পিটার ব্রুকের হাতে মহাভারত হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর মহাকাব্য
পিটার ব্রুক সেই শিল্পীদের একজন, যাঁরা এক একটা শিল্পমাধ্যমকে একা হাতে এগিয়ে দিয়ে যান কয়েকশো বছর। ব্রুকেরাই পারেন, শূন্য থেকে থিয়েটার সৃষ্টি করতে।
ব্রিটিশ থিয়েটারের অন্যতম পরিচালক পিটার ব্রুক চলে গেলেন ৯৭ বছর বয়সে। বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল ব্রুকের। ২ জুলাই তাঁর চলে যাওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেন তাঁর সহকারী নিনা সৌফি। থিয়েটারের যে চলতি ধারণা, সেই ধারণাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন ব্রুক। নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছিলেন থিয়েটারকে। সে স্ট্র্যাটফোর্ডের রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানির নাটকেই হোক বা বুফ দে নহ্–ব্রুকের নাটক, তাঁর নাট্যবীক্ষণ ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। প্যারিসের ভূতপূর্ব মিউজিক হলটিতে তিন দশকেরও বেশি কাজ করেছেন তিনি। আফ্রিকার গ্রামে গ্রামে নাটক করেছেন, নাটক করেছেন বিশ্বজুড়ে। এই বিশাল কর্মক্ষেত্রই তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
বহু নাটককেই কেটেছেঁটে মেদহীন উপস্থাপন করতে পারতেন, এই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে নাটকে জুড়ে যেত তাঁর নিজস্ব রসবোধ। ১৯৭০ সালে শেক্সপিয়রের 'এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’-এর আরএসসি ভার্সনটি অনুষ্ঠিত হয়। এটিকে ব্রুকের পরিচালক জীবনের অন্যতম স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। জেরম রবিন্সের ব্যালে এবং পেকিং সার্কাস থেকে নাকি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ভদ্রলোক। পুরো নাটকটি মঞ্চায়িত হয় একটি সাদা কিউবের মধ্যে, ট্র্যাপিজ ব্যবহার করা হয়েছিল, রণপা ব্যবহার করা হয়েছিল। জঙ্গল তৈরি করা হয়েছিল স্টিলের তার দিয়ে। বেন কিংসলে এই অভূতপূর্ব নাটকে অভিনয় করেছিলেন। ব্রুকের মৃত্যুতে তিনি বলেছেন, “ব্রুকের চলে যাওয়া ভেতরটা ফাঁপা করে দিয়ে গেল, এই শূন্যতা সহজে ভরার না, কিন্তু ওঁর মণীষার তো মৃত্যু হয় না, আমরা যারা ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, ওঁকে চিনেছি, ভালবেসেছি, আমাদের তাইই পথ দেখাবে।” ব্রুকের নাটকে জন গেলগাড কাজ করেছেন, লরেন্স অলিভার, পল স্কফিল্ডের মতো শিল্পী, আদ্রিয়ান লেস্টারের মতো শিল্পী কাজ করেছেন। এমনকী, নাতাশা প্যারিও ব্রুকের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেখান থেকেই যোগাযোগ দু'জনের। পরে নাতশাকে বিয়ে করেন ব্রুক।
ব্রুকের নাটক সাধারণত তাদের বৈচিত্রর জন্যই বেশি পরিচিত। নানা ধরনের অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করাতেন, বলতেন ‘বর্ণময়’ কাস্টিং না হলে নাটক ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে। এছাড়া মিউজিক্যাল করেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকায় নাটক করেছেন, টেড হিউয়ের সঙ্গে প্রমিথিয়াসের যে কিংবদন্তি, তাকে ভিত্তি করে পরীক্ষানিরীক্ষামূলক নাটক করেছেন। মহাভারতের নাট্যরূপ দিয়েছেন। সে ছিল ন'ঘণ্টার নাটক। ২০১৬ সাল নাগাদ এর ওপর ভিত্তি করেই 'ব্যাটলফিল্ড' নামক নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। তবে শুধু নাট্যকার নয়, পাশাপাশি চিন্তানায়ক হিসেবেও ব্রুকের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। লিখেছেন একাধিক বই। ‘দ্য এমপ্টি স্পেস’ ব্রুকের অত্যন্ত বিখ্যাত গ্রন্থ। এতে নাটক সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনার খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যায়, বলছেন “যে কোনও ফাঁকা জায়গাকেই আমি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। একটিমাত্র মানুষ সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেসময় আর একটি মানুষ তাকে দেখছে, থিয়েটার করার জন্য এইই যথেষ্ট।”
