কলকাতা থেকে দু’পা, এখনও জেগে আছে যে দিনেমার বাংলা
এসো এসো এ পান্থশালায়, উপাসনালয়ে যেও নাকো মোটে...
দেওয়ান-ই-হাফিজ
মহাদ্যুতি চক্রবর্তী: তার হাতছানি ডাক যেন এমনই, এক নিশির গুণগুণ গুঞ্জন। সেখানে পা দিলেই শুরু টাইমট্রাভেল। একশো-দুশো-তিনশো বছর পেরিয়ে আজও সজাগ এই সাকি-সুরা-মেহেফিল, যেখানে জীবনের এক বেদনাবিধুর গান এখানে বেজে চলে অবিরল। আপনি চাইলেই সেই গানের পথ পেয়ে চলে যেতে পারেন দিনেমারদের শহরে, ছুঁয়ে দেখতে পারেন তার খিলান গম্বুজ। বাড়ির কাছেই সেই আরশিনগর থুড়ি ফেডরিক্সনগর।
শ্রীরামপুরের বুকের বাঁ দিক ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। তাঁর ধার ঘেঁষেই নবসাজে সেজে উঠেছে ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ন। ট্যাভার্ন মানে খানাপিনার জায়গা। সারা দিনের পথশ্রমের শেষে বেগানা যুবক যেখানে দেহতরী ভিড়িয়ে দেবে। এখন অবশ্য সে বালাই নেই। ডেনমার্ক ট্যাভার্ন এক সাদামাটা ক্যাফে, কিন্তু যে বিরাট ইমারতে এই ক্যাফে গড়ে উঠেছে তার আনাচ-কানাচ, অন্দরসজ্জা, মৌতাত আপনার শরীর আর মনটাকে নিয়ে ফেলবেই সেই পুরানো ড্যানিশ সরাইখানায়। সাদাপাথরে হাত রাখলেই কথা বলবে পাথরে বুকে রাখা গোলাপগুচ্ছ।
কলকাতার থেকে বয়সে বড় শ্রীরামপুর। কলকাতার সঙ্গে তুলনা করলে আজ যা জেগে আছে তা এক বিষন্নকরুণ শহরের ফসিল, কিন্তু সেই ফসিল ছুঁয়েও বোঝা যায় ইতিহাসের কত শুভ অশুভ মহরতের সাক্ষী থেকেছে এই ছোট জনপদ। ইতিহাস বলছে, কলকাতার সাবালকত্ব প্রাপ্তির অন্তত ৫০০ বছর আগে শ্রীরামপুর সেজে উঠেছিল রানির মতো। পঞ্চদশ শতক থেকে শ্রীরামপুর-সহ হুগলির অন্যান্য জায়গাগুলি থেকে উপনিবেশ স্থাপন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পর্তুগিজ, ডাচ, দিনেমার ও ফরাসিরা। ১৭৫৫ সালে শ্রীরামপুরে দিনেমাররা বানিজ্যকুঠি স্থাপনের অধিকার পায়।
ডেনমার্কে তখন বাংলার চিনি, শোরা ও সুতির বস্ত্রের খুব চাহিদা। ধীরে ধীরে শহরটিকে নিজেদের মতো করে সাজাতে থাকেন দিনেমাররা। দিনেমার রাজা পঞ্চম ফ্রে়ডরিক্সের নাম অনুসারে এই শহরটির নাম দেওয়া হয় ফ্রেডরিক্সনগর কেউ কেউ আবার বলতেন ডেনমার্কনগর। গঙ্গার ঘাটে উড়ত ড্যানিশ পতাকা। সেই পতাকা দেখেই হয়তো নগরীটিকে চিনতেন দিনেমার বনিকরা। বাংলার বাজারে তারা ট্র্যাঙ্কুবারের তামা, লোহা, সুরা ও লবণ নিয়ে এসেছিল সুদূর ইওরোপ থেকে। এসব কাঁচামালের সওদা করে পসার জমিয়েছে বহু বাঙালি। গোড়ারদিকে দিনেমার বণিকরা শেওড়াফুলি হাট থেকেই জিনিসপত্র কিন সেগুলি ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করতেন। পরের দিকে তাঁরা পণ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাঁদের নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করেন। দিনেমারদের প্রথম বাঙালি প্রতিনিধি ছিলেন শোভারাম বসাক ও আনন্দরাম ধোবা। এই দুই স্থানীয় ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে সওদা করার পর দিনেমাররা নন্দলাল চক্রবর্তী নামক এক ব্যক্তি এজেন্ট নিযুক্ত হন। আঠারো শতকের শেষের দিকে বর্ধমানের পাটুলী থেকে হরিনারায়ণ এবং রামনারায়ণ গোস্বামী নামে দুই সহোদর তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় হাজির হন শ্রীরামপুরে। হরিনারায়ণ দিনেমার কোম্পানির অধীনে চাকরি নেন এবং রামনারায়ণ শুরু করেন মহাজনি ব্যবসা। এতে খুব কম সময়ের মধ্যেই এই দুই গোস্বামী প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তারা শ্রীরামপুরের পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন সমন্বয়ে একটি অভিজাত পল্লি স্থাপন করেন। এঁদের দেখাদেখি অন্যান্য মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরাও বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন। এভাবেই এই শহরে বর্ধিষ্ণু বাঙালিদের উঠে আসা।
