গভীর রাতে নূপুরের আওয়াজ, গোঙানির শব্দ! গোলকোন্ডা দুর্গ আজও বিস্ময়

Golconda Fort: ৪৮০ ফুট উচ্চতার এই দুর্গ এবং তার অন্তর্গত শহরের নির্মাণ পুরোটাই হয়েছিল গ্রানাইটের পাহাড়ের উপর এবং সেই পাহাড়েরই গ্রানাইট এবং মূলত মাটি ব্যবহার করে।

হায়দরাবাদ বললেই কী মাথায় আসে? বিরিয়ানি? চারমিনার? মুক্তো? ধ্রুপদী ব্যাটসম্যান? সব ক'টাই সঠিক। তবে এখন সেই সঙ্গেই যোগ হয়েছে বেঙ্গালুরুর পর চাকুরিজীবীদের নতুন গন্তব্যস্থলের তকমা। বিগত তিন চার বছরে হায়দরাবাদ সেই নিরিখে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে নিজামের শহরকে শুধুমাত্র এই ক'টি বিষয় দিয়ে মাপলে চলবেনা। হায়দরাবাদে আছে আরও অনেক কিছু যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। একদিকে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ টানতে এই শহর নিজের পরিকাঠামোকে তীব্র গতিতে বিশ্বমানের করে তুলছে, পাশাপাশিই খুব যত্ন করে ধরে রাখছে তার ইতিহাসকে এবং সেই ইতিহাসের চিহ্ন বহনকারী স্থাপত্যগুলিকে। সামান্য শব্দে সব কিছু নিয়ে আলোচনা সম্ভবই নয়।

সেই স্থাপত্যগুলির মধ্যেই একটি হল গোলকোন্ডা ফোর্ট। এককালের হীরকখনি এবং কয়লাখনি থেকে উপার্জিত পাহাড় প্রমাণ ঐশ্বর্য এবং অবিশ্বাস্য কারিগরি বিদ্যার নিদর্শন নিয়ে হায়দরাবাদ শহরের কেন্দ্র থেকে ১১ কিলোমিটার দূরত্বে, এক বিস্তীর্ণ উপত্যকায় পাহাড়ের চূড়ার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নিশ্ছিদ্র দুর্গ। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের (১৫১২-১৬৮৭) রাজধানী গোলকোন্ডার হিরে ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সেই সময়ে কোহিনূরেরও ঠিকানা ছিল ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট গোলকোন্ডা ফোর্ট। তবে, শুধু কোহিনূর নয়, হোপ ডায়মন্ড, দরিয়া-ই-নূরের মতো বিশ্ব বিখ্যাত হিরেরও ঠিকানা ছিল গোলকোন্ডা। স্থাপত্য, কিংবদন্তি, ফোর্টের উত্থান, পতনের এক আশ্চর্য ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই হেরিটেজ সাইটকে।

কাকাতিয়া শাসন আমলে এই দুর্গটি তৈরি হয়েছিল কোন্ডাপাল্লি দুর্গের পশ্চিমভাগ সুরক্ষিত করার জন্য। রাজা কৃষ্ণদেব পাহাড়ের শীর্ষে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। ৪৮০ ফুট উচ্চতার এই দুর্গ এবং তার অন্তর্গত শহরের নির্মাণ পুরোটাই হয়েছিল গ্রানাইটের পাহাড়ের উপর এবং সেই পাহাড়েরই গ্রানাইট এবং মূলত মাটি ব্যবহার করে। ১৩৬৩ সালের এক চুক্তির ভিত্তিতে তারা এই স্থান বাহমনি শাসকদের হাতে তুলে দেন। পরবর্তীকালে ১৪৯৫-৯৬ সাল নাগাদ জায়গীর হিসেবে এটিকে তুলে দেওয়া হয় কুলী কুতুব শাহকে।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কালীমূর্তি চুরি হয়ে রাজস্থানের দুর্গে! যেভাবে পুজো হয় যশোরেশ্বরী কালীর

গোলকোন্ডা আর্থিক সমৃদ্ধির মুখ দেখতে শুরু করে মূলত বাহমনিদের শাসনকালে। সময়ের নিয়মে বাহমনিরা দুর্বল হয়ে পড়ে, ১৫১২ সালে গোলকোন্ডায় প্রতিষ্ঠিত হয় কুতুবশাহি রাজবংশ। ক্ষমতায় এসে তারা মূলত মাটি দ্বারা নির্মিত এই দুর্গকে গ্রানাইটের পাথর দিয়ে সংস্কার করা শুরু করেন। দুর্গের পরিধি বিস্তৃত হয়ে দাঁড়ায় ৪ কিলোমিটারে। ১৫৯০ সাল পর্যন্ত এই দুর্গই ছিল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে। ১৬৮৭ সালে এটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয় এবং মুঘল শাসক ঔরঙ্গজেব যখন হায়দরাবাদ দখল করেন তখন দুর্গটিও মুঘলদের হাতে চলে আসে।

