ভারতীয়দের নির্বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত কলকাতার এই রাস্তায়
যে সময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা, এই গল্প সেই সময়ের। সেই কলকাতার বুকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার প্রচলন ছিল বললে অনেকেই চমকে উঠবেন, কিন্তু বাস্তব ছিল তেমনই। রাজভবনের অদূরেই অবস্থিত একটা গলি, ওয়েলেসলি প্লেস থেকে সোজা চলে গেছে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটের দিকে। কল্লোলিনী তিলোত্তমার সমস্ত ব্যস্ততা যেন এক লহমায় থমকে গেছে এই গলির মধ্যে। ব্যস্ত অফিসটাইম হোক বা মনখারাপ করা বিকেল– এই গলিজুড়ে সবসময় বিরাজ করে একরাশ অদ্ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। সময়ও যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে এখানে, কলকাতার মধ্যে থেকেও যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থেকে গেছে ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত এই গলিটা, যার বর্তমান নাম পান্নালাল সরণি।
তবে কল্লোলিনী তিলোত্তমার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা এই গলির ইতিউতি ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। ব্রিটিশ সূর্য তখনও মধ্যগগনে। বেশিরভাগ দেশেই গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। এক সময় তাদের নজর পড়ল ভারতের মাটিতে। সাবর্ণ চৌধুরীদের থেকে একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে কিনে নেয় সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা নামের তিনটি গ্রাম। কোম্পানির লক্ষ্য ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল বিস্তার। ফলে, ব্রিটিশদের হাতে পড়ে কিছুদিনের ভোল বদলাতে শুরু করল কলকাতা। অন্যদিকে, কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারল হুগলি নদীর তীরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল প্রতিবন্ধকতা লুঠতরাজ এবং জলদস্যুর প্রকোপ। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আনল কড়া আইন। তবে সেই আইন যে শুধু দুষ্কৃতীদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হত এমন নয়, বহু সাধারণ মানুষের প্রাণ যেত এই সর্বনেশে কানুনের কালো ফাঁদে। এমনকী, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রেও ধার্য করা হত মৃত্যুদণ্ড।
ব্রিটিশ শাসন ভারতের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় জমিদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই জমিদারদের মাধ্যমেই অনেক ক্ষেত্রে ঠিক করা হত শাস্তির নিদান। আর ঠিক এই ক্ষেত্রেই কলকাতার পান্নালাল সরণি উঠে আসে ইতিহাসের পাতায়। এই পান্নালাল সরণি আগে পরিচিত ছিল ফ্যান্সি লেন নামে। তবে শৌখিনতা নয়, ফাঁসি দেওয়া থেকেই কলকাতার এই রাস্তার নাম হয়ে ওঠে ফ্যান্সি লেন। এর উল্লেখ আমরা পেয়েছি ফেলুদার গল্পেও।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। ব্রজমোহন নামক প্রথম একজনের ফাঁসি হয় এই ফ্যান্সি লেনে। কিন্তু তার অপরাধ কী ছিল?সে নাকি অভিযুক্ত ছিল ঘড়ি চুরির অপরাধে, সেই সময়ে যে ঘড়ির দাম নির্ধারণ করা হয় মাত্র পঁচিশ টাকা।অর্থাৎ পঁচিশ টাকার মূল্য ব্রজমোহনকে চোকাতে হল তার প্রাণ দিয়ে। ফাঁসির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ফ্যান্সি লেনের মধ্যে থাকা বড় গাছকে। তবে সেই সময় যে শুধুমাত্র ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত, তা নয়, তোপ দেগেও হত্যা করা হত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের। যে শাস্তির নিদান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতেন দেশীয় জমিদাররা। রীতিমতো সালিশি সভা বসিয়ে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করা হত অপরাধীদের। এখানেই শেষ নয়, ফ্যান্সি স্ট্রিটে ফাঁসি দিয়ে বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা হত সেই মৃতদেহ।শাস্তির বহর দেখে অন্য কেউ যাতে সেই অপরাধ করতে সাহস না পায়, তার ব্যবস্থা আর কী। পরবর্তীকালে কোম্পানির লোকেরা ফাঁসির আগে থেকেই প্রচার করত ফাঁসির দিনক্ষণ। ফলে ফাঁসির দিন জনতার ঢল নামত কল্লোলিনী তিলোত্তমার রাস্তায়। এরও পরে ওল্ড কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটে আলাদাভাবে তৈরি হয় ফাঁসির মঞ্চ, এবং এরপরই ফাঁসি দেওয়ার পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
শহর কলকাতাও কোনও একসময় সাক্ষী ছিল এমন মধ্যযুগীয় প্রথার, যেখানে প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সাদা চামড়ার ইংরেজ অথবা তাদের চাটুকারদের জন্য এই আইন কোনওদিনই বলবৎ হত না। আইনের বাড়বাড়ন্ত দেখা যেত শুধুমাত্র কালো চামড়ার ‘নেটিভ’-দের ক্ষেত্রে। ইংরেজরা ' ফাঁসি ' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারত না, ফলে কিছুটা বিকৃত হয়ে রাজভবনের সামনের এই রাস্তার নাম হয় 'ফ্যান্সি স্ট্রিট'।
তথ্যসূত্র: 'কলকাতা'–শ্রীপান্থ
বর্তমান পত্রিকা, ১ অক্টোবর ২০২০
আনন্দবাজার পত্রিকা