সাতবার বিয়ে, প্রতিবার স্বামীর মৃত্যু, কলকাতার কাছেই আছে রহস্যময়ী 'সাত সাহেবের বিবি'-র কবর

আজ হয়তো আমরা ওলন্দাজ, দিনেমার অথবা পর্তুগিজদের কথা মনে রাখি না, কিন্তু তারা রয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যে। ছোটগল্প থেকে সিনেমার চিত্রনাট্য, নতুন ধরনের খাবার থেকে শীতের ছুটিতে পিকনিক করতে যাওয়ার জায়গার মধ্যে তারা রয়ে গিয়েছে নিজ...

বাংলায় ঔপনিবেশিক শক্তি বলতে আমরা ইংরেজ এবং কিছু ক্ষেত্রে ফরাসিদের কথা বললেও পর্তুগিজ, দিনেমার অথবা ওলন্দাজরা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। স্কুলের বইয়ের পাতায় মুখস্থ করার জন্যে কয়েকটা লাইন আর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু নিদর্শন ছাড়া তারা আমাদের ইতিহাসে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করেছে। বর্তমানে ওলন্দাজদের পছন্দের চুঁচুড়া, দিনেমারদের প্রিয় শ্রীরামপুর অথবা পর্তুগিজদের প্রিয় ব্যান্ডেল এবং সপ্তগ্রামের তুলনায় ফরাসিদের ঘাঁটি ফরাসডাঙা (চন্দননগর) অথবা ইংরেজদের সাধের ক্যালকাটার (কলকাতা) বেশি জনপ্রিয়, কিন্তু এইসব জায়গায় কান পাতলে এখনও শোনা যাবে অতীতের ফিসফিসানি।

হল্যান্ড শব্দটা কোনওভাবে বিকৃত হয়েই সম্ভবত ওলন্দাজ নামটা এসেছিল। বাংলার মাটিতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন ঘটেছিল ইংরেজদের বহু আগেই। ১৬৩৫-১৭৯৫ সাল অবধি প্রধানত মশলা, নুন, আফিম এবং মসলিনের ব্যবসা করে ওলন্দাজরা চুঁচুড়াতে জাঁকিয়ে বসেছিল। সেই সময়ে তাদের ব্যবসার মুনাফা এত বেশি ছিল যে, ইন্দোনেশিয়াতে জমা না রেখে ব্যবসা-সংক্রান্ত সমস্ত জিনিস তারা সোজাসুজি হল্যান্ডে পাঠাতে শুরু করে। ওলন্দাজরা সেই সময় চুঁচুড়াতে ফোর্ট গুস্তাভাস নামে একটি কেল্লা তৈরি করেছিল, যদিও আজ আর সেই কেল্লার কিছুই অবশিষ্ট নেই। চুঁচুড়াতে ওলন্দাজদের অস্তিত্বের প্রমাণ তারা নিজেরাই দিতে চায়। চুঁচুড়ার ডাচ কবরখানা সপ্তদশ শতকে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ দেয়। আজ বাংলায় ওলন্দাজরা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক, তবুও প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই জাতির এক মহিলার রহস্যময় জীবন নিয়ে তৈরি হওয়া লোককথা আমাদের দেশের এক প্রখ্যাত লেখকের একটি ছোট গল্প এবং একটি হিন্দি সিনেমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

Saat Khoon Maaf Scene

'সাত খুন মাফ' ছবির একটি দৃশ্যে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

'সাত খুন মাফ' ছবির একটি দৃশ্যে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

চুঁচুড়া এবং চন্দননগরের মধ্যে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে তালডাঙা মোড়ের কাছে সাধারণ মানুষের কাছে মেমসাহেবের কবর অথবা সাত সাহেবের বিবির কবর নামে পরিচিত কবরটি আসলে সুজানা আনা মরিয়ার। ধনী, প্রভাবশালী এই রহস্যময়ী নারীর ব্যাপারে শোনা যায় যে, ভদ্রমহিলা সাতবার বিয়ে করেছিলেন এবং সকলেই সুজানা বেঁচে থাকাকালীন মারা যান। যদিও ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টে তোলপাড় করে ফেললে অথবা জ্ঞানী গুগলকে খোঁজ করতে বললেও শুধুমাত্র তাঁর দুই স্বামীর ব্যাপারে জানা যায়। দুই স্বামীর মৃত্যু স্বাভাবিক এবং তাঁদের কবর চুঁচুড়াতে আছে। ইতিহাস সুজানার বাকি পাঁচ স্বামীর অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও মানুষের মুখে মুখে সুজানা সাত সাহেবের বিবি হয়ে থেকে গিয়েছেন। প্রখ্যাত লেখক রাসকিন বন্ডের লেখা ছোট গল্প 'সুজানাস সেভেন হাজব্যান্ড'। সেই ছোট গল্প থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত 'সাত খুন মাফ'-এর চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাস্তবের রহস্যময়ী সুজানাকে ঘিরে তৈরি হওয়া অসংখ্য গল্প থেকেই রাসকিন বন্ড তাঁর কাল্পনিক সুজানাকে তৈরি করেছিলেন। যদিও গল্পের সুজানা তাঁর স্বামীদের পরিকল্পিতভাবে খুন করেছিল আর বাস্তবের সুজানার বিরুদ্ধে এইরকম কোনও তথ্য অথবা অভিযোগ পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন: কলকাতা থেকে দু’পা, এখনও জেগে আছে যে দিনেমার বাংলা