গোলকোন্ডা ফোর্টের আটটি প্রবেশদ্বার এবং চারটি স্থানান্তরযোগ্য সেতু আছে। বালা হিসার গেট হল প্রধান প্রবেশপথ। ভিতরে আছে আবাসন, দরবার, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার, ইত্যাদি। একদম নিচে আছে সর্ববহিস্থ দেওয়াল যা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ফাতেহ দরজা অতিক্রম করে যেতে হয়। ফাতেহ দরজার অর্থ হলো বিজয় দরজা। ঔরঙ্গজেবের বাহিনী এই দরজা দিয়েই দুর্গে প্রবেশ করেছিল। কথিত আছে, দরবার থেকে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত একটি গোপন সুড়ঙ্গ আছে। চারমিনারের দিকেও একটি সুড়ঙ্গ আছে বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন- নাজেহাল হয়েছিল ব্রিটিশরা, ফোর্ট উইলিয়াম হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্র

দুর্গের ভিতরে তিনটি মসজিদ আছে। তারামতী, ইব্রাহিম এবং হিরাখানা। সেই সঙ্গে রয়েছে আশলাহ খানা, বন্দিশালা, হাবশি কামান, উটের আস্তাবল, নাগিনা বাগ, বিশাল অস্ত্রাগার এবং সেই সময়ের হিরে ব্যবসায়ীদের বাজার। দুর্গটি ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় কতটা উন্নতমানের কারিগরি বিদ্যার এবং প্রকৌশলবিদ্যার প্রয়োগ করা হয়েছে এখানে। দুর্গকে নিশ্ছিদ্র করতে বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত সুকৌশলে কামান রাখা হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রধান ফটকের সামনের অংশটি এতটাই সংকীর্ণ করা হয়েছে যাতে হাতির বাহিনী গতিবেগ না পায় এবং ধাক্কা না মারে। দেওয়ালের প্রযুক্তিও এতটাই উন্নতমানের যে বিশেষ একটি স্থান থেকে হাততালির মাধ্যমে অনেক দূরে একেবারে উপরে সংকেত পাঠানো সম্ভব ছিল। এখনও প্রধান ফটক থেকে কিছুটা ভিতরে গিয়ে হাততালি দিলে তার প্রতিধ্বনি চারিদিকে শোনা যায়।

দুর্গের ভিতরে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন, প্রবেশদ্বার এবং গম্বুজের সৌন্দর্যে মানুষ মোহিত হয়ে যান। আছে অপূর্ব সুন্দর বাগান। আছে হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন চিত্র এবং গোলাকার অলংকরণ। মনোহর বাগান এবং বিশাল পাথরে ঘেরা এই স্থান মন জয় করবেই।

তবে এই অপূর্ব সুন্দর এবং নিশ্ছিদ্র দুর্গের অন্য ইতিহাসও রয়েছে। আছে রহস্যজনক অধ্যায়। একেই হিরে মাণিক্যের আধিক্যের ফলে লোভ, লালসা, ষড়যন্ত্র এই সব কিছুই দেখেছে গোলকোন্ডার এই দুর্গ। সেই সঙ্গে রয়েছে এক পরিণতি না পাওয়া প্রেম কাহিনি। লোকমুখে শোনা যায়, সেই পরিণতি না পাওয়া প্রেম নাকি পরিণত হয়েছে ভৌতিক গল্পেও। শোনা যায়, সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহ প্রেমে পড়েন তারামতী নামের একজন নর্তকীর। তাঁর সঙ্গীত এবং নৃত্যকলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভালবেসে ফেলেন। তাঁর জন্য গড়ে দেন পৃথক বাসস্থান। কিন্তু শেষমেশ চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি এই প্রেম। স্থানীয়রা বলেন, সেই কারণেই নাকি আজও তারামতীর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই দুর্গে। গভীর রাতে দুর্গ থেকে নূপুরের আওয়াজ, গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। অনেকে আবার বলেন, দুর্গে সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহের আত্মাও নাকি ঘুরে বেড়ায়। অনেক পর্যটক নাকি ভীতিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়েছেন। তবে গোলকোন্ডা ফোর্ট যে এক আশ্চর্য নিদর্শন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। হায়দ্রাবাদে গেলে এই দুর্গের দর্শন করতেই হবে।

More Articles