গেল! সেবারে! ঠাকমা খেতেন! টিপে টিপে ফুটো করে!

তিতা বলো, মিঠা বলো- ভাতের যুগ্যি কেউ না। কইছি না তোরে! কত বার কইছি, ভাতের খিদা আর কিসুতেই মেটে না। একেকদিন একাদশীর দুপুরে এমন কথারা গরম হাওয়ায় পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতো তার শরীরজুড়ে তখন নির্লিপ্তি আর ক্লান্তি। কে যেন বলতো এমন করে! কে যেন একাদশী পেরনো দুপুরে ভাতের খিদে মনে চেপে ওই সামনের পুকুড়পাড়ে গিয়ে বসে থাকত! নাহ্, সে আর নাই। গ্যাছে গিয়া। জীবনের ওপারে ওই আম-কাঁঠালের বনে সে তো হারিয়েই গেছে কবে। তার কানাতোলা কাঁসার থালা, ফুলকাটা বাটি- সব ওই তোলা আছে বাক্সের ভিতরে। এমন আম-কাঁঠালের দিনে সেই বাটিখান দাওয়ায় এসে বসতে চায়। সেই থালখান বুঝি আরেকটু ভাত চেয়ে নিতে চায় শেষ পাতে। চাইলেই আর দিচ্ছে কে বলো!

 

মানুষের জেবন তো এমনই। তুমি যদ্দিন আছ, তদ্দিন কেবল ওই নীল মাছিটার মতো উড়ে উড়ে আম-কাঁঠালের গন্ধ শুঁকে বেড়ানোর সুখ। প্রাণপাখিখান ফুড়ুৎ হলো, তো পড়ে রইল ওই বাটি ওই কাঁসার থাল। এসব দেখে দেখে জেবনকে কি আর ভালবাসতে ইচ্ছে করে? করে তো! তাই না এমন জৈষ্ঠ্যের দিনে আমের বোঁটা কেটে কেটে ওই এত্ত বড় গামলায় ডুবিয়ে দিচ্ছে সংসারী হাতখানা। মেয়ে বলে, ও মা! এসব করো ক্যান! না কাটলে কী হয়! খাইলেই তো হয়! মায়ে এসব ফালতু কথার উত্তর দেয় না। পিঁড়ি পেতে বসে বসে কেবল থালা ভরে আম কাটে, সে আম ফুলকাটা রেকাবিতে সাজিয়ে রাখে। বলে, যা তো বিনি! আম ক'খান ঠাকুদ্দারে দিয়ায়। ঠাকুদ্দার থালখান নামানো হলে মায়ে ওরে আম-মুড়ি মেখে দিবে কইসে। বিনি তাই পিঁড়ি পেতে এসে বসে মায়ের কোল ঘেঁষে। বিনির বাপে বলে, আমারে আজ চিঁড়া দিবা? মায়ে উত্তর করে, না, চিঁড়া ধোয় কেবল। বিনি জানে, মায়েরে একেকদিন মনখারাপে পায়। এমন আম-কাঁঠালের দিনে বড়ঠাম্মারে মনে করে মা চোখের জল ফেলে খানিক। সে ছিল ভারি দুঃখী মানুষ। বিয়ে হয়ে এসে তক তার কাছেই তো মায়ে সোহাগ পাইছে! তার কথা ভোলে ক্যামনে মানুষ! মায়ে তাই ফুলকাটা বাটি এমন দিনে নাড়ে-চাড়ে, বাক্সের ডালা খুলে পুরনো বর্মিবাক্সখান একবার বের করে। এসব ফুরালে বেশ ভালো দেখে একখান হিমসাগর কেটে মায়ে ওই পাঁচিলের ওপরে রেখে আসে। বড়ঠাম্মা না এলেও লাল গলা বুলবুলি ওসব আমে পেট ভরাতে ছাড়ে না।

 

এমন করে এ-বাড়ির মায়ায় বড়ঠাম্মাকে বড় বেশি করে জড়ায়ে রাখেন মা। কে যে কারে চক্ষে হারায় এ সংসারে, তার তল পাওয়া ভার। আমের দিনে পান্তা দিয়ে আম-কাঁঠাল খাইতে সুখ কত! এমন দিনে কুমড়োর ঘাঁটাচচ্চড়ি, শোল মাছের ঝোল- সব পড়ে থাকে ওই। মাইনষের এখন কেবল ফল-পাকুড়ের সুখ। মা তো বলে, বিনি! ভাত খায়ে প্যাট ভরাস ক্যান! আম খা আর দু'খানা বরং। বিনির অবিশ্যি তাতে না নাই। আমের দিনে মাইনষে আবার কবে গুণে আম খায়! মায়ে তাই সাততাড়াতাড়ি আর দু'খানা আম কেটে এনে দেয়। বিনি এখন একমনে আমের আঁটি চুষছে। এ বচ্ছরে পুকুর ধারের হিমসাগরখানায় যা আম হইসে! তেমন হইসে গোলাপখাসে। তবে দাঁতে আমের আঁশ আটকে আটকে যায়, বিনি তাই খাইতে চায় না। মায়ে তখন সারা দুপুর ঢিমে আঁচে দুধের কড়াওখান বসিয়ে রাখেন। সে দুধ বিকেল বিকেল আরও মেড়ে আনেন কিছুটা। সেই লালচে ক্ষীরে গোলাপখাস কেটে মিশিয়ে দেন মা।