দিনেমারদের (ডেনমার্কের বাসিন্দা) রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিক্সের নাম থেকে বাংলায় তাদের ঘাঁটির নাম হয় ফ্রেডরিক্সনগর। এই ফ্রেডরিক্সনগর আমাদের কাছে শ্রীরামপুর নামে পরিচিত। দিনেমাররা ফরাসিদের সাহায্যে বাংলার নবাব আলিবর্দি-র থেকে এই শর্তে ষাট বিঘা জমি কিনতে পারে যে সেই জমিতে তারা কোনও মজবুত কেল্লা তৈরি করতে পারবে না এবং এই এলাকায় অহেতুক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারবে না । ১৭৫৫-১৮৪৫ সাল অবধি শ্রীরামপুর বাংলায় দিনেমারদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। তারা নীল, তুলো, সিল্ক, মশলার ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। শ্রীরামপুরে দিনেমারদের তৈরি নিদর্শন বলতে একমাত্র সেন্ট ওলেভ চার্চ বিভিন্ন সরকারি সাহায্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। ২০১৬ সালে প্রচুর মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যে তার পুরনো রূপ ফিরে পেয়েছে। যদিও ওলেবি-র কবর আজ কংক্রিটের জঙ্গলে প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে।  শ্রীরামপুর কলেজ এবং বর্তমানে ডেনমার্ক ট্যাভার্ন সাধারণ মানুষের কাছে খুব পরিচিত দুটো নাম হলেও দিনেমাররা কিন্তু নিজেরা কোনওটাই তৈরি করেনি।শ্রীরামপুর কলেজ এবং ছাপাখানা তৈরি করা উইলিয়াম কেরি  ইংরেজ ছিলেন। ডেনমার্ক ট্যাভার্নের মালিক পার সাহেব আসলে ইংরেজ ছিলেন। ক্যালকাটা গেজেট-এর একটি বিজ্ঞাপন ডেনমার্ক ট্যাভার্নের মালিকানা বিষয়টির সমর্থন করে। যদিও শুধুমাত্র ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত শান্ত শ্রীরামপুরে যে নানা জাতের নানা দেশের মানুষের আগমন ঘটবে, এবং তারা সকলে মিলেই শহরটাকে সাজিয়ে তুলবে, সেটাই স্বাভাবিক।

পর্তুগিজরা বাংলায় তিনটে জায়গায় বাণিজ্য শুরু করেছিলো। সুলতান হুসেন আলাউদ্দিনের সময় পর্তুগিজ নৌবহর প্রথম এসে পৌঁছয় চট্টগ্রামে। ধীরে ধীরে তারা সপ্তগ্রাম এবং হুগলি-তে ব্যবসা শুরু করে। সপ্তগ্রাম এবং হাওড়ার ব্যাটরাতে মুঘল এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পর্তুগিজদের ব্যবসার কথা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে নদীতে পলি জমে জাহাজ চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লে সপ্তগ্রামের গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়। পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম এবং সপ্তগ্রামে চাল, কাঠ, মশলা, কাপড়, বারুদ-সহ অনেককিছুর ব্যবসা করলেও হুগলিতে এসে নুনের একচ্ছত্র ব্যবসা শুরু করে। নুনের ব্যবসা থেকে প্রচুর লাভ করার ফলে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়লেও তামাকের ওপর চাপানো শুল্কের ভাগ নিয়ে মুঘল বাদশাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই সম্পর্কের অবনতির ফলে ১৬৩২ সালে মুঘল বাদশা শাহজাহান হুগলি ও চট্টগ্রাম আক্রমণ এবং দখল করেন। পর্তুগিজরা নিজেদের তিনটে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হারিয়ে ব্যান্ডেলে সরে যেতে বাধ্য হয়।

বাংলা শব্দ বন্দর থেকে ব্যান্ডেল নিজের নাম পায়। ব্যান্ডেলে পর্তুগিজদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য আজও ব্যাসিলিকা অফ দ্যা হলি রোজারি দাঁড়িয়ে আছে। এই চার্চ আমাদের কাছে ব্যান্ডেল চার্চ বলে পরিচিত। ১৫৯৯ সালে তৈরি হওয়া প্রথম চার্চটি ১৬৩২ সালে ধ্বংস হয়ে গেলেও ১৬৬০ সালে তার পুনর্নির্মাণ করা হয়। চার্চের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গঙ্গার দৃশ্য হয়তো সেই যুগ থেকে বর্তমানে সকলকে বিস্মিত করে। ব্যান্ডেল চার্চ ছাড়া এই এলাকায় পর্তুগিজদের নির্মাণ করা কোনওকিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তবে আজও এক খাবারের সঙ্গে ব্যান্ডেল এবং পর্তুগিজরা জড়িয়ে আছে যার নাম ব্যান্ডেল চিজ। সম্ভবত, ছানা থেকে তৈরি এই চিজ পর্তুগিজরা ব্যান্ডেলে প্রথম তৈরি করেছিল। যদিও বহু সূত্র এটাও জানায় যে, ব্যান্ডেল চিজে পর্তুগিজ, বাঙালি ছাড়াও সম্ভবত বার্মিজ প্রভাব রয়েছে। এখনও তারকেশ্বর এবং বিষ্ণুপুরে এই ব্যান্ডেল চিজ পাওয়া যায়। কলকাতায় সম্ভবত শুধু নিউ মার্কেটে জে জনসন দোকানে এই চিজ পাওয়া যায়।

আজ হয়তো আমরা ওলন্দাজ, দিনেমার অথবা পর্তুগিজদের কথা মনে রাখি না, কিন্তু তারা রয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যে। ছোটগল্প থেকে সিনেমার চিত্রনাট্য, নতুন ধরনের খাবার থেকে শীতের ছুটিতে পিকনিক করতে যাওয়ার জায়গার মধ্যে তারা রয়ে গিয়েছে নিজেদের কথা বলার অপেক্ষায়।

More Articles