৬০ বছর ধরে অমরনাথ তীর্থযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই মুসলিম পরিবার

কাশ্মীরের বাটাকোটের বাসিন্দা মালিক পরিবারের সঙ্গে অমরনাথের সম্পর্ক শতাব্দীপ্রাচীন। আজও সেই স্মৃতি বুকে আগলে বসে থাকেন ৯৫ বছরের এক মুসলিম বৃদ্ধ। গত ৬০ বছর ধরে অমরনাথ দর্শনে হাত লাগিয়েছেন তিনি।

নুপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য। দেশে একাধিক স্থানে হিংসার ঘটনা। দর্জির শিরশ্ছেদ। এই দেশের বুকে বারবার দানা বেঁধেছে হিংসার বীজ। তবে শিকড়ের দিকে হাঁটলে দেখা যায় এই দেশের মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরতে পরতে মিলেমিশে থাকার ইতিহাস। হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র সেই ইতিহাসের বাইরে নয়। কাশ্মীরের বাটাকোটের বাসিন্দা মালিক পরিবারের সঙ্গে অমরনাথের সম্পর্ক শতাব্দীপ্রাচীন। আজও সেই স্মৃতি বুকে আগলে বসে থাকেন ৯৫ বছরের এক মুসলিম বৃদ্ধ। গত ৬০ বছর ধরে অমরনাথ দর্শনে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন, অমরনাথ দর্শন সেরে তাই আজও তাঁর কাছে ভিড় জমান অসংখ্য যাত্রী।

দু'বছর করোনার কারণে বন্ধ ছিল অমরনাথ যাত্রা। এই বছর থেকে আবার তা চালু হয়েছে। পবিত্র অমরনাথ গুহার সঙ্গে তাঁর পরিবারের কী সম্পর্ক, তা শোনালেন গুলাম নবি মালিক। চারিদিকে হিংসার রাজত্বে এ এক বিরল ছবি। গল্পটি এখনও প্রাসঙ্গিক।

এক মুসলিম পশুপালক হঠাৎ একদিন পাহাড়ের গুহায় তুষারের শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করে ফেললেন। তারপর দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে সেই সংখ্যালঘু পরিবারই পুণ্যার্থীদের তা দর্শন করাতে নিয়ে যায়। সেখানে মন্ত্র পড়িয়ে পুজো করানো হয়। এখনও সেই মন্ত্র স্পষ্ট মনে রয়েছে গুলাম নবি মালিকের। পহেলগাঁও-এর বাটাকোট গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বয়স ৯৫ বছর। বয়সের কারণে বহু বছর যেতে পারেননি অমরনাথ যাত্রায়। কিন্তু টানা ৬০ বছর ভক্তদের অমরনাথ গুহায় নিয়ে গিয়েছেন। পৌরোহিত্য করেছেন। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মালিক বলেন, অমরনাথ যাত্রীরা তাঁদের পরিবারকে পুরোহিতের মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, কেউ ভাবেননি আমরা মুসলিম না হিন্দু।

আরও পড়ুন: পিটার ব্রুকের হাতে মহাভারত হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর মহাকাব্য

গত ৬০ বছর ধরে এই যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ৯৫ বছরের গুলাম নবি মালিক। জীবন্ত এক কিংবদন্তির নাম মালিক। একদিকে তিনি বহন করছেন পারিবারিক ঐতিহ্য, যার মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতি জয়গাথা। অমরনাথের গুহামুখে ওই বরফের শিবলিঙ্গ খুঁজে পেয়েছিলেন মেষপালক বুটা মালিক। তাঁরই বংশধর এই গুলামরা। এককালে পুণ্যার্থীদের অমরনাথের গুহা দর্শন করাতে নিয়ে যেতেন গুলাম নবি। দৃপ্ত গলায় বলে চলতেন মন্ত্র। তাঁকে পূজারীর মতোই সম্মান দিয়ে এসেছেন পুণ্যার্থীরা।

অমরনাথ যাত্রার মরশুমে প্রতি বছর সেসব কথা মনে পড়ে যায় বৃদ্ধ গুলাম নবির। ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি সিং ও তাঁর স্ত্রী তারা দেবী এসেছিলেন অমরনাথ দর্শনে। সেসময় গুলাম নবিকে নাকি তামার প্লেটে ভর্তি করে খেজুর উপহার দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই তামার প্লেট আজও তাঁর কাছে রয়েছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। ৭০ বছর আগে সেই প্রথম অমরনাথ যাত্রার সঙ্গী হন গুলাম।