 

আরও পড়ুন: ধান কাটতে কাটতেই ভাত খাওয়া ফজল আলিদের

 

বিনি মাস্টারের বাড়ি থেকে পড়ে ফিরলে 'পর বাটি ভরে দেন। বাবা খায়, ঠাকুদ্দা খায়। মা-ও খায়, তবে সামান্য। তাও ওই সন্ধে দিয়ে তাপ্পর। তবু এমন দিনে মায়ের খানিক খানিক হাতের অবসর হয়, বিনিও বোঝে সেকথা। এই তো কাল একখান বড় কাঁঠাল নামানো হয়েছে। এই এত্ত বড় বড় কোয়া ও গাছের কাঁঠালের। মা এখন চালুনি পেতে কাঁঠালের রস কত্তে বসেছে। রাত্তিরে আজ সব ক্ষীর দে, কাঁঠালের রস দে মুড়ি খাবে, ভাত খাবে। সারা বাড়িখান গন্ধে ভরে উঠেছে ক্যামন! কাঁঠালের ভুতি ওই বাইরে ফেলে আসতে আসতে মা কি বিনিকে ডাকছে? মা যে কেন বিনিকে ডাকে না! বিনি তাও উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ডাকছিলে মা? মা এমন প্রশ্নে অবাক হয় না, কেবল বলে, তুই যা গিয়ে, পড়া শেষ কর। এমন লো ভল্টেজেও মায়ের মুখখান ক্যামন সুন্দর যে দেখায়! ঘাম-তেল মেখে মায়ের মুখখান য্যান ঠাকুরের মতো।

 

মায়ের সব ভালো, কেবল এই পড়ায় ফাঁকি মায়ের না-পছন্দ। বিনি তাই চাইনিজ বাতির নিচে বসে বসে ইতিহাস পড়ে, ভূগোল পড়ে। মায়ে তখন মাদুর পেতে পা মেলে বসেন। বসে বসে রেডিও শোনেন। এমন নিভু নিভু আলোয় কীই-বা করবে মা! বাবায় তো গ্যাছে পাড়ার দোকানে আড্ডা দিতে। ঠিক নয়ডা বাজলে এসে পড়বে 'খন। বাবার গলা শুনতে পাবে বিনি। সুলেখা কই গো, খেতে দেবে না কি! মায়ে তখন মাদুর গোটাবে, হাত ধোবে, খাবার জায়গা করবে। বিনিও করবে মায়ের হাতে হাতে। কাঁঠালের গন্ধমাখা দাওয়াখান ধুয়ে-মুছে দিলেও ফল-পাকুড়ের গন্ধে বাড়িখান ভরে থাকে এমন দিনে। বাবা একেকদিন ছাতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন বেশি রাত্তির পর্যন্ত। শুয়ে শুয়ে কী যে ভাবেন, কে জানে! বিনিও বাবার পাশটিতে শুয়ে থাকে। বাবার এত পাশে শুয়েও বাবার মনের হদিশ পায় না বিনি। বাবা বলে, তোর মা কইরে বিনি? এমন কথার মধ্যে ঠাকুদ্দার মশারি গুঁজে দিয়ে মাও এসে পড়ে। বিনিদের তো আর ফ্রিজ নেই! মা তাই জলের উপর দুধ, খাবার সব বসিয়ে ঢেকেঢুকে দেয়। বিনির বাবা বলে, শুনছ? একদিন ঠাকুমার মতো করে পাকা আম দিয়ে কাসুন্দি মেখে খাওয়াবে? মা ঘাড় নাড়ে। বিনি জানে, এমন ফল-পাকুড়ের দিনে মায়ের মনখান বড় ঠাকুমার গন্ধে ভরে থাকে সারা দিন। বড় ঠাকুমা কেমন নাকে ঝাঁজ তুলে টুলটুলে পাকা আম দে কাসুন্দি মেখে খেতেন! একেকদিন আবার কাঁচা মরিচ ফালি করে করে দিতেন খানচারেক। পাকা আমে, সরষের ঝাঁজে আর মরিচের গন্ধে বিনিদের বাড়িখান তখন ভরে উঠত। এসব মনে পড়ে বুঝি বিনির মায়ের। মা তাই খানিক গলা ঝেড়ে একখান আবদার করে বসেন। বলেন, তোমারে একখান কথা কই? বাপে বলে, কও না কী কইবা! মায়ে কয়, আমাদের মধু কুলকুলির গাছ আছিল না এট্টা! সেই যে ঝরে পইড়া গেল! সেবারে! ঠাকমা খেতেন! টিপে টিপে ফুটো করে!

 

এবারের রথের মেলায় কিনে দিবে একখান চারা? বাপে কয়, ওসব আমের চারা কি আর পাব! এমন কথায়, মায়ে কেবল একখান লম্বা শ্বাস ছাড়ে। কয়, ছাড়ান দাও। আর খুঁজতে লাগব না।

More Articles