ভাত জোটানোর লড়াই! জলেই জীবন কেটে গেল ৭৭ বছরের বৃদ্ধার

পরিবেশ, বয়স, অভাব- নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়েই বেঁচে থাকেন গোবিন্দাম্মা। দু'মুঠো অন্নের সংস্থানের জন্য লড়ে যেতে হয় তাঁকে।

 

চেন্নাইয়ের এন্নোর অঞ্চলের ঠিক মাঝবরাবর বয়ে চলেছে দু'টি নদী। কোসস্তালাইয়ার এবং আরানিয়ার নদী। বহু পরে ব্রিটিশ শাসনকালে নদীগুলির নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য খনন করা হয় একটি খাল। নাম বাকিংহাম ক্যানাল। এই দুই নদী ও বাকিংহাম খালের সঙ্গেই জড়িয়ে এক ৭৭ বছর বয়সি বৃদ্ধার জীবন ও রোজগার। সম্প্রতি পি সাইনাথ সম্পাদিত 'পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া'-য় উঠে এসেছে এই মর্মান্তিক কাহিনি।

সেই কোন ছোটবেলা থেকে আজও তামিলনাড়ুর এক ছোট্ট জনপদে চিংড়ি ধরে পেট চালাচ্ছেন গোবিন্দাম্মা। বয়সের ভারে আর শরীর চলে না। তবুও অন্নের সংস্থানে বৃদ্ধাকে নামতে হয় জলে। এত বছর ধরে চিংড়ি ধরতে ধরতে হাতে অজস্র কাটাছেঁড়া দাগ। আক্ষেপ করে গোবিন্দাম্মা বলেন, "বালি খুঁড়ে খুঁড়ে চিংড়ি ধরতে হয়। এই বুড়ো বয়সে এসে আর জাল ফেলে চিংড়ি ধরার সামর্থ আমার নেই। ২০০ টাকা রোজগারের জন্য হাত দুটো ফালা ফালা হয়ে যায়।"

কোসস্তালাইয়ার নদীর দুই পাশে ম্যানগ্রোভের বাদাবন নিয়ে গিয়ে মেশে পাড়াভেরকডু হ্রদে। এই ২৭ কিলোমিটার লম্বা নদীপথে মেলে অজস্র প্রজাতির চিংড়ি। এই নদীর আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই জীবিকা মাছ ধরা। এখানেই প্রতিদিন মাছ ধরতে আসেন ৭৭ বছরের গোবিন্দাম্মা। অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে নদীবক্ষের বালিতে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে চিংড়ি ধরেন। তারপর সেগুলি জমা হয় কোমরে বাঁধা একটি তালপাতার থলিতে।

আরও পড়ুন: কালিম্পং থেকে সুইজারল্যান্ড, গানের ভেলায় চেপে ভুবনজয় বাংলার পড়ুয়াদের

ইরুলার তফিশিলি সম্প্রদায়ের সদস্য গোবিন্দাম্মা প্রথম দিকে থাকতেন চেন্নাইয়ের কামরাজার বন্দরের দিকে। সেখান থেকে খুব সহজেই নিকটবর্তী কোসস্তালাইয়ার নদীতে চিংড়ি মাছ ধরতে যেতেন গোবিন্দাম্মা। কিন্তু ২০০৪ সালের বিধ্বংসী সুনামি সবটা তছনছ করে দেয়।সুনামির দাপটে ভেসে যায় তার কুঁড়েঘর। তার পরের বছরই নিজের যেটুকু সহায়সম্বল রক্ষা করতে পেরেছিলেন, তাই নিয়ে চলে যান ১০ কিলোমিটার দূরের থিরুভাল্লুর জেলার আথিপাটটু শহরে। সুনামিতে ইরুলার জাতির যে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশের ঠাঁই হয় অরুনোদ্যয়ম নগর, নেসা নগর ও মারিয়াম্মা নগরে।

গোবিন্দাম্মা থাকেন অরুনোদ্যয়ম নগরে। সুনামি-পরবর্তী সময় যে ঘরে স্থান পেয়েছিলেন গোবিন্দাম্মা, নাতনির বিয়ের পর সেই ঘরটাও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে গোবিন্দাম্মার বাসস্থান একটি নিমগাছের তলায়। রোজ ভোর ৫টায় দিন শুরু হয় গোবিন্দাম্মার। ঘুম থেকে উঠেই দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দেন আথিপাট্টু স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে দু'টি স্টেশন পেরিয়ে আম্মা নামেন পুরুনগর স্টেশনে। সেখান থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে আসেন আবার কামরাজার বন্দরের কাছে। এখানে এসেই মাছ ধরার কাজে লেগে পড়েন গোবিন্দাম্মা। কিন্তু এখন আর এই রোজের ধকল শরীর নিতে পারে না। চোখে প্রায়ই ঝাপসা দেখতে পান।

গোবিন্দাম্মা আক্ষেপের সুরে বলেন, "এত ধকলের পর যদি ২০০ টাকার বেশি না জোটে, কেমন করে পেট চালাব! কোনও কোনওদিন কপাল ভালো থাকলে ৫০০ টাকা রোজগার হয়, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই ১০০ টাকা রোজগার করতে দম বেরিয়ে যায়।" চোখে ভালো জ্যোতি না থাকলেও আন্দাজে চিংড়ি ধরতে ওস্তাদ গোবিন্দাম্মা। দীর্ঘ এত বছরের অভ্যেস তাঁকে শিখিয়েছে মাছ ধরার অব্যর্থ কৌশল।

গোবিন্দাম্মার স্বামী খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। তখন থেকেই এক ছেলে ও এক মেয়ের দায়ভার এসে পড়ে আম্মার কাঁধে। চিংড়ি মাছ ধরে হাটে বেচে বেচেই ছেলে ও মেয়েকে মানুষ করেছেন আম্মা। বিয়ে দিয়েছেন তাঁদের। গোবিন্দাম্মার রুটিরুজির ওপরেও থাবা বসিয়েছে উন্নয়ন। বাকিংহাম খালে এসে মেশে এন্নোর অঞ্চলের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির আবর্জনা। এছাড়াও রয়েছে আরও বিভিন্ন পেট্রো-কেমিক্যাল শিল্প ও সারের কারখানা। এইসব কারখানার বর্জ্যের ছাপে নদীগুলির অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে উঠছে দিন দিন। কমছে জলজ সম্পদও। উন্নয়নের ছাপে নদীগুলির এই পরিণতি দেখে গোবিন্দাম্মা চিন্তিত গলায় বলেন, "এককালে মুষলধারে বৃষ্টি নামলে প্রচুর চিংড়ি মিলত নদীতে। এখন তার অর্ধেকও মেলে না। বর্ষাকালে যাহবা কিছু বেশি পরিমাণ চিংড়ি মেলে, অন্য সময় চিংড়ি খুঁজে পেতে পেতেই বেলা গড়িয়ে যায়।"

পরিবেশ, বয়স, অভাব- নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়েই বেঁচে থাকেন গোবিন্দাম্মা। দু'মুঠো অন্নের সংস্থানের জন্য লড়ে যেতে হয় তাঁকে।

 

More Articles