১৮৫০ সালের কথা। পেশায় মেষপালক বুটা মালিক ঘুরতে ঘুরতে সন্ধান পান ওই গুহাটির। এখানে বরফ জমে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় শিবলিঙ্গ। তখন থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অমরনাথ যাত্রার ব‍্যবস্থাপনায় জড়িত থেকেছে মালিক পরিবার। আজও বহু পুণ্যার্থীর কাছে মালিক পরিবার দর্শন তীর্থেরই অঙ্গ। তাঁরা আসেন, বৃদ্ধ গুলাব নবি তাঁদের শোনান অমরনাথ যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা গল্প। তাঁদের শোনান গুহার ইতিহাস। বুটার সমাধির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা ঝরনা। বহুদিন পর্যন্ত সেখানে পানীয় জল সরবরাহ হতো। সেটিও হয়ে উঠেছিল দর্শনীয় স্থান।

বয়সের কারণে তিনি আর গুহায় যেতে পারেন না, পুণ্যার্থীদের অমরনাথ দর্শন করাতে নিয়ে যেতে পারেন না, তবে এখনও তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় পূজামন্ত্র, যা আন্দোলিত করে অমরনাথ যাত্রাকে। ইদানীং প্রশাসন নিরাপত্তার কারণে চাপিয়েছে বেশ কিছু বিধিনিষেধ, এতে রুষ্ট মালিক পরিবার। তবে পুণ্যার্থীদের মধ্যে এখনও মালিক পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আকুলতা আছে। এই বিষয়ে মহম্মদ আক্রম মালিক বলেছেন, একবার যাত্রীরা শিসনাগ থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন, তাঁরা জানতে পারেন, মালিকরা সেখানেই রয়েছেন। তাঁরা মালিক পরিবারের খোঁজ শুরু করেন। মালিকরা পহেলগাঁওয়ে এক গ্রামে থাকতেন। পুণ্যার্থীরা বলেন, অমরনাথ দর্শনের আগে মালিক পরিবারের সঙ্গে দেখা করে যাত্রা শুরু করবেন।

তিনি আরও জানান, বহু যাত্রীর মধ্যেই গুহার ইতিবৃত্ত জানার জন্য তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আকুলতা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বিধিনিষেধের জন্য অনেক যাত্রী তাঁদের কাছে এসে পৌঁছতে পারেন না।

অমরনাথ গুহা একটি হিন্দু তীর্থক্ষেত্র, যা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি একটি শৈব তীর্থ। গুহার ৪০ মিটার ভেতরে ছাদ থেকে জল ফোঁটা ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ে। এই চুঁইয়ে পড়া জলের ধারা খাড়াভাবে গুহার মেঝেয় পড়ার সময় জমে গিয়ে শিবলিঙ্গের আকার ধারণ করে। কখনও কখনও ৮ ফুট উঁচু হয় শিবলিঙ্গ। তবে গত কয়েক বছর ধরে বরফলিঙ্গ গলে যাচ্ছে। এর কারণ হয়তো উষ্ণায়ন। জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা। শেষ হয় জুলাই-আগস্ট মাসে গুরু পূর্ণিমার সময় ছড়ি মিলিয়ে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অমরনাথ যাত্রায় ভিড় করেন। ২ বছরের অপেক্ষার পর আবার শুরু হল এই তীর্থযাত্রা।

দেশ হিংসার আগুনে জ্বলেছে। নুপুর শর্মার পরগম্বর মন্তব্য, এবং তারপর মুসলমানদের জ্বালাময়ী ক্ষোভ। সেই আগুনে পুড়েছে দেশ। এখনেই রাগ থামেনি। উদয়পুরে দর্জির নৃশংস হত্যা, তাঁর শিরশ্ছেদের ভিডিও ভাইরাল করার কী জিঘাংসা! রক্তপিপাসুদের উন্মত্ত উল্লাস। এর মধ্যেই রক্তাক্ত দেশের বুকে বিরল ছবি এঁকে দিয়েছে মালিক পরিবারর। তাই হিংসার আগুনে ফুটতে থাকে দেশে গুলাম নবি মালিকের কণ্ঠে - 'কেউ ভাবেননি আমরা মুসলিম না হিন্দু’, এই কথাগুলো বছরের পর বছর কোনও এক গুহার অন্দর ছাড়িয়ে উচ্চারিত হবে দেশের অন্তরে।

 

More Articles