১৭৭৬ সালে কর্নেল ওলেবাই শ্রীরামপুরের দায়িত্ব পান। শহরটিকে তিনি ঢেলে সাজানো শুরু করেন। দশ বছর পরে নদী ঘেঁষেই তৈরি হয় ডেনমার্ক ট্যাভার্ন। সরাইখানার মালিক অবশ্য ছিলেন জাতিতে ইংরেজ। জেমস পার নামক ওই ভদ্রলোক দ্য ক্যলকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখেন, যে সকল ভদ্রমহোদয়গণ এই নদীপথে যাত্রা করেন তারা এখানে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন, রাতের খাবার, আশ্রয় পাবেন। সাথে সাথে সিঙ্গেল ডজনে লিকার ও এবং একটি উত্তম বিলিয়ার্ড টেবিল এবং দৈনিক পত্রিকা-সহ কফিঘরও থাকবে। সন্দেহ নেই অতিদ্রুত দিনেমার বণিকদের চোখ টেনেছিল এই মেহেফিল। সান্ধ্য আড্ডার আলোঝলমল সেই দিনের কথা কেন যে কেউ লিখে রাখেননি তা ভাবতে বললে মাথা চাপড়াতে হবে। ডেনমার্ক ট্যাভার্নের গায়েই গভর্নমেন্ট হাউজ। ১৭ বিঘা জমির উপর সে এক গা ছমছমে ছায়াঘেরা পেল্লায় বাগানবাড়ি, এখন সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয়। এ বাড়িটি নিয়েও তেমন কোনও তথ্য আজ সুলভ নয়। ঢিল ছোঁড়া দূরে প্রোটেস্ট্যান্ট নাগরিকদের জন্য সেন্ট ওলাভ গির্জার কাজ শুরু হয় ১৮০০ সালেই, ওলেবাই-এর সময়। বছর কয়েক ধরে সুউচ্চ গির্জাটি মাথা তুলেছিল। গির্জার কাজ শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য ওলেবাই মারা যান। তাঁর কীর্তির সম্মানে গির্জায় একটি স্মৃতিফলকও রয়েছে। ওলিবাইয়ের মৃত্যুর পড়েই দিনেমারদের পরিচালনব্যবস্থা একটু একটু করে ভেঙে পড়ে। ১৮৩৫ সালের ১১ অক্টোবর গভর্নর পিটার হ্যানসেন ইংরেজদের কাছে তাঁদের কেনা সব সম্পত্তি মাত্র সাড়ে ১২ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন।
মনে রাখতে হবে শ্রীরামপুরে এই কর্মকাণ্ড যখন চলছে তখন নাকের ডগায় চন্দননগর-চুঁচুড়া সাজাচ্ছেন ওলন্দাজরা। এখান থেকে মূলত সোরা সংগ্রহ করত ডাচরা। আর সেই সঙ্গে আফিম পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হতো নদীপথ। ওলন্দাজরা বাংলার বাজারে বিক্রি করত তন্দন কাঠ, টিন, সিসা, মিশ্র ধাতু, নানারকম মশলা, গোলমরিচ। গঙ্গাবক্ষে তখন এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার-সকলেই এদেশ থেকে কী পরিমাণ নিয়েছে তা বুঝতে সম্পদ নির্গমণ তত্ত্বে চোখ রাখার দরকার নেই, শুধু এই নদী চলাচলের ইতিহাসটুকু বুঝতে পারলেই হবে। তবে যদি দেওয়ার কথা ওঠে, তবে বলতে হবে এই স্মারকগুলোর কথা, যা থেকে এই বিগত দিনের শতশত গল্পেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে আবার।
কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের চির-অবহেলা। সেই কারণেই দিনেমার-ওলন্দাজদের এমন অজস্র ইতিহাসের বীজ অবহেলায় পড়েছিল। পড়েই থাকত খয়াটে দেওয়াল, জীর্ণ কড়িকাঠ, লঝঝড়ে আসবাবে ভরা ইতিহাসের জিয়নকাঠি। কয়েক বছর আগে এগিয়ে আসে ডেনমার্কের জাতীয় মিউজিয়াম। এই রাজ্যের হেরিটেজ কমিশন এবং প্রশাসনের সঙ্গে একটি মৌ-স্বাক্ষরিত হয়। সেই অনুযায়ী শ্রীরামপুরে ড্যানিশ আমলের জীর্ণ স্থাপত্যগুলি সংস্কার শুরু হয় তাদেরই অর্থানুকূল্যে। স্থাপত্যগুলির চেহারা যেমন ছিল, অবিকল সেই আদলে সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ট্যাভার্ন সংস্কার আরম্ভ হয়েছিল ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর, কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। একই ভাবে নতুন করে সাজানো হয় গির্জাটিও।
করোনাকালে দীর্ঘসময় বন্ধ থাকার পরে সেই ড্যানিশ ট্যাভার্নই আবার একটু একটু করে ডানা মেলছে। এ সরাইখানায় পা রাখলেই শুরু হবে ইতিহাসের পক্ষীরাজে সফর। না, সেই ফ্রেডরিক্সনগর হয়তো আর নেই। কিন্তু স্মৃতিটুকু তো আছে, তাই বা কম কী!