কখনও ফোর্ড স্ট্রিট, কখনও স্পিক স্ট্রিট, জানেন কি বর্তমানে কী নাম ঐতিহাসিক এই রাস্তার?

Sadar Street : কালক্রমে প্রথমে পিটার স্পিকের বাড়ি, তারপর আদালত, তারপর জাদুঘরের সুপারিনটেনডেন্টের কোয়ার্টার এবং বর্তমানে জাদুঘরের ট্রাস্টিদের অফিস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বৌদি কাদম্বরী দেবী কিছু সময়ের জন্য সদর স্ট্রিটের একটি বাড়িতে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সেই বাড়িতে থাকাকালীন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল যা আমরা তার রচিত জীবনস্মৃতি থেকে জানতে পারি। একদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ সদর স্ট্রিটের সেই বাড়িতে দাঁড়িয়ে ফ্রি স্কুলের বাগানের দিকে তাকিয়েছিলেন। গাছের পাতার মধ্যে থেকে উদীয়মান সূর্যের আলো যেন তার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই দৃশ্য দেখে তার মনে হয়েছিল যে এক অপরূপ মহিমায় বিশ্ব সংসার সমাচ্ছন্ন। জগতে সর্বত্র যেন এক সৌন্দর্য্য এবং আনন্দ তরঙ্গায়িত হয়েছে। সেই দৃশ্য দেখার পরে সারা দুপুর এবং বিকেল অতিবাহিত করে তিনি লিখে ফেলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ফ্রি স্কুলের বাগানের দৃশ্য দেখে তার মনের যে অবস্থা উপস্থিত হয়েছিল, তিনি আশা করেছিলেন হিমালয়ের চূড়া থেকে একইরকম দৃশ্য দেখলে তার মনের একই অবস্থা উপস্থিত হবে। যদিও পাহাড়ে পৌঁছে তিনি বুঝেছিলেন, পাহাড়ের তুলনায় তুচ্ছ সেই বাগানের দৃশ্যের আসলে জয় হয়েছে।

সদর স্ট্রিট, পুরনো কলকাতার নিরিখে ফোর্ড স্ট্রিট অথবা স্পিক স্ট্রিট। কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘরের পাশের এই রাস্তার সব নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ইতিহাস। বর্তমানে যেখানে সদর স্ট্রিট, পুরনো কলকাতার সেই রাস্তায় একটি বাড়িতে থাকতেন উইলিয়াম ফোর্ড। সেই থেকেই এই রাস্তা নিজের প্রথম নামে অর্থাৎ ফোর্ড স্ট্রিট নাম পেয়েছিল। উইলিয়াম ফোর্ডের এবং সদর স্ট্রিটের পুরনো নামের সাক্ষী হিসাবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর বাড়ি। সদর স্ট্রিটে যাওয়া বহু মানুষ এই বাড়িটি চেনে। যদিও সেই বাড়িটাকে উইলিয়াম ফোর্ডের বাড়ি হিসাবে চেনার থেকে মানুষ চেনে ফেয়ার লন হোটেল হিসাবে। সারা বছর কলকাতায় ঘুরতে আসা কিছু মানুষের থাকার জায়গা, ক্রিসমাস এবং ইংরেজির নতুন বছর উদযাপনের জায়গা হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে উইলিয়াম ফোর্ডের বাড়ি।

আরও পড়ুন - হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা

ইংরেজ কোম্পানির শাসনের সময়ে গভর্নর কাউন্সিল ছিলেন পিটার স্পিক। তিনিও এই সদর স্ট্রিট এলাকায় থাকতেন। তাঁর বাড়িটা আজও রয়ে গিয়েছে যদিও সেখানে সকলের প্রবেশের অনুমতি নেই। ভারতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টিদের বর্তমান অফিস ছিল পিটার স্পিকের বাড়ি। তাঁর নাম থেকেই ফোর্ড স্ট্রিট নিজের নতুন নাম পায়। কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে নতুন নাম হয় স্পিক স্ট্রিট। যদিও এই নাম খুবই অল্প সময়ের জন্য বজায় ছিল। পিটার স্পিকের বাড়ি বর্তমান অবস্থায় পৌঁছনোর মধ্যবর্তী সময় স্পিক স্ট্রিটের নাম পরিবর্তনের জন্য দায়ী। কলকাতার বাইরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারীদের জন্য কলকাতায় মামলা মোকদ্দমা করার সুবিধার্থে পিটার স্পিকের বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল সদর দেওয়ানী আদালত। সময়ের সঙ্গে মানুষের মুখে মুখে স্পিক স্ট্রিট পেয়েছিল তার নতুন নাম। সেই সদর আদালতের কারণেই তার নাম হয়েছিল সদর স্ট্রিট। কালক্রমে প্রথমে পিটার স্পিকের বাড়ি, তারপর আদালত, তারপর জাদুঘরের সুপারিনটেনডেন্টের কোয়ার্টার এবং বর্তমানে জাদুঘরের ট্রাস্টিদের অফিস। বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে পরিবর্তনের সঙ্গেই রাস্তাও পেয়েছে তার বিভিন্ন নাম।

এই সদর স্ট্রিটেই রয়েছে আরও একটি বাড়ি যার সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জড়িয়ে আছে। যেই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বৌদি কাদম্বরী দেবী কিছু সময়ের জন্য থাকতেন, যেই বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, সেই বাড়িটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তার পরিচয় বদলে গিয়েছে। ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটের সেই বাড়িটা রূপ বদলে আজ একটা হোটেল। তার একতলায় রয়েছে বহু দোকান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা মূর্তি এই হোটেলের বিপরীতে স্থাপিত রয়েছে। তার নীচে কয়েকটি লাইনে জানানো হয়েছে যে, এই বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। হোটেলের আবাসিকদের কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতার দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণের পরিকল্পনার মাঝে অথবা দোকানের কর্মীদের নিত্যদিনের কাজের মাঝে হয়তো ফিকে হয়ে গিয়েছে সেই ইতিহাস। অনেকেই হয়তো অনুভব করতে পারে না যে একদিন এই বাড়িতেই ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি। এই বাড়ি থেকেই তিনি দেখেছিলেন ফ্রি স্কুলের সেই বাগান, গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে উদীয়মান সূর্যের আলো। সেই দৃশ্য দেখেই তার মনে জেগেছিল অসামান্য অনুভূতি যা তিনি পাহাড়ের মাথা থেকেও খুঁজে পাননি। আজও কি কেউ সেই হোটেল থেকে একইভাবে কোনও দিনের সূর্যোদয় দেখে? কারোর মনে কি আসে সেই অসামান্য অনুভূতি? হয়তো না। মানুষ এখন বড়ই ব্যস্ত। আমাদের সময়ের খুবই অভাব। হয়তো আজও উদীয়মান সূর্যের আলোর ছোঁয়া লাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তির মুখে। হয়তো এইভাবেই বছরের পর বছর একটি মূর্তি, দুটি হোটেল এবং একটা অফিস কলকাতার এক পরিচিত রাস্তার ইতিহাস আগলে দাঁড়িয়ে থাকে।


তথ্য ঋণ : গল্প হলেও সত্যি (ইউটিউব ), গেট বেঙ্গল, জীবনস্মৃতি, সদর স্ট্রিটের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি।

More Articles