দেওয়ালজুড়ে খোদাই করা রামায়ণ, ফিরে যাওয়া যায় অতীতে, ঘুরে আসুন ইতিহাসে মোড়া হাম্পি-তে

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র পটভূমি বিজয়নগরই আজকের হাম্পি। হাম্পি— কেবল একটি স্থাপনা নয়, একটি আস্ত শহরের নাম।

পুরনো রাজবাড়ি কিংবা স্থাপনার ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলেই কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। বিশাল বিশাল নকশা করা স্থাপনা কেবল কৌতূহলই জাগায় না, টেনে নিয়ে যায় সেই সময়। একসময় যেখানে গমগম করত মানুষ, সেখানে এখন কেমন শুনশান নীরবতা, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাস কেবল।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র পটভূমি বিজয়নগরই আজকের হাম্পি। হাম্পি— কেবল একটি স্থাপনা নয়, একটি আস্ত শহরের নাম। যে শহর মুগ্ধতা ছড়ায় প্রতিটি কোণে। দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক রাজ্যের অধীন এই হাম্পি। কেবল ইতিহাস নয়, হাম্পির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাব্যও।

হাম্পির ইতিহাস

হাম্পি বর্তমান কর্নাটক রাজ্যের একটি ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট। ১৩৩৬-১৫৬৫ সাল পর্যন্ত হাম্পি ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের (১৩৩৬–১৬৪৬) রাজধানী। সেই সময় যে-সমস্ত পারসিক এবং ইউরোপীয় পর্যটকরা হাম্পি-বিজয়নগর এসেছিলেন, তাদের, বিশেষত পর্তুগিজদের লেখনী থেকে জানা যায় যে, তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে হাম্পি ছিল একটি অতীব ধনী, বিত্তশালী এবং বৈভবপূর্ণ শহর, যেখানে ছিল অসংখ্য মন্দির, শস্যখামার এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্র। ১৫০০ সালে হাম্পি-বিজয়নগর ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর (বেজিং-এর পরেই) এবং সম্ভবত ভারতের সবথেকে সমৃদ্ধিশালী শহর। ১৫৬৫ সালে তালিকোটার যুদ্ধে ডেকান সুলতানেট-এর জোটশক্তির কাছে বিজয়নগর পরাজিত হওয়ার পর, হাম্পি শহরটি সুলতানেট-এর সেনাবাহিনী দ্বারা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। হাম্পির যে সমস্ত অধিবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়, তারা হাম্পি থেকে পালিয়ে যায় এবং হাম্পি হয়ে যায় এক পরিত্যক্ত নগরী, চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। প্রায় ২৫০ বছর পর, ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল স্কটিশ কর্নেল কলিন ম্যাকেঞ্জি হাম্পির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন।

আরও পড়ুন: সমুদ্রের বুকে ‘অদৃশ্য’ শিব মন্দির! রহস্যময় এই ধর্মস্থান রয়েছে ভারতেই

হাম্পির পৌরাণিক এবং মহাকাব্যিক যোগসূত্র

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠার আগে হাম্পির পরিচয় ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের (বিশেষত শৈব ধর্মাবলম্বীদের) এক গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র হিসেবে। সেই সময় হাম্পির নাম ছিল পম্পা-ক্ষেত্র এবং কিষ্কিন্ধ্যা-ক্ষেত্র। পম্পা-ক্ষেত্র নামটি এসেছে ‘পম্পা’ শব্দ থেকে। পম্পা হল দেবী পার্বতীর অপর নাম। পৌরাণিক মতে, পার্বতী (যিনি শিবের আগের স্ত্রী সতীর পুনর্জন্ম) তপস্বী শিবকে বিবাহ করতে মনস্থ করেন। পার্বতীর পিতা-মাতার এই বিবাহে মত ছিল না, কিন্তু পার্বতী নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। শিব তখন গভীর তপস্যায় মগ্ন, তাই পার্বতী সমস্ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন শিবের ধ্যান ভাঙানোর জন্য। দেবরাজ ইন্দ্র তখন কামদেবকে পাঠান এবং কামদেব শিবের কাছে এসে শিবকে লক্ষ্য করে মদনবাণ ছোঁড়েন। এতে শিবের ধ্যান ভঙ্গ হয়, শিব তাঁর তৃতীয় নয়ন খোলেন এবং সেই দৃষ্টিতে কামদেব ভস্মীভূত হয়ে যান। কিন্তু তাতেও হাল না ছেড়ে, পার্বতী নিজেও শিবের মতো তপস্যায় বসে যান। এতে শিবের ধ্যানভঙ্গ হয়। শিব প্রথমে ছদ্মবেশে পার্বতীর সঙ্গে দেখা করে নিজের সম্পর্কে আকথা-কুকথা বলে পার্বতীর মত বদলের চেষ্টা করেন। কিন্তু পার্বতী অনড়। শেষে শিব পার্বতীকে বিয়ে করতে সম্মত হন। হাম্পির হেমকূট পাহাড়ে বসে পার্বতী তপস্যা করেছিলেন বলে এই জায়গার নাম হয় পম্পা-ক্ষেত্র। শিবের আরেক নাম হয় পম্পা-পতি। শিবের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত বিরূপাক্ষ মন্দিরটি প্রথমে এই হেমকূট পাহাড়ের ওপর ছিল। এই পৌরাণিক যোগসূত্রের কারণে হেমকূট পাহাড় এবং বিরূপাক্ষ মন্দির, বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু আগে থেকেই, শৈব ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পুণ্য তীর্থক্ষেত্র ছিল। সংস্কৃত শব্দ ‘পম্পা’ পরবর্তীকালে কন্নড়ে হয়ে যায় ‘হাম্পা’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘হাম্পা’ হয়ে যায় ‘হাম্পে’ আর তারপর ‘হাম্পে’ থেকে ‘হাম্পি’।

