কালিম্পং থেকে সুইজারল্যান্ড, গানের ভেলায় চেপে ভুবনজয় বাংলার পড়ুয়াদের

এই আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসবে সমগ্র ভারত থেকে এই একটি দলই নির্বাচিত হয়েছে। এক অর্থে ইতিহাস গড়তে চলেছে দলটি।

বাসেল ট্যাটু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিলিটারি সংগীত উৎসবগুলির মধ্যে একটি। সারা পৃথিবী থেকে নানা মিলিটারি ব্যান্ড এখানে গানবাজনা করতে আসে। সেই মঞ্চে এবার জায়গা করে নিল পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং। হিমালয়ের কোলে কালিম্পং-এর 'কুমুদিনী হোমস্‌' নামক একটি জনাএকুশের গানবাজনার দল সরাসরি ডাক পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের বাসেল ট্যাটু থেকে। পৃথিবীর সামনে সমগ্র ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবে বঙ্গের উত্তরাঞ্চল। বাংলা তথা ভারতবাসীর কাছে এটি বড় গর্বের বিষয়।

এই আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসবে সমগ্র ভারত থেকে এই একটি দলই নির্বাচিত হয়েছে। এক অর্থে ইতিহাস গড়তে চলেছে দলটি। দলটি এবং তাদের শিক্ষক প্রিয়দর্শী লামাকে সুইস ফেডেরাল ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স, সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড স্পোর্টস-এর তরফ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাসেল ট্যাটু-র উদ্যোক্তা তারা। স্কুল ব্যান্ডটির বয়স ৬০ বছর। ওই অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ব্যান্ডটি।

সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার পথও খুব মসৃণ ছিল না। একবার ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ফের টিকিট কাটতে হয়েছে তাদের। “এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না… নিজেকে চিমটি কেটে দেখছি বারবার। ভারতেরই কত শহর ঘুরিনি, আর সেই আমি কিনা বিদেশে অনুষ্ঠান করব! স্বপ্নের মতো লাগছে ব্যাপারটা,” বললেন বছর সতেরোর শুভম। শুভম ছেত্রী। স্কুল ব্যান্ডে পাইপ বাজান তিনি। রাইন নদীর তীরে প্রাগাধুনিক এবং আধুনিক স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে। সেই শহরের নাম বাসেল। বর্তমানে বাসেলে পৌঁছে গিয়েছেন শুভম। শুভমের বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, থাকেন কালিম্পং-এর নোক ডারা গ্রামে। “আমরা গরীব মানুষ। ছেলে আমার সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠান করছে এটি খুবই গর্বের বিষয়। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ত, তখন থেকেই শিখছে ও। একটা ট্রলিব্যাগ কিনে দিতে হলো, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে পাঠালাম, যদি হঠাৎ করে দরকার পড়ে। এখন তো আমাদের গ্রামের সব বাচ্চাই বলছে বাদ্যযন্ত্র শিখবে। সত্যি বলতে কি, সুইজারল্যান্ড দেখতে কে না চায়!” বলেছেন তাঁর বাবা রোহিত রুফাস ছেত্রী।

আরও পড়ুন: পুড়ে খাক জঙ্গল, মরছে বন্যপ্রাণী! কী কারণে ছারখার হিমাচল প্রদেশের প্রকৃতি?

শুধু শুভম কেন, সাবিন রাই, সেও শুভমের সমবয়সি। সে ব্যান্ডে ব্যাগপাইপ বাজায়। যাওয়ার আনন্দে বেশ কয়েক রাত ঘুম আসেনি তারও। “বিদেশে আসা নিয়ে উত্তেজিত ছিলাম ঠিকই, কিন্তু এখানে এসে দেখছি আমাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো স্কটল্যান্ডের নানা ব্যান্ডের তুলনায় কিছুই না। মানুষ আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে বটে, কিন্তু ওদের ধারেকাছে পৌঁছচ্ছে না আমাদের ইনস্ট্রুমেন্টগুলো,” জানালেন সাবিন। কুমুদিনী হোমস-এর পাইপ এবং ড্রাম ব্যান্ডটি আমন্ত্রণ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত।

