হাজার বছরের পুরোনো দেশি টোটকা প্রাণ ফেরাচ্ছে জমির, পাঁচগুণ রোজগার করছেন বাংলার এই কৃষকরা!

বানিজ্যিক ভাবে প্রচলিত অজৈব সারের ব্যবহার বন্ধ করে, হাজার বছর আগের প্রাচীন প্রক্রিয়ায় তৈরি সারের উপর নির্ভরতা বাড়ানো শুরু করেছে দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানের কৃষকরা। এদিকে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ, এমনকী সুদূর দাক্ষিণাত্যে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি চাষীদেরও এক হাজার বছরের পুরোনো এই পদ্ধতিতে বানানো সার ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।  

মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানের অন্তত একশো কৃষক বর্তমানে ব্যবহার করছে এই সার। অত্যন্ত সাধারণ ও সহজলভ্য এই উপাদান সমূহ দিয়ে বানানো জৈব সারে কেবল ফলনই যে বাড়ছে এমন নয়,  শস্য ও ফল উৎপাদনকারী গাছের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর একাধিক কীট, ছত্রাক বা ব্যক্টিরিয়ার আক্রমণের হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাচ্ছে এই সার ব্যবহারের পরে।

আরও পড়ুন-হিতাহিত ভুলে একটানা ফোনের স্ক্রিনে চোখ, নিঃশব্দে মৃত্যুকে ডেকে আনছেন আপনি

এমন কী আছে সেই সারে? কী ভাবেই বা তৈরি করা হয় এটি? ফিরে যেতে হবে প্রায় এক হাজার বছর আগে, যখন বৃক্ষায়ুর্বেদ নামের গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছিলো মাছের উচ্ছিশটাংশ এবং প্রাণীদের দেহজাত বর্জ্য ও রেচনপদার্থের মিশ্রণে তৈরি কুনাপজালা নামে একটি জৈব সারের কথা।

এই জৈব সার কেবল চাষের জমির উর্বরতাই বৃদ্ধি করতো না, পাশাপাশি সহজে নির্মূল করা যায় না, এমন কীট, ছত্রাক এবং চাষের পক্ষে ক্ষতিকর অন্যান্য আণুবীক্ষণিক জীবকেও অতি দ্রুত নির্মূল করতে পারত। অথচ অজৈব সার প্রয়োগ করেও এদের নির্মূল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে এই সময় দাঁড়িয়েও।

আর তারপর সার নির্মাণের সেই পদ্ধতিকে পুণ:প্রচলন করেন স্বর্গীয় ড: ওয়াই এন নেনি। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী, যিনি পরবর্তীকালে এশিয়ান এগ্রি-হিস্ট্রি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

কী ভাবে সন্ধান পেলেন তিনি এই সারের? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকাগারে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন বৃক্ষায়ুর্বেদের খসড়ার একটি প্রতিলিপির। বইটি সংস্কৃতে লেখা। তারপর ১৯৯৬ সালে বইটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে পঠন-পাঠন শুরু করেন তিনি।জানা যায় কুনাপজালা নামের এই জৈবসার চারশত খ্রিস্টাব্দ থেকে সতেরোশো পঁচিশ খ্রিষ্টাব্দ অবধি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা ব্যবহার করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, এই সারের বিস্তৃত বিবরণ ও তার উপযোগীতা প্রসঙ্গে তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন গুরুকুলে শিক্ষা দেওয়া হত।

জি.বি.পন্ত ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচারাল টেকনোলজির অধ্যাপিকা ড: সুনীতা টি পান্ডের মতে, বর্তমান ভারতেও অনেক কৃষক এই জৈবসারটি তৈরি করতে মূল উপাদানই ব্যবহার করছেন আজও। তবে বেশ কিছু কৃষক মৃত প্রাণীদেহ মিশিযে সার বানাতে কুন্ঠা বোধ করেন, জানাচ্ছেন ড: পান্ডে।

চাষীদের স্বার্থে সেই সমস্যার সমাধান বাতলে দিয়েছিলেন স্বর্গীয় ড: নেনি নিজেই, সেই ২০১২ সালে। তিনি তাই এই সারের নিরামিষ রূপ তৈরি করেছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই বাদ পড়েছিলো মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ। প্রাণীদেহ থেকে নির্গত বর্জ্য ও রেচন পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করা হল গোরুর গোবর ও মূত্র। ঠিক যেমনটা আদিকাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। শুধু যোগ হল আরও কতগুলি সহজলভ্য নতুন উপাদান।  

