বস্তি থেকে সুদূর আমেরিকায়, ফুল বিক্রেতার মেয়ের অসাধ্যসাধন

"ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সিদ্ধান্ত নিই", জানিয়েছেন সারিতা।

কতটা কষ্ট করলে একটা মানুষ বস্তির ঘর থেকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যেতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে অজানা ঠেকলেও সারিতা নিজের জীবন দিয়ে খুঁজেছেন এই উত্তর। আর খুঁজেও পেয়েছেন। রাস্তার সিগনালে ফুল বেচে, টিউশন পড়িয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেবেন সারিতা। একদম শূন্য থেকে আকাশ ছোঁয়ার সমার্থক সারিতার জীবন। শুনতে ভালো লাগলেও ততটাই কষ্ট করেছেন এই মেয়ে। শ্রম, ঘাম, লেগে থাকার ভীষণ জেদ ছাড়া কোনও ক্ষেত্রেই সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। ২৮ বছর বয়সি সারিতা সমাজের কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁর সাফল্য প্রমাণ করে দেয় যে, জীবনের কোনও বাধাই আদতে একজনকে পিছিয়ে দিতে পারে না। তাঁর ইচ্ছাশক্তিই আসল।

 

সারিতার ছোটবেলা
মুম্বইয়ের ঘাটকোপার এলাকার বস্তিতে বড় হয়েছেন সারিতা। এলাকারই সরকারি স্কুলে পড়তেন এবং বাবার সঙ্গে ফুলের মালা গাঁথতেন ছোট্ট সারিতা। উৎসবের দিনগুলিতে যেমন দিওয়ালি, গণেশপুজোতে বাবার সঙ্গে রাস্তায় ফুল বেচে কাটাতে হতো সারাদিন। স্কুলের সময় থেকে কলেজ একইভাবে রাস্তায় সিগনালে মালা বেচতেন সারিতা। ছ'জনের পরিবারে তাঁর বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। পরিবারে মা-বাবা ছাড়া এক বড় দিদি এবং দুই ছোট ভাই-বোন রয়েছে তাঁর। করোনার সময়ে লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে গেলে সারিতার বাবাকে পেট চালাতে তাঁদের দেশের বাড়ি বদলাপুর ফিরে যেতে হয়েছিল।

সংবাদ সংস্থাকে সারিতা বলেছেন, "আমি মনে করি সকলের জীবনেই চড়াই-উতরাই রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে সংঘর্ষ করেন জীবনে। আপনি কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করছেন এবং কোথায় বেড়ে উঠছেন, তার ওপর নির্ভর করে আপনার সংঘর্ষের কথা। দুর্ভাগ্যবশত আমি যে সমাজে বড় হয়েছি সেখানে সমস্যাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।"

আরও পড়ুন: এমবিএ করে চায়ের দোকান! এই ‘চা-ওয়ালা’ এখন দেশের অনুপ্রেরণা

জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
২০১০ সালে এক আত্মীয়ের কাছে প্রথম জেএনইউ-র নাম শোনেন সারিতা। সেই আত্মীয়র কাছেই তিনি জানতে পারেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার যে ঢোকেন সে জীবনে সাফল্য লাভ করেই বেরোয়। এই কথাই মাথায় গেঁথে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়ের। কিন্তু তখন জানতেনই না, জেএনইউ কী? কলেজে পড়ার প্রথম বছর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সারিতা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সুযোগও আসে ভর্তির। ওবিসি কোটায় শেষ প্রার্থী হিসেবে স্নাতকোত্তর স্তরে হিন্দি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয় সারিতা। তিনি মনে করেন যে, জেএনইউ তাঁর জীবনের বাঁক বদলে দিয়েছে। তাঁর মতে, "স্নাতকোত্তর স্তরে জেএনইউতে ভর্তি হওয়াই আমার জীবন বদলে দেয়। আমি জানি না, ওখানে না ভর্তি হলে আমি এখন কী করতাম। জেএনইউ-র মতো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মতো সমাজের এই অংশ থেকে উঠে আসা পড়ুয়াদের কাছে আশার আলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাকে শিখিয়েছে যে, তুমি ছেঁড়া জামাকাপড়ে রাস্তায় বসেও পড়তে পারো। সর্বোপরি আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছে জেএনইউ।"

সারিতার গলায় আরও শোনা গেল, "আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে একটা স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি‌। কিন্তু আমার এখনও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। পিছনে ফিরে তাকালে নিজেই নিজের এই সফরের কথা বিশ্বাস করে উঠতে পারি না।" পাশাপাশি তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন, যেন আরও এমন পাবলিক ফান্ডেড বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে সরকার। এর ফলে গরিব, মেধাবী পড়ুয়ারা পড়ার সুযোগ পাবে।

সারিতা এমফিল পাস করে জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডির জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কণিষ্ঠ গবেষকদের অন্যতম সারিতা। মাত্র ২২ বছর বয়সে এমফিলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারে পিএইচডি করছেন এই মেয়ে। এরই মাঝে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ-সহ পিএইচডি সুযোগ পেয়েছেন সারিতা। বিদেশের মাটিতে তিনি 'ভক্তিযুগের সাবঅলটার্ন মহিলাদের লেখনী' নিয়ে গবেষণা করবেন। যে দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন, দু'টিতেই ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন সারিতা। অন্য আরেকটি হল ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়। "ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সিদ্ধান্ত নিই", জানিয়েছেন সারিতা।

ছোট থেকেই বড় স্বপ্ন দেখতেন সারিতা। একজন ফুল বিক্রেতার মেয়ে হয়ে বড় স্বপ্ন দেখলে তার পরিণতি যে স্বপ্নভঙ্গ, একথা ভেবে শঙ্কিত হতেন সারিতার মা। মেয়ে বলছেন, "তাঁর বাবা জেএনইউয়ের পুরো নামই জানেন না এখনও। তবে বাবা কখনও বাধা দেননি। বরং বলেছেন, আমরা কিছু বুঝি না, কিন্তু তুমি যে পথে চলেছ আমি তোমাকে ভরসা করি। কঠোর পরিশ্রম করো ঠিক সফল হবে।" বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছেন সারিতা। বুঝিয়ে দিয়েছেন, বস্তিতে থেকেও বিদেশের স্বপ্ন দেখা যায়। শুধু পরিশ্রম করতে হয় তাকে বাস্তব রূপ দিতে।

 

More Articles