বাংলা থেকে তেলেঙ্গানা, কেমন আছে বিধবা গ্রামগুলি

তেলেঙ্গানার ছোট্ট গ্রাম পেদ্দাকুন্দা। আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বের আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই এই গ্রামের।সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর গ্রামের পুরুষরা কেউ ফলান ধান কেউ বা গম।মহিলারা ব্যস্ত থাকেন তাদের নিত্যদিনের ঘরকন্নার কাজে।নিতান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন।২০০৬ সালের আগে তেমনভাবে কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসেওনি  পেদ্দাকুন্দা।তারপরেই হঠাৎ পটপরিবর্তন, মিডিয়ার সমস্ত স্পটলাইট পড়ল অখ্যাত গ্রাম পেদ্দাকুন্দাতে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটি রাস্তা।হ্যাঁ চমকে ওঠার মতোই ঘটনা বটে নিছক একটি রাস্তার জন্যেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে তেলেঙ্গানার এই গ্রাম।তবে মিডিয়ার আলো, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা এসবের মধ্যেও পেদ্দাকুন্দাকে ঘিরে আছে অদ্ভুত এক বিষাদ,এখনও প্রায়ই প্রিয়জন হারানোর শোকে পেদ্দাকুন্দার আকাশ - বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

২০০৬ সালে এই গ্রামের উপর দিয়েই নির্মিত হয় একটি হাইওয়ে।এরপর থেকে এই হাইওয়ের উপর একের পর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় চল্লিশজন পুরুষ,আশ্চর্যের কথা তারা সবাই পেড্ডাকুন্দা গ্রামেরই অধিবাসী।

একটি রাস্তা যা সাক্ষী হয়ে আছে আধুনিকতার সেই রাস্তায় ছিনিয়ে নিয়েছে একের পর এক তরতাজা প্রাণ।কেউ হারিয়েছেন স্বামী কেউ বা সন্তান কেউ হয়তো হারিয়েছেন আরও কোন প্রিয়জনকে।আর এই কারণেই তেলেঙ্গানার পেদ্দাকুন্দা এখন পরিচিত বিধবাদের গ্রাম হিসেবে।

আরও পড়ুন-ভারতীয়দের নির্বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত কলকাতার এই রাস্তায়

ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণ হারান প্রায় দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার মানুষ আর এরমধ্যে প্রতিবছর খবরের শিরোনামে থাকে পেদ্দাকুন্দা, কিন্তু এতকিছুর পরেও বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা যায় না সরকারের। প্রিয়জন হারানোর কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হারিয়ে যায় বারংবার।

সুন্দরবন। হ্যাঁ এখানেও আছে এমন এক গ্রাম, এক – দুজন নয় এখানে বাস করেন প্রায় শতাধিক বিধবা। অবশ্য একটু ভুল বলা হল – একটি নয়, সমগ্র সুন্দরবনে প্রায় এগারোটি বিধবা গ্রামের খোঁজ মেলে। আর গ্রামের মধ্যে বিধবা পাড়া? তার তো ইয়ত্তা নেই বললেই চলে। কথায় বলে – যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। কথাটি যেন সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। প্রান হাতে করেই চলে তাদের রোজকার দিনযাপন। সামান্য সতর্কতার অভাব তাদের ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুমুখে। হিঙ্গলগঞ্জ, বাসন্তী, পাথরপ্রতিমা সহ বেশ কিছু অঞ্চলের গৃহবধূরা তাই এখন রাতের পর রাত আতঙ্কে দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। ভয় একটাই – সংসারের একমাত্র মানুষটা যদি পরিনত হয় দক্ষিনরায়ের শিকারে! বনবিবি যে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে নারাজ। ফলশ্রুতি – ঘুমহীন রাতের সংখ্যা বেড়ে চলে প্রতিনিয়ত। দিন কাটে কাছের মানুষটা ঘরে ফেরার অনন্ত অপেক্ষাকে পুঁজি করে।

এরপর চলে যাওয়া যাক পিরামিডের দেশ মিশরে। মিশরের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত 'সামহা ' নামের একটি গ্রাম।কায়রো থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি।তবে অন্যান্য আর পাঁচটা গ্রামের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা ' সামহা।' এই গ্রামেও থাকেন না কোন পুরুষ।তবে তেলেঙ্গানার পেদ্দাকুন্দার মত এই গ্রামের পুরুষ অধিবাসীরা মারা যাননি কোন দুর্ঘটনায়,তারপরেও ব্যতিক্রমী সত্ত্বা বহন করে চলে ' সামহা।' কারণ এই গ্রামে সেইসব মহিলারা থাকার অনুমতি পান যারা বিধবা অথবা বিবাহ - বিচ্ছিনা।সুতরাং তেলেঙ্গানার পেদ্দাকুন্দার মতোই মিশরের সামহা গ্রামও পরিচিত বিধবাদের গ্রাম হিসেবেই। গ্রামের ত্রিসীমানায় কোনো বিবাহিত মহিলা অথবা পুরুষের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

মিশরের সমাজ এখনও প্রবল পুরুষতান্ত্রিক।ফলে বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলাদের দায়ভার নিতে রাজি হয় না কেউই,আর এর ফলেই সামহা গ্রামে একপ্রকার নির্বাসনে পাঠানো হয় এইসমস্ত মহিলাদের।

তবে অন্ধ হয়ে বসে নেই মিশর সরকার।সমাজের ঘাড় থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা নামক ভূতকে নামতে তারা যেমন সচেষ্ট তেমনি সচেষ্ট সামহা গ্রামের মহিলাদের উন্নতিকল্পে।কিছুদিন আগেও মিশর সরকারের পক্ষ থেকে এইসমস্ত মহিলাদের জন্য বিলি করা হয়েছে জমি তবে সেক্ষেত্রে একটি মাত্র শর্তপূরণ করতে হয় এই মহিলাদের,যে সমস্ত মহিলারা পনের বছর বা তার বেশি সময় ধরে সামহা গ্রামে থাকছেন তারাই পেয়েছেন প্রায় ছ'শ একর জমির মালিকানা।এখানেই শেষ নয়,এইসমস্ত মহিলাদের অনেকের সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্বও গ্রহণ করেছে মিশর সরকার।

তেলেঙ্গানার পেদ্দাকুন্দা থেকে  সামহা বিধবাদের হাত ধরে কোথাও যেন বারংবার এক হয়ে যায় ভারত অথবা বালির শহর মিশর।আবার সরকারের সহযোগিতায় একদল যখন স্বপ্ন দেখে নতুনভাবে বাঁচার ঠিক একই সময়ে অন্যদল লুকিয়ে ফেরে তাদের অব্যক্ত যন্ত্রণার ইতিকথা।

তথ্যঋণ:

প্রথম আলো
ডেইলি বাংলাদেশ

More Articles