কী কী সেই নতুন উপাদান? গুড়, অঙ্কুরিত কালো ছোলা, সরিষা বা নিমের তেল, খড় থেকে বেরোনো জল, খুব ছোটো ছোটো করে কাটা জমির আগাছা এবং জল। মিশ্রণের পদ্ধতি একই রাখা হল, যেমনটা বলা হয়েছিল মূল গ্রন্থে। জলের অনুপাতও একই রাখা হল। তারপর এই মিশ্রণে গেঁজিয়ে তোলা বা ফার্মেন্ট করার জন্যে ফেলে রাখা হত। সারটি সম্পূর্ণরূপে তৈরি হতে গ্রীষ্মকালে সময় লাগতো পনেরো দিনের কাছাকাছি। অন্যদিকে শীতকালে প্রয়োজন হত তিরিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ দিন।

এই জৈবসার ব্যবহারের ফল হাতেনাতে পেতে শুরু করলেন কৃষকেরা। শস্য-উৎপাদন্কারী গাছগুলির বৃদ্ধির হার বাড়লো। বাড়ল শস্যের পরিমাণ। পাশাপাশি শস্য-উৎপাদনকারী গাছগুলি বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুললো। মাটির গুণগত মানও বাড়ল উল্লেখযোগ্য ভাবে।

এমনকী বেশ কিছু চাষী, ভার্মিকোম্পোস্টের ব্যবহার ছেড়ে কুনাপজালার ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক উত্তরপ্রদেশের রঘুবীর সিংহের কথাই। ২০১৯ সালের পর থেকে ভার্মিকম্পোস্টের বদলে তিনি এই সারই ব্যবহার করছেন তাঁর চাষের জমিতে।

রঘুবীর সিং জানাচ্ছেন, এই সার ব্যবহারের পরেই তাঁর জমিতে ফলানো আখ বারো থেকে চোদ্দো ফুট উচ্চতা অবধি বৃদ্ধি পাচ্ছে, আগে যা দশ ফুটেই সীমাবদ্ধ ছিল। জানতে চাওয়া হল, তিনি আরও কোনো সার ব্যবহার করছেন কিনা। জানালেন ইউরিয়া বা ডিএপি, যা বিপুলভাবে চাষজমিতে ব্যবহার করেন অনেকেই, তার ব্যবহার তিনি তিন বছর আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন।

ড: এসপিএস বেনিওয়াল বেটার ইন্ডিয়া নামক ওয়েবসাইটকে জানিয়েছেন, এই সার ব্যবহারের পর চাষীদের চাষের খরচ হ্রাস পেয়েছে, উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চাষীদের আয় পাঁচগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ড: বেনিওয়াল জানাচ্ছেন, এই জৈব সার ব্যবহার করা হয়েছে ধান থেকে শুরু করে  টম্যাটো, বেগুন, কুমড়োর মত একাধিক সবজি উৎপাদনের জন্যে। এমনকি ব্যবহার করা হয়েছে পিচ এবং কিউইর মত দামী ফল ফলাতেও। এতে পিচের ফলন বেড়েছে পাঁচগুণ, আর কিউইর ফলন বেড়েছে দশগুণ।

চাষীরা যদি বানানোর কথা ভাবেন এই সার কোন অণুপাতে মেশাবেন উপাদানগুলি?

এর জন্যে প্রয়োজন পনেরো থেকে কুড়ি কিলো গোবর, পনেরো থেকে কুড়ি লিটার গোমূত্র, পচা গুড় দুই কিলো, অঙ্কুরিত কালো ছোলা দুই কিলো, সরিষা বা নিমের কেক দুই কিলো, স্থানীয় আগাছা কুড়ি কিলো, এবং সব শেষে দশ থেকে কুড়ি লিটার জল।

আগাছার সাথে মেশাতে পারেন নিমপাতা, এতে রয়েছে কীটনাশের ক্ষমতা। এছাড়াও মেশানো যেতে পারে খড় থেকে বেরোনো জল, এক লিটার দুধ বা পনেরো থেকে সাতদিনের বাসি ছানার জল।

তবে জানানো হচ্ছে, গেঁজিয়ে তোলার পরে, সারটিকে জমিতে দেওয়ার পূর্বে কাপড় দিয়ে পরিশ্রুত করে, কেবল জলীয় অংশটি ব্যবহার করতে।

More Articles