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
বিখ্যাত থিয়েটার সমালোচক কেনেথ টাইনান ব্রুককে বলতেন খাদ্যরসিক। কারণ তাঁর মতে, ব্রুক থিয়েটার রান্না করেন ক্রিম, রক্ত এবং মশলা দিয়ে। সিনেমাতেও কাজ করেছেন ভদ্রলোক। ১৯৬৩ সালের 'লর্ড অফ ফায়েজ'-এর অ্যাডাপটেশন বা 'কারমেন অ্যান্ড দ্য ম্যাজিক ফ্লুট'-এর মতো সিনেমার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
১৯২৫ সালের ২১ মার্চ লন্ডনে জন্মেছিলেন ব্রুক। বছরসাতেক বয়সে বাবা-মার সঙ্গে জীবনের প্রথম অভিনয়টি করেন 'হ্যামলেট' নাটকে। ব্রুকের পড়াশোনা অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজ থেকে। সেই সময়েই রয়্যাল অপেরা হাউজে রিচার্ড স্ত্রসের অপেরা সালোম ও সালভাদোর দালির ডিজাইন দিয়ে নির্দেশনার কাজ শুরু করে দিয়েছেন ব্রুক। স্ট্র্যাটফোর্ডে রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানির ট্রাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস অংশত পরিচালনা করেছেন ১৯৫৫-তে। পাঁচ বছর বাদে, ১৯৬০ সালে পিটার হল যখন আর্টিস্টিক ডিরেক্টর হলেন, তখন তিনি ব্রুককে নিজের সহকারী হিসেবে নির্বাচন করেন। এর কিছুদিন পর সম্পূর্ণ একা কাজ শুরু করেন ব্রুক।
১৯৬২ নাগাদ মঞ্চায়িত হয় 'কিং লিয়র'। পল স্কোফিল্ড অভিনীত সেই নাটকটিকে বিশ্ব থিয়েটারের চূড়ান্ত সাফল্য বলা হয়ে থাকে। আভাঁ গার্দ মারাট/সাদ সেরা নাটক হিসেবে পেয়েছিল টোনি অ্যাওয়ার্ড। তখন ১৯৬৬। বিখ্যাত লেখক মার্কুইস দ্য সাদ জেলে থাকাকালীন বন্দিদের দিয়ে নাটক করাতেন। এই নাটকের বিষয়বস্তুও সাদের নাটককে ঘিরে। অর্থাৎ, নাটকের ভেতর আরেকটি নাটক। সাদ পাগলাগারদের বন্দিদের দিয়ে মারাটের ওপর একটি নাটক করাচ্ছেন– এই হলো ‘মারাট/ সাদ’-এর মূল বিষয়বস্তু। এছাড়াও ব্রুক নির্দেশিত প্রচুর নাটক ব্রডওয়ে ট্রান্সফার পেয়েছে।
১৯৭০ নাগাদ ব্রুক চলে গেলেন প্যারিসে। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়েটার রিসার্চ। এই কোম্পানি নিয়ে চলে গেলেন আফ্রিকা। সেখানে দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হলো নতুন ধরনের নাটক। সমসাময়িক থিয়েটারের কিছুই সেখানে ব্যবহার করা হল না। অভিনেতারা এক নতুন নাট্যাভিনয়ের সূচনা করলেন। ব্রুক বলছেন, “আমরা এমন দর্শকদের সামনে নাটক মঞ্চায়িত করতে চাইছিলাম, যারা কোনও বিশেষ ধরনের নাটক দেখতে অভ্যস্ত নয়। যাদের কোনওরকমের আড় থাকবে না। কোনও রকমের সাহিত্যকেন্দ্রিক বা থিমকেন্দ্রিক মায় নামাঙ্কিত নাটকও আমরা বাদ দিয়েছিলাম।” ১৯৭৪-এ ‘গার দে নহ্’ স্টেশনের পেছনে একটা পরিত্যক্ত মিউজিক হলকে গড়ে পিটে নিলেন, তৈরি হল থিয়েটারপ্রেমীদের তীর্থক্ষেত্র, 'বুফ দে নহ্'। গড়েপিটে নেওয়া বলতে পুড়ে যাওয়া এই বিল্ডিংটায় খুবই হালকা সংস্কারের কাজ হল। ফলে যেমন ভাঙাচোরা অবস্থায় ব্রুক এটা আবিস্কার করেছিলেন, প্রায় সেরকমই থেকে গেল হলটা। এর মধ্যেই খোলা হলো নাট্যশালা। 'টিমন অফ এথেন্স' নাটক মঞ্চস্থ হল। হাততালিতে ফেটে পরার জোগাড় সেই ভাঙা ঘর।
পিটার ব্রুকের দেওয়া 'মহাভারত'-এর নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয় ১৯৮৫ সালে। ন'ঘণ্টার সেই নাটক চার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে অভিনীত হয়েছিল। পরে ছ'ঘণ্টার একটি সিনেমায় পরিণত হয় এই নাটক। বিভিন্ন দেশের অভিনেতারা অভিনয় করেন এই ছবিতে, দ্রৌপদীর চরিত্রে ছিলেন নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই। ভারতে টিভিতেও প্রদর্শিত হয় এই নাটক, মিনি সিরিজ হিসেবে। 'মহাভারত' তাঁর হাত ধরে হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক। ২০২১ সালেই তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ দিয়েছিল ভারত সরকার।
পিটার ব্রুক সেই শিল্পীদের একজন, যাঁরা এক একটা শিল্পমাধ্যমকে একা হাতে এগিয়ে দিয়ে যান কয়েকশো বছর। ব্রুকেরাই পারেন, শূন্য থেকে থিয়েটার সৃষ্টি করতে, স্ক্রিপ্টহীন, অবয়বহীন নাটকের জন্ম দিতে, পারেন পোড়া, মৃত প্রেক্ষাগৃহের লাশকেই নতুন রকমের প্রেক্ষাগৃহ হিসেবে ব্যবহার করতে।