মহাকাব্য রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যও ছিল এই নদীর তীরেই। সেই সময় তুঙ্গভদ্রার নাম ছিল ‘পম্পা’। এই পম্পা শব্দ থেকেই হাম্পি শব্দের আবির্ভাব। রামায়ণে উল্লিখিত মাতঙ্গ পর্বত, মাল্যবান পর্বত, ঋষ্যমুখ পর্বত, পম্পা সরোবর— এসবই রয়েছে হাম্পিকে ঘিরে। হাম্পির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের ইতিহাসও। স্থানীয় লোকজন বিশ্বাস করেন, এটাই রামায়ণে উল্লিখিত সেই স্থান, যা তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে। রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা অধ্যায়ে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমানের সাক্ষাৎ ঘটে এবং এই অধ্যায়েই সুগ্রীব ও বানরবাহিনী অপহৃত সীতার অনুসন্ধানে রত হয়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সূত্রেই এখনও তীর্থযাত্রার অন্যতম গন্তব্য এই হাম্পি। শুধু পৌরাণিক নয়, হাম্পিতে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাসও।

হাম্পির স্থাপত্য, ভাস্কর্য

১৯৮৬ সালে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে স্বীকৃতি দেয় হাম্পিকে। ৪৬.৮ বর্গকিমিজুড়ে ছড়িয়ে আছে হাম্পির পর্বতমালা। হাম্পির এইসব স্থাপনার মূল উপাদান গ্রানাইট পাথর। যে পাথর সেই সময় সংগ্রহ করা হয়েছিল চারপাশে ঘিরে থাকা অন্যান্য পাহাড় থেকে। পুরো হাম্পিই যেন যত্ন করে গড়া এক অনবদ্য স্থাপনা। এসব স্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো মনোলিথিক, বিশেষ করে মন্দিরের বিগ্রহ এবং দেওয়াল ও ছাদজুড়ে নিপুণ কারুকার্য। মধ্যযুগের প্রাচুর্যে ভরা সাম্রাজ্য এখন দাঁড়িয়ে আছে এক পিছিয়ে পড়া জনপদ হিসেবে।

হাম্পির প্রাচীন স্থাপত্যর নিদর্শন রূপাক্ষ বাজারের পাশে এই বিরূপাক্ষ মন্দিরে। কেউ কেউ আবার একে পম্পাপতির মন্দিরও বলেন। মন্দিরের কারুকাজ দেখে সত্যিই জুড়িয়ে যায়। প্রবেশপথে চোখধাঁধানো দু'টি গোপুরম, অর্থাৎ প্রবেশতোরণ ও দু'টি বিশালাকার প্রাঙ্গণ। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের তৈরি বিশাল শিবলিঙ্গ। এছাড়াও মন্দিরের ভিতর রয়েছে পম্পাদেবী, ভুবনেশ্বরী, পাতালেশ্বর, সূর্যনারায়ণ প্রভৃতি আরও মন্দির। পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে তুঙ্গভদ্রা নদী।