প্রতি বছরই বাসেলে এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সামরিক ব্যান্ড, প্রদর্শনী দল, জনপ্রিয় মিউজিসিয়ানস এবং ট্যাটু নিয়ে এই উৎসব। জনপ্রিয় রয়্যাল এডিনবরা মিলিটারি ট্যাটুর পরে এই উৎসব পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ২০২২ সালের উৎসবটি শুরু হয়েছে ১৫ জুলাই, চলবে ২৩ তারিখ পর্যন্ত। পশিমবঙ্গের কালিম্পং-এর এক প্রান্তিক গ্রামাঞ্চল থেকে সুইজারল্যান্ডের পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। ব্যান্ডের একুশ জনই তা জানেন অত্যন্ত ভালো করে। প্রত্যেক দিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা রেওয়াজ চলত, জানিয়েছেন প্রিয়দর্শিনী লামা। তিনিও এখন ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে।

'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লামা জানান, তাঁর অতীতের কথা মনে পড়ছে। বারো বছর আগে তিনি যখন যখন কুমুদিনী হোমস-এ ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন, তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, একদিন এই ছাত্ররা ইতিহাস তৈরি করবে। কুমুদিনী হোমস-এর এই ব্যান্ডটি প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় ব্যান্ড যারা বাসেল ট্যাটুতে অনুষ্ঠান করতে চলেছে। লামা আরো জানান, তিনি যখন কুমুদিনী হোমসে কমার্সের শিক্ষক হিসেবে পড়াতে শুরু করেন, তখন তাঁর বয়েস ছিল একুশ। কিন্তু সংগীতে আগ্রহ তাঁর বাড়তেই থাকে। তিনি স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। “এ যেন স্বপ্নপূরণ, আমাদের প্রত্যেকের স্বপ্নই বাস্তব হয়ে উঠল। হঠাৎ করে জীবন এক নতুন পথ দেখাল… বাসেল ট্যাটু-তে যারা সাধারণত অনুষ্ঠান করার সুযোগ পান, তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। আমাদের গোটা জর্নিটা, নির্বাচিত হওয়া থেকে উৎসবে পৌঁছানো পর্যন্ত যাবতীয় কিছু যেন সিনেমার স্ক্রিপ্ট, এতটাই অবিশ্বাস্য!” —বললেন লামা।

“২০১৯-এই আমাদের প্রথমবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারপরেই অতিমারী। যাওয়া পিছিয়ে গেল। ফের আমন্ত্রণ এল। সবার প্রয়োজনীয় নথিপত্র, মানে পাসপোর্ট, ভিসা– এসবের আয়োজন করতে করতে কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি। পাহাড়ের জীবনযাত্রা খুব সহজ নয়, যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এসব করতে। কখনও নেট থাকে না, কখনও বিদ্যুৎ থাকে না। ১০ জুন-এর টিকিট বুক করা হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু এয়ারলাইন ফ্লাইটটাই ক্যানসেল করে দিল। স্থানীয় এমপি-কে ধরে ফের টিকিট কাটা হল মিউনিখের, ১২ জুলাই সেখানে পৌঁছলাম। এখানে (বাসেলে) লোকজন ভেবেছিল, আমরা হয়তো পৌঁছতেই পারব না, কিন্তু শেষমেশ আমরা যখন পৌঁছলাম, সকলে চমকিত, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল সবাই। আমার দল এবং আমার কাছে তা খুবই স্মরণীয় মুহূর্ত। কিন্তু আমাদের বাদ্যযন্ত্র কমদামি, খুবই সাধারণ মানের। এগুলোর আওয়াজ অন্যদের তুলনায় কিছুই না। আমাদের ইউনিফর্মও বাকি ব্যান্ডের তুলনায় নিম্নমানের। এমন বিশ্বমানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য যদি সরকার আমাদের উন্নতমানের বাদ্যযন্ত্র এবং পোশাকআষাক দিলে খুবই ভালো হতো," এমনটাই মনে করছেন লামা। ব্যান্ডপাইপ বাজানো ছাড়াও ‘কুকরি নাচ’ করেছে ব্যান্ডটি সেই মঞ্চে।

 

More Articles