এরপর রয়েছে, ইউনেসকো হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত বিজয়বিট্টল মন্দির। এই মন্দির তৈরি হয় ষষ্ঠদশ শতকে রাজা কৃষ্ণদেব রাওয়ের রাজত্বকালে। মন্দির ঘিরে রয়েছে উঁচু প্রাচীর। পুরো মন্দিরের দেয়াল, স্তম্ভের পাথুরে গায়ে খোদাই করা রয়েছে সৈন্যদল, যুদ্ধ হস্তী, নর্তকীর অবয়ব। মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারুকার্যমণ্ডিত দণ্ড এবং ছোট স্তম্ভ দিয়ে তৈরি আয়তাকার স্তম্ভ। স্তম্ভগুলোয় সামান্য আঘাত করলেই সুর ছড়ায়। অধিকাংশ স্তম্ভের সেই সুর ধ্বংস হয়ে গেলেও জানা যায়, এখনও প্রায় আটটি স্তম্ভ থেকে ভেসে আসে জলতরঙ্গ, সপ্তস্বরা, ডমরু প্রভৃতির মুগ্ধ সুর। মূল মন্দিরের সামনেই হাম্পির বিখ্যাত পাথরের রথ। পাথরেই খোদাই করে তৈরি করা আস্ত রথ। ভারতের পঞ্চাশ টাকার নোটে যে চিত্র দেখা যায়, তা এই পাথুরে রথেরই। হাম্পির সমস্ত দ্রষ্টব্যই খোলা থাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। বিজয়বিট্টল মন্দিরের কাছেই রয়েছে পাথরের তৈরি দাঁড়িপাল্লা (কিংস ব্যালেন্স)। থামের ভাস্কর্যে রয়েছে রাজা ও রানির মূর্তি। উৎসবের দিন, বিশেষত সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, রাজ্যাভিষেক, দশেরার মতো পুণ্য তিথিতে বিজয়নগরের রাজারা নিজের ওজনের সোনা-রূপো-মণিমুক্তো ওজন করে দান করতেন গরিব-দুঃখীদের।

বিজয়বিট্টল মন্দিরের মুগ্ধতা কাটিয়ে এবারের যাত্রা পরের গন্তব্যে। যাত্রাপথে যতদূর চোখ যাবে, পুরোটাই উঁচু-নিচু, ছোট-বড় এক পাথুরে শিল্পনগরী। হাম্পির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ধর্মীয় ভাস্কর্য, পৌর ভাস্কর্য, প্রতিরক্ষা ভাস্কর্য। এবারে গন্তব্য কুইন্স বাথ। এটি রানির স্নানাগার। মাঝারি মাপের মহল। বাইরে সাদামাটা, কিন্তু ভেতরে ঝরোখা, আর্চ, ফোয়ারার স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করে। স্নানাগারের পাশে উঁচু সিঁড়ি, যে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সতর্ক পাহারায় থাকতেন রানিদের নারী রক্ষীরা, যাতে কোনও পুরুষ অনধিকার প্রবেশ করতে না পারে। এ চত্বরেই রয়েছে হাজার রামমন্দির। যার দেওয়ালজুড়ে খোদাই করা আছে রামায়ণের বহু কাহিনি। তারপরের গন্তব্য, লোটাস মহল। হাম্পির অন্যতম এই নিদর্শনের স্থাপত্যরীতি মূলত হিন্দু-মুসলিমের মিশ্রণ। এর নিচতলায় আর্চের গঠন ইসলামিক রীতিতে আর ওপরতলায় হিন্দু রীতিতে। লোটাস মহল থেকে বের হয়েই বিশাল হাতিশালা। হাতিশালার পাশেই রক্ষীদের থাকার জায়গা রক্ষীভবন। এরপর এক এক করে দেখা যেতে পারে নৃসিংহ মূর্তি, কমলাপুরা মিউজ়িয়াম‍।

ধ্বংসের পরেও হাম্পিতে এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা অবাক করে। এ যেন খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে থাকা স্থাপত্যশিল্পের মহার্ঘ এক সংগ্রহশালা। ইতিহাসের পদচিহ্ন দর্শন করলে বোঝা যায় হাম্পির আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এই সব মন্দির, প্রাসাদ, বিলাসভবন, পশরা দেখে পুরো হাম্পির স্বাদ গ্রহণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তুঙ্গভদ্রার তীরে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক হাম্পি মোহময়ী। এই শহরের আনাচ-কানাচে জড়িয়ে নানা বংশের রাজত্বগাথা, পৌরাণিক কাহিনি। হাম্পি এক অসাধারণ নিদর্শন, যার রেশ রয়েই যায়।

কীভাবে যাবেন

১. বেঙ্গালুরু থেকে সরাসরি ট্রেন/বাস পাওয়া যায় হোসপেট অবধি। সেখান থেকে বাস বা অটো পাওয়া যায় হাম্পি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। এরপর হাম্পি ঘোরার জন্য আলাদা অটো বাস। রাত্রিযাপন হাম্পিতেও করা যায়, আবার হোসপেটেও।

২. আবার, হায়দরাবাদ বা বেঙ্গালুরু থেকে জিন্দাল বিদ্যানগর এয়ারপোর্টে নেমে তোরঙ্গল্লু। সেখান থেকে হাম্পি ৩২ কিলোমিটার। ট্রেনে গেলে নামতে হবে হোসপেট। সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার হাম্পি।

